ভারতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন শুধু প্রযুক্তির হাতিয়ার নয়—এটি ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে ঘৃণা ছড়ানোর এক বিপজ্জনক অস্ত্রে। বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইসলামবিদ্বেষ ছড়াতে জেনারেটিভ এআই (GAI) টুল ব্যবহারের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলবিরোধী প্রচারণা তৈরিতে ও তা দ্রুত ছড়িয়ে দিতে এআই–এর অপব্যবহার নিয়ে সোমবার এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব অর্গানাইজড হেট (CSOH)।
প্রতিবেদনের শিরোনাম—‘AI-Generated Imagery and the New Frontier of Islamophobia in India’—অর্থাৎ ‘ভারতে ইসলামবিদ্বেষের নতুন দিগন্ত: এআই-নির্মিত চিত্রকল্প’।
দুই বছরে ১,৩২৬টি এআই-নির্মিত বিদ্বেষমূলক পোস্ট
গবেষণায় দেখা গেছে, মে ২০২৩ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত দুই বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ১,৩২৬টি এআই-নির্মিত ইসলামবিদ্বেষী পোস্ট ছড়ানো হয়েছে। এসব পোস্ট এসেছে ২৯৭টি অ্যাকাউন্ট থেকে—যার মধ্যে ১৪৬টি এক্সে (Twitter), ৯২টি ইনস্টাগ্রামে, এবং ৫৯টি ফেসবুকে।
এই পোস্টগুলোতে মোট ২৭.৩ মিলিয়ন (২ কোটি ৭৩ লাখ) প্রতিক্রিয়া (ইন্টারঅ্যাকশন) হয়েছে।
এর মধ্যে—
এক্সে ২৪.৯ মিলিয়ন, ইনস্টাগ্রামে ২.৩২ মিলিয়ন, আর ফেসবুকে ১,৫২১০০।

মুসলিম নারীদের যৌনচিত্রায়ণেই সর্বোচ্চ প্রতিক্রিয়া
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এআই–নির্মিত এসব পোস্টের লক্ষ্য মূলত মুসলমানদের হেয় ও ঘৃণিতভাবে উপস্থাপন করা। এতে চারটি প্রধান ধারা স্পষ্টভাবে চোখে পড়েছে—
মুসলিম নারীদের যৌনচিত্রায়ণ,
মুসলমানদের অমানবিকভাবে তুলে ধরা,
বিভিন্ন ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচার এবং
সহিংসতাকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে মুসলিম নারীদের যৌন চিত্র উপস্থাপন করা পোস্টগুলোতে—প্রায় ৬.৭ মিলিয়ন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই প্রবণতা প্রমাণ করে যে ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা কেবল ধর্মীয় ঘৃণার ফল নয়; বরং তা গভীরভাবে নারীবিদ্বেষী মানসিকতার সঙ্গেও যুক্ত।
‘লাভ জিহাদ’, ‘জনসংখ্যা জিহাদ’ ইত্যাদি ছড়ানো হয়েছে এআই ছবিতে
গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–নির্ভর ছবি ব্যবহার করে ‘লাভ জিহাদ’, ‘জনসংখ্যা জিহাদ’ ও ‘রেল জিহাদ’–এর মতো বিভ্রান্তিকর ও ঘৃণাপূর্ণ প্রচারণা ছড়ানো হয়েছে। এসব ছবিতে মুসলমানদের এমনভাবে তুলে ধরা হয়, যেন তারা হিন্দু সমাজ ও ভারতের নিরাপত্তার জন্য এক স্থায়ী হুমকি।
কিছু ছবিতে মুসলমানদের টুপি পরা সাপের রূপে দেখানো হয়েছে—যা প্রতারণা, বিপদ ও ‘নাশের প্রয়োজনীয়তা’র প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব ঘৃণামূলক বার্তা কার্টুন বা স্টুডিও ঘিবলির মতো জনপ্রিয় অ্যানিমেশন শৈলীতে উপস্থাপন করা হয়, যাতে সহিংসতা ও বিদ্বেষ তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় বা বিনোদনমূলক মনে হয়।
হিন্দুত্ববাদী গণমাধ্যমের ভূমিকা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, OpIndia, Sudarshan News ও Panchjanya-এর মতো প্রো-হিন্দুত্ববাদী গণমাধ্যমগুলো এই এআই-নির্মিত ইসলামবিদ্বেষী কনটেন্ট তৈরি ও ছড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা এমনভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছে যেন এগুলো সাধারণ গণআলোচনার অংশ।
প্ল্যাটফর্মগুলোর নীরবতা
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এই পোস্টগুলো প্ল্যাটফর্মের নীতিমালা ভঙ্গ করলেও, ১৮৭টি পোস্ট রিপোর্ট (flagged) হওয়ার পরও কোনোটিই সরানো হয়নি। ফলে ফেসবুক, এক্স (টুইটার) ও ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিজেদের নীতিমালা কার্যকর করতে স্পষ্টভাবেই ব্যর্থ হয়েছে।
গবেষকদের সতর্কবার্তা
সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব অনলাইন হেট (CSOH) বলেছে, ভারতের ডিজিটাল পরিসরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)–নির্ভর টেক্সট–টু–ইমেজ প্রযুক্তি এখন ঘৃণার নতুন অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
সংস্থাটি সতর্ক করে জানিয়েছে, এই প্রবণতা ঠেকানো না গেলে তা অনলাইন ঘৃণাকে বাস্তব জীবনের সহিংসতায় রূপ দিতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এখনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, নাগরিক সংগঠন ও নীতিনির্ধারকদের একযোগে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যাতে প্রযুক্তি–নির্ভর ঘৃণার এই বিস্তার রোধ করা যায়।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এআই প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ততই বাড়ছে এর অপব্যবহারের ঝুঁকি। ভারতে এখন এআই–নির্মিত ছবি ও বার্তার মাধ্যমে ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানো এক ভয়াবহ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এটি শুধু অনলাইন ঘৃণার বিষয় নয়—বরং সমাজের সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার জন্য এক ডিজিটাল বিপর্যয়। তাই এই প্রবণতা ঠেকাতে এখনই সমন্বিত ও দৃঢ় উদ্যোগ নিতে হবে।
সূত্র: দ্যা হিন্দুস্তান গ্যাজেট





