বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গা প্রবাসী সংগঠনগুলো জাতিসংঘ ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রদূতদের উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে আরাকান আর্মি (AA) এবং এর রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ULA)-কে বৈধতা দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করার জন্য বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানানো হয়েছে।
চিঠিটি নিউইয়র্ক ও জেনেভায় জাতিসংঘের মিশনে আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেওয়া হয়েছে। এতে স্বাক্ষর করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ রোহিঙ্গা প্রতিনিধি সংগঠনগুলো।
সংগঠনগুলোর ভাষ্য, এই চিঠি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করবে—যারা মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) রাজ্যে দীর্ঘদিনের নিপীড়নের ফলে এখনো রাষ্ট্রহীন নির্বাসনের জীবন কাটাচ্ছেন।
বিভ্রান্তির জবাবে সমন্বিত প্রতিক্রিয়া
রোহিঙ্গা প্রবাসী সংগঠনগুলোর যৌথ বিবৃতি এসেছে সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি (AA) ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর এক সাম্প্রতিক উন্মুক্ত চিঠিকে কেন্দ্র করে। প্রায় ১ হাজার ৯০০ শব্দের ওই চিঠিতে তারা নিজেদেরকে বৈধ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
প্রবাসী সংগঠনগুলোর দাবি, এটি একটি ‘পরিকল্পিত প্রতারণা’ এবং একটি গোষ্ঠীর ভাবমূর্তি পাল্টে দেয়ার অপচেষ্টা, যাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ ও স্বাধীন তদন্ত সংস্থাগুলো যুদ্ধাপরাধ, মাদক ব্যবসা ও জাতিগত নিধনের অভিযোগে বারবার প্রমাণ উপস্থাপন করেছে।

প্রমাণভিত্তিক অভিযোগ
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের প্রতিবেদন A/HRC/60/20, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (২২ আগস্ট ২০২৪) বিবৃতি, ফোর্টিফাই রাইটসের (২৩ জুলাই ২০২৫) প্রতিবেদন এবং মিয়ানমার বিষয়ক স্বাধীন তদন্ত কমিশন (IIMM, ২০২৫)-এর তথ্যের ভিত্তিতে প্রবাসী সংগঠনগুলোর চিঠিতে বলা হয়েছে—আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও পরিকল্পিত হামলা চালিয়ে আসছে। এর মধ্যে ছিল গোলাবর্ষণ, ড্রোন হামলা, অপহরণ ও নির্যাতন।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, আরাকান আর্মি আঞ্চলিক মাদক ও মানবপাচার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সংগঠনগুলোর ভাষ্য, এই গোষ্ঠী আসলে ‘রাজনৈতিক আন্দোলনের মুখোশে সক্রিয় একটি মাদকচক্র।’
ন্যারেটিভ পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা
কূটনৈতিকভাবে পরিমিত ভাষায় লেখা রোহিঙ্গা প্রবাসী সংগঠনগুলোর চিঠিটি খণ্ডন করেছে আরাকান আর্মির সেই প্রচারণাকে, যেখানে তারা নিজেদেরকে ‘মুসলমানদের রক্ষক’ এবং ‘মানবিক প্রশাসন’ হিসেবে তুলে ধরেছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আরাকান আর্মির কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতেই কখনো ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। বরং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলোতে এখনো চলছে জোরপূর্বক কর আদায়, চলাচলে বাধা আর নির্বিচারে আটকসহ নানা নিপীড়ন।
চিঠিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘এগুলো অন্তর্ভুক্তির অনুশীলন নয়, বরং আধিপত্য বিস্তারের অস্ত্র।’
বিপর্যয়ের আশঙ্কা
প্রবাসী সংগঠনগুলো সতর্ক করে বলেছে, আরাকান আর্মিকে রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়া হলে ‘তা হবে বহুস্তরে বিপর্যয় ডেকে আনার মত এক সিদ্ধান্ত।’
আইনগত দিক থেকে, এটি এমন এক গোষ্ঠীকে বৈধতা দেয়া হবে, যাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যুদ্ধাপরাধের তদন্ত চালাচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও জাতিসংঘ ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে।
পাশাপাশি এটি মাদকের অর্থে পরিচালিত একটি মিলিশিয়া গোষ্ঠিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়াজুড়ে পাচার নেটওয়ার্ক আরও বিস্তারে উৎসাহিত করবে। এতে সীমান্ত নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তার প্রবাহ—দুটিই হুমকির মুখে পড়বে।
নৈতিকভাবে, এটি রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেবে—যেখানে গণহত্যা রূপ নেবে এক ধরনের প্রশাসনিক বাস্তবতায়।





