গাজায় টানা দুই বছরের যুদ্ধের মধ্যে ইসরায়েলি সেনাদের ভেতরে তীব্র মানসিক সংকট দেখা দিয়েছে। কেউ সেনাবাহিনী থেকে পালাচ্ছে, আবার কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। ফাঁস হওয়া বিভিন্ন প্রতিবেদন ও ইসরায়েলি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের শুরু থেকেই এ প্রবণতা বাড়ছে, বিশেষ করে দখলদার বাহিনী যখন ‘গিদিয়ন–২’ নামে সামরিক অভিযান চালু করে। তবে সেনাবাহিনী সঠিক সংখ্যা প্রকাশ না করে শুধু বলছে, ঘটনাগুলো নজরদারিতে রয়েছে।
পালানোর কৌশল
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের তথ্যে জানা গেছে, গাজার যুদ্ধক্ষেত্রে না যেতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে সেনা সদস্যরা। মানসিক চাপ ও সরাসরি প্রতিরোধযোদ্ধাদের মুখোমুখি হওয়ার ভয় তাদের এ পথে ঠেলে দিচ্ছে।
চ্যানেল–12’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজ সকালে বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর থেকে আটজন হেরেদি যুবককে আটক করা হয়েছে। তারা সবাই একসঙ্গে ইউক্রেনে পালানোর চেষ্টা করছিল সেনাসেবা এড়াতে। তাদের একজন আগে পলায়নের অপরাধে জেল খেটেছে। এ ঘটনা স্পষ্ট করছে, অনেক সেনা যুদ্ধের বদলে বিদেশে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে।
অন্যদিকে কেউ অসুস্থতার ভান করছে, কেউ বা মানসিক আঘাত (PTSD) প্রমাণ করে মেডিকেল রিপোর্ট জমা দিচ্ছে—যাতে গাজায় পাঠানো না হয়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সেনাদেরও আবার যুদ্ধে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এতে তাদের চাপ আরও বাড়ছে, আত্মহত্যা ও পলায়নের ঘটনা বেড়েই চলছে।
ভঙ্গুর সেনাবাহিনী
সেনাদের পালানোর নানা কৌশল—বিদেশে চলে যাওয়া বা অসুস্থতার অজুহাত—সব মিলিয়ে এক গভীর সংকট তৈরি করেছে ইসরায়েলি বাহিনীর ভেতরে। এতে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সেনাদের ওপর চাপ বাড়ছে, বাড়ছে মানসিক ভাঙন ও আত্মহত্যার ঝুঁকি।
গাজায় প্রতিরোধযোদ্ধাদের সামনে দাঁড়ানোর পরিবর্তে ক্রমেই অনেকে বাঁচার পথ খুঁজছে। এ বাস্তবতা স্পষ্ট করে দিচ্ছে—ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের মুখে দখলদার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ভঙ্গুর অবস্থা।
আনাদোলু এজেন্সির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৬ জন সেনা আত্মহত্যা করেছে। এদের বেশির ভাগই যুদ্ধজনিত মানসিক আঘাত বা ট্রমার শিকার ছিল। অন্য এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মোট ৫৪ জন সেনা আত্মহত্যা করেছে।
এক সেনার অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে, তিনি দুঃস্বপ্নের কারণে ঘুমাতে পারতেন না। প্রতিরোধযোদ্ধাদের হামলার আতঙ্ক তাকে সব সময় তাড়া করত। এমন অভিজ্ঞতা সেনাদের মানসিক চাপে কতটা বিপর্যস্ত করে তুলছে, তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধই ইসরায়েলি সেনাদের মানসিক ভাঙনের অন্যতম কারণ। প্রতিরোধযোদ্ধারা নানামুখী সামরিক কৌশল ব্যবহার করছে—ভারী গোলাবর্ষণ, সরাসরি সেনা অবস্থানে হামলা, এবং ঘনঘন কৌশল বদল। এসব কৌশল সেনাদের এক ধরনের স্থায়ী ভয়ের মধ্যে ফেলছে। বিশেষ করে অনিরাপদ স্থানে মোতায়েন থাকা সেনারা সব সময় মনে করছে, তারা হামলার শিকার হতে পারে। এর ফলে উদ্বেগ ও ভয়ের মাত্রা আরও বাড়ছে।
হঠাৎ হামলা আর যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান ক্রমাগত বদলানোর কারণে সেনারা কখন কোথায় আক্রমণের মুখে পড়বে, তা বুঝতে পারছে না। এতে তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।
হারেৎজ ও টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন সেনারা ক্রমাগত মানসিক চাপে থাকে এবং এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে জীবন কাটায়। এর ফলেই কেউ কেউ সেনাসেবা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কেউ বা পালিয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া রিজার্ভ সেনাদের ভেতরেও বড় সংকট তৈরি হয়েছে। অনেকে আগেই মানসিক আঘাত, দুঃস্বপ্ন, অনিদ্রা বা ভয়–আতঙ্কের সমস্যায় ভুগছিল। তাদের মধ্যে কেউ সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ এড়িয়ে চলছে, কেউ বা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। এভাবে উদ্বেগ, ভয় আর মৃত্যুভীতি ছড়িয়ে পড়েছে ইসরায়েলি সেনাদের ভেতর।
মৃত্যু না হয় পঙ্গুত্ব
হিব্রু সংবাদমাধ্যম ওয়ালা–র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পুনর্বাসন বিভাগ ধারণা করছে, আগামী তিন বছরের মধ্যে প্রায় এক লাখ আহত সেনাকে সামলাতে হবে। বর্তমানে বিভাগের আওতায় আছে ৮১ হাজার ৭০০ জন, যারা আগের যুদ্ধ ও সামরিক অভিযানে আহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৩১ হাজার সেনা ভুগছে নানা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলমান গাজা যুদ্ধ এই সংখ্যাকে অভূতপূর্বভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত পুনর্বাসন বিভাগে ২০ হাজারের বেশি নতুন আহত সেনা যুক্ত হয়েছে। তাদের প্রায় অর্ধেক মানসিক সমস্যায় ভুগছে, যা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার ফল। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৮ সালের মধ্যে আহত সেনাদের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এতে শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক সামলানো সেনাবাহিনীর জন্য বড় চাপ হয়ে দাঁড়াবে।
হারেৎজ ও টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, সেনাবাহিনী সীমিত কিছু তথ্য দিয়ে শুধু বলছে—আত্মহত্যা ও পলায়নের ঘটনাগুলো নজরদারিতে আছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বা প্রেক্ষাপট প্রকাশ করছে না। এতে গণমাধ্যম প্রকৃত চিত্র জানাতে পারছে না, তৈরি হচ্ছে তথ্যের ফাঁক।
এ অবস্থায় সেনাদের মানসিক দুর্বলতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অনেক সাবেক সেনা বলেছেন, মানসিক সহায়তা চাইলে তারা শাস্তি বা সমালোচনার ভয় পান। যুদ্ধক্ষেত্রের তীব্র চাপ, দায়িত্বের ভার এবং ইউনিটের ভেতরে একাকিত্ব তাদের ভেতরে আত্মহত্যা বা পলায়নের প্রবণতা বাড়াচ্ছে।
ইসরায়েলি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক গবেষণাতেও বলা হয়েছে, সেনাদের মনোবল ধরে রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এ সংকট শুধু কোনো নির্দিষ্ট ইউনিটেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং নিয়মিত ও রিজার্ভ উভয় বাহিনীতেই ছড়িয়ে পড়েছে।
সূত্র: শিহাব নিউজ





