হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জুদ্দিন আল কাসসামের মুখপাত্র আবু উবায়দাকে হত্যার দাবি করেছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। এ ঘোষণার পর আরব বিশ্বের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনার ঝড়। রাজনীতি, শিক্ষাঙ্গন ও গণমাধ্যমের নানা মহল থেকে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে।
অনেকেই মনে করছেন, দখলদার বাহিনী কোনোভাবেই বিজয়ের গল্প দাঁড় করাতে পারছে না। তাই কাসসামের কণ্ঠস্বর আবু উবায়দাকে টার্গেট করেছে। আবু উবায়দা কেবল একজন মুখপাত্র নন, তিনি এক আদর্শ ও চেতনার প্রতীক। আর সেই চেতনাকে হত্যা করা সম্ভব নয়।’
আবু উবায়দাকে সালাম
ড. রামি আব্দু লিখেছেন, আবু উবায়দাকে টার্গেট করতে গিয়ে ইসরায়েল তাঁর পরিবার ও আত্মীয়দের ওপর চালিয়েছে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। শহীদ হয়েছেন প্রায় ৪০০ জন। তবু ফিলিস্তিনি জনগণ ও বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের চোখে তিনি কেবল একজন ব্যক্তি নন, বরং এমন এক আদর্শ ও পথের প্রতীক, যাকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়, যতদিন না অবসান ঘটছে দখল ও অবিচারের।
গবেষক সাঈদ জিয়াদ লিখেছেন, আবু উবায়দা জীবিত থাকুন কিংবা শহীদ হন—তাঁকে সালাম। সালাম সেই মানুষকে, যার আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন এ ভূমির শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা—বায়তুল মুকাদ্দাস ও আশপাশের অঞ্চল থেকে শুরু করে ইয়েমেনের মুক্তিকামী ভাইয়েরা, এমনকি দক্ষিণ লেবাননের যোদ্ধারাও।
তিনি আরও লিখেছেন, সালাম দাইফের বার্তাবাহক আবু উবায়দাকে। যিনি সত্যের কণ্ঠস্বর, সেই তরবারি—যা যখনই খোলা হয়েছে, আঘাত করেছে নিখুঁতভাবে। আর সালাম সেই শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে, যিনি তাঁর জনগণের হয়ে কথা বলেছেন ও তাঁদের দুঃখ–বেদনা নিজের কণ্ঠে বহন করেছেন।
‘ইয়াদ’ নামের একটি অ্যাকাউন্টে লেখা হয়, যদি আবু উবায়দা শহীদ হয়ে থাকেন, তবে সেটাই ছিল তাঁর বেছে নেওয়া পথ, সেটাই তাঁর লক্ষ্য। আল্লাহ যেন তাঁকে কবুল করেন। আর যদি তিনি এখনও জীবিত থাকেন, তবে আল্লাহ তাঁর পদক্ষেপ দৃঢ় করুন এবং তাঁকে দখলদার ও তাদের সহযোগীদের জন্য এক আতঙ্কে পরিণত করুন।
আহমাদ হিজাজি নামে একজন মন্তব্য করেছেন, আজ পুরো বিশ্ব একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে—আবু উবায়দা কি শহীদ হয়েছেন, নাকি এখনও জীবিত? তাঁর বক্তৃতাগুলো তিনি যখন আহ্বান জানাতেন, তখন অনেকে ততটা গুরুত্ব দিত না। অথচ শেষবার তিনি স্পষ্টই বলে গেছেন,‘আল্লাহর দরবারে তোমরাই আমাদের প্রতিপক্ষ।’
আমাদের জন্য লড়াই করে যাওয়া সেই মুখোশধারী
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এক পোস্টে লেখা হয়েছে, আবু উবায়দা শহীদ হয়েছেন কি না, তাঁর ছবি প্রকাশিত হয়েছে কি না, এসব কিছুই আসলে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি সেদিনই শহীদ হয়ে গেছেন, যেদিন নিজের পরিচয় আড়াল করে মুখোশধারী যোদ্ধা হিসেবে আমাদের জন্য লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর নাম কিংবা চেহারার কোনো আলাদা মূল্য নেই। তিনি সেই মুখোশধারী প্রতীক, যিনি সম্মান, ইতিহাস, গৌরব, মর্যাদা আর সংগ্রামকে একসঙ্গে ধারণ করেছেন।
কেন দখলদাররা বিভ্রান্ত হলো আবু উবায়দায়?
লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. ফায়েজ আবু শোমালা আল জাজিরাকে বলেন, আবু উবায়দার পরিচিতি এখন শুধু ফিলিস্তিন বা প্রতিরোধযুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তিনি হয়ে উঠেছেন আরব বিশ্বের, এমনকি আন্তর্জাতিক পরিসরেরও এক প্রভাবশালী চরিত্র। তাঁর উপস্থিতি রাজনৈতিক প্রবাহকেও প্রভাবিত করছে। ইসরায়েল দিনরাত তাঁকে ঘিরে নজরদারি চালাচ্ছে, এর অর্থ আসলে প্রতিরোধের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা।
লেখক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, দখলদার ইসরায়েল নিজেদের সাফল্য কেবল আবু উবায়দাকে টার্গেট করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করছে। অথচ তারা লেবানন, ইয়েমেন, ইরানসহ নানা জায়গায় যুদ্ধ চালাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আবু উবায়দা এখন ইসরায়েলি সমাজে মানসিক আতঙ্কের নাম। গণমাধ্যমে তাঁর প্রভাব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা বিশ্বদরবারে ফিলিস্তিন ও আরব ইস্যুকে আরও উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছে। ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন প্রতিরোধ আর ফিলিস্তিনি দৃঢ়তার এক অমলিন প্রতীক।
আবু উবায়দা ও ইজ্জুদ্দিন আল কাসসাম
ড. আবু শোমালা আবু উবায়দার উত্থান ও জনপ্রিয়তার তুলনা করেন শহীদ ইজ্জুদ্দিন আল কাসসামের সাথে। ১৯৩৫ সালে জেনিনে তাঁর উত্থান ঘটে। পরে তিনি ব্রিটিশ ও জায়নবাদী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে শহীদ হন। সে সময় ডেভিড বেন গুরিয়ন সব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ডেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘কীভাবে তোমরা এমন একটি ব্যক্তিত্বের উত্থান ঘটতে দিলে, যার চারপাশে আরব জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠছে?’
আবু শোমালার মতে, নেতানিয়াহু বিশ্বকে বোঝাতে চান যে তিনি হত্যাকাণ্ড, ধ্বংস আর অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। নেতৃত্বকে হত্যা করে তিনি অন্তত আংশিক বিজয় দেখাতে চাইছেন। তবে বাস্তবে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
গতকাল রোববার গাজা শহরে আবু উবায়দাকে লক্ষ্য করে অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাতজ দাবি করেছে, ওই অভিযানে তিনি নিহত হয়েছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি হামাস।
সূত্র: আল জাজিরা মুবাশির





