হিজরি ৭ম শতক। তাতারিরা একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে মুসলিম ভূখন্ডগুলোর উপর। একে একে দখল হয়ে গেছে মধ্য এশিয়ার গৌরবময় সব মুসলিম শহর—বুখারা, সমরকন্দ, নিশাপুর।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনুল আসির তার কালজয়ী ইতিহাসগ্রন্থ ‘আল-কামিল ফিত তারিখ’–এর ১২তম খণ্ডে সে সব ভয়াবহ সব উপ্যাখ্যানের বিবরণ দিয়েছেন। সে দৃশ্য কল্পনা করতেও ভয় লাগে, শিউরে ওঠে তনুমন। গণহত্যা থেকে শুরু হত, এরপর সে লাশগুলোকে বর্শার মাথায় গেঁথে শহরজুড়ে গেড়ে দেয়া হত সেগুলো। পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হত পুরো শহর। আলেমদের লাঞ্চনাকরভাবে মেরে ফেলা হত। নারী শিশুদের বরণ করতে হত নির্মম দাসত্ব। কিন্তু এই সময় বাগদাদের খলিফা মহোদয় কী করছিলেন?
লিটারেলি কিছুই না। উনি খলিফা মানুষ কী আর করবেন। তবু খলিফা যেহেতু, উনার মনও তো ভারাক্রান্ত হত, তাই উনি তখন বলতেন— ندعو لهم بالنصر، ونحتسب أمرهم عند الله আমরা তাদের জন্য খুব করে দোয়া করবো, আর তাদের এ মসিবত আমরা আল্লাহর সমীপে সমর্পণ করছি!
তিনি শেষতক দোয়া জারি রেখেছেন আর ওদিকে তাতাররা ভূখণ্ডগুলো রুটির মত টুকরো টুকরো করে ফেলছিল; খলিফা দোয়ায় মগ্ন। আর সারাদিন যখন দোয়া করতে করতে ক্লান্ত, তখন রাতে তার দরবারে বসত সুরা আর সাকির মজমা। সাকিতে মাতাল হয়ে নর্তকির সুর লহরিতে রাত পার হয়ে যেত খলিফা মহোদয়ের।
এরপর একদিন এলো, তাতাররা সেদিন হাজির হলো খিলাফতের রাজধানী বাগদাদের উপকন্ঠে। তখন হিজরি ৬৫৬ সাল। হালাকু খান তার সর্বশক্তি নিয়ে হামলে পড়লো খিলাফতের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদে। এমন নির্মম গণহত্যা চালালো সেদিন, ইসলামি ইতিহাসে যার নজির খুঁজে পাওয়া ভার। ১০ লক্ষের বেশি মুসলমানকে সেবার হত্যা করা হলো। হত্যা করা হলো খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহকেও। তার সামনেই তার প্রিয়তমা স্ত্রীদের দাসি বানিয়ে নিয়ে গেল বর্বর তাতার সেনারা। অপমান আর লজ্জায় তখন কি খলিফার এমনিও মরে যাওয়ার কথা ছিল না? খুব করে তখন আফসোস করছিলেন যে কেন যুদ্ধ করলেন না, কেন প্রস্তুতি নিলেন না!
তার পূর্বসূরিরাও কিন্তু এমন ভুল করে গিয়েছিলেন। তবু শিক্ষা নিতে পারেননি তিনি। তখন ৪৯২ হিজরি। ক্রুসেডাররা আলকুদস দখল করে নিল। এমন নারকীয় গণহত্যা চালালো সেখানে; ক্রুসেডিয় ইতিহাসবিদ রেমন্ড ড’আগুইলের ভাষ্য অনুযায়ী—‘আল-আকসা মসজিদের ভেতরে ঘোড়ার হাঁটু পর্যন্ত রক্ত জমে গিয়েছিল!’
চলেন, আবার একটু উঁকি দেই তৎকালীন আব্বাসি খলিফার দরবারে। দেখা যাচ্ছে, শামের প্রধান মুফতি সাহেব বাগদাদে এসেছেন; খলিফার কাছে সামরিক সাহায্য চাইতে। খলিফা লোকজন জড়ো করলেন এবং বড় ব্যথাতুর চেহারায় বললেন—‘কাঁদো জনগণ কাঁদো, আল কুদসের জন্য কাঁদো!’ তিনি অস্ত্র হিসেবে দিলেন কেবল তার জনগণের একবুক শোক আর এক লহমা কান্না।
আর আল কুদস? হ্যাঁ, এরপর কান্না চলতেই থাকলো দীর্ঘ প্রায় শতাব্দী কাল। ৯১ বছর পর, একদিন এক সত্যিকার পুরুষ এলেন। কুফফাররা তার চোখের পানির ব্যাপারে তেমন কিছুই শুনলো না। শুনলো কেবল তার উন্মুক্ত তরবারির বিপ্লবী নাগমা। তিনি শতাব্দীকালব্যাপী ঘুমিয়ে থাকা একটা জাতিকে জাগিয়ে তুললেন, খণ্ড বিখণ্ড উম্মাহকে একত্র করলেন। এইসব অথর্ব কান্না বন্ধ করতে বললেন। বললেন, কুদসের মুক্তির একটাই পথ—‘দিনের অশ্বারোহণ, রাতের ক্রন্দন; রুহবানুল লাইল, ওয়া ফুরসানুন নাহার!’ চোখের পানি দেখবেন কেবল আরশের মালিক। কাফেররা তা জানবেও না, জালেম কাফেররা দেখবে কেবল তরবারির নির্মম আঘাত। এরপরই ফিরে এলো আলকুদস; জুলুম আর কুফরের আধার ছিন্ন করে তাওহিদের ঝান্ডাবাহিদের হাতে।
এরপর অনেক অনেক বছর কেটে গেল। আমরা আবারো ভুলে গেলাম ইতিহাসের সবক। আজকের দিনে গাজা আমাদের চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে; যেভাবে একসময় তছনছ হয়ে গিয়েছিল বুখারা। শিশুরা অনাহারে মারা যাচ্ছে, পিতারা চাপা পড়ে দাফন হচ্ছেন ধ্বংসস্তূপের নিচে, শীর্ণকায় দেহগুলো দুর্বল হয়ে আল্লাহ শব্দটাও উচ্চারণ করতে পারছে না, জীবিতরা এমন অবরোধ আর নির্মমতায় আছেন যেন এখানে শাহাদাতই হয়ে উঠেছে প্রবল কাম্য।
আর এর ইকটু পাশেই? নিজেদের মুক্ত ভাবা রাষ্ট্রগুলোতে চলছে কনসার্ট, নাচ গান। টেবিলে টেবিলে থরে থরে সাজানো ড্রিংক। অঢেল খাদ্যসম্ভার, যার অনেকটারই জায়গা হবে ডাস্টবিনে, কুকুরের উচ্ছিষ্টে। আর তার পাশেই খাবারের অভাবে মানুষেরা খাদ্য খুঁজছে ডাস্টবিনে, রাস্তায়। পাশের ‘মুক্ত মানুষগুলো’ কাটাচ্ছে এমন এক জীবন, যেন অভুক্তদের হাহাকার বা দুনিয়া কাঁপানো বোম্বিংয়ের আকাশ ফাটিয়ে তোলা প্রতিধ্বনি তারা শুনতেই পায় না।
কী অদ্ভুত; এরা নিজেদের নিরাপদ ভাবে! অথচ ২০২৩ সালে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী স্মোটরিচ সারা দুনিয়ার সামনে বলেছেন—‘বৃহত্তর ইসরায়েলের মানচিত্রে’ জর্ডান, সিরিয়া ও লেবানের অংশ রয়েছে।’
ওরা তো ১৮৯৭ সালের বেজেল সম্মেলনেই ‘নীল থেকে ফোরাত’ অব্দি নিজেদের রাষ্ট্রের সীমানা টেনেছে। পাঁচ দশকও পেরোয়নি, ওরা নির্মমভাবে দখল করে নিয়েছে জেরুজালেম। কীভাবে মুসলিম বিশ্ব নিশ্চিন্তে বসে থাকে যে, তারা নিরাপদ! কীভাবে তারা জানতে পারলো যে, ইসরায়েল তাদের স্বপ্ন ত্যাগ করেছে?
এখনো এই স্বপ্নের বাস্তবায়নেই ইসরায়েল প্রতিটা স্টেপ নেয়, প্রতিটা কৌশল সাজায়, মানচিত্র আঁকে। ইসরায়েলের সামনে সবচে বড় বাধা হিসেবে কেবল দাঁড়িয়ে আছে—ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধই সেই বৃহত্তর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে একমাত্র দুর্ভেদ্য দেয়াল। গাজা আজ কেবল ছোট্ট এ ভূখণ্ডের জন্য লড়ছে না, লড়ছে পুরো উম্মাহর জন্য। গাজার পতন হলে আস্তে আস্তে আক্রান্ত হবে প্রতিটা মুসলিম ভূখণ্ড। একে একে পালা আসবে—‘ওমান, দামেস্ক, বৈরুত’, যেভাবে পতন ঘটেছিল বুখারা, সমরকন্দ, নিশাপুরের। এ যুদ্ধে জড়াতে হবে প্রত্যেককে। হয় ডিফেন্সে, নয় অফেন্সে। হয় আত্মমর্যাদার লড়াই করবে নয় লাঞ্চনার মৃত্যুকে বেছে নেবে। যারা এখনো ভাবছে, আগুন যেহেতু দূরে, তাদের কাপড় তা স্পর্শ করবে না, অচিরেই তাদের এই ভ্রম খুব নির্মমভাবে ভঙ্গ হবে। যারা মনে করে, তারা এই জম্বি থেকে বাঁচতে পারবে, তাদের সাথে বাগড়া না দিয়ে নাচ-গান, শরাব আর ভোজে মেতে থাকলেই তারা তাদের কিচ্ছু করবে না, তারা যেন ইয়াদ করে—আব্বাসীদের হত্যা করা হয়েছিল শরাবের মজলিসেই। যারা ভাবে দোয়া করে আজাদ করে ফেলবে আল কুদস, ভাবে দোয়ার মাধ্যমে মুছে ফেলবে নিজের দায়িত্ব না আদায়ের অক্ষম্য কলঙ্কের দাগ, তারা ইয়াদ করুক—জেরুজালেম দখল হয়েছিল, কারণ বাগদাদ তার জন্য কোন সেনা পাঠায়নি, কেবল পাঠিয়েছিল কয়েক ফোটা অশ্রু। ইতিহাস বারবার ফিরে আসে, ইতিহাস বারবার ফিরে আসে…





