কাশ্মীর নিয়ে ভিন্নমত ও বিকল্প ইতিহাসকে দমন করতে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে মোদি সরকার। এ ধারাবাহিকতায় কাশ্মীর বিষয়ে লেখা অন্তত ২৫টি বই নিষিদ্ধ করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। অরুন্ধতী রায়, ক্রিস্টোফার স্নেডডেন, এ জি নূরানি, ভিক্টোরিয়া স্কোফিল্ড, হাফসা কানজওয়ালসহ বহু ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক লেখকের লেখা এই বইগুলোকে ‘সন্ত্রাসবাদে উস্কানিদাতা’ ও ‘ভারতের অখণ্ডতা বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারত দখলকৃত কাশ্মীরের তথ্যনিয়ন্ত্রণ ও ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীরের স্বরাষ্ট্র দপ্তর বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এই বইগুলোতে ‘ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিকর বর্ণনা’ রয়েছে, যা বিচ্ছিন্নতাবাদকে উৎসাহিত করে।
নিষিদ্ধ বইগুলোর মধ্যে রয়েছে অরুন্ধতী রায়ের আজাদি, এ জি নূরানির দ্য কাশ্মীর ডিসপিউট ১৯৪৭–২০১২, ভিক্টোরিয়া স্কোফিল্ডের কাশ্মীর ইন কনফ্লিক্ট, এবং ক্রিস্টোফার স্নেডডেনের ইনডিপেনডেন্ট কাশ্মীর। তালিকায় আরও আছেন সুমন্ত্র বোস, অনুরাধা ভাসিন, পঙ্কজ মিশ্র, আথার জিয়া, হাফসা কানজওয়ালসহ আরও বেশ কয়েকজন গবেষক ও লেখক।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব বইতে ‘অভিযোগ ও বঞ্চনার সংস্কৃতি’ চর্চা করা হয়েছে, এবং ‘সন্ত্রাসীদের নায়ক’ হিসেবে উপস্থাপন করে সেনাবাহিনীকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। এসব কাজের ফলে ‘চরমপন্থা উসকে উঠতে পারে’ বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তারা।
বই বাজেয়াপ্তের আদেশে বলা হয়েছে, নতুন নাগরিক নিরাপত্তা আইন ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা ২০২৩-এর ৯৮ তম ধারা অনুযায়ী বই, পাণ্ডুলিপি ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জব্দ করা হবে।
‘এই সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়’
যুক্তরাষ্ট্রের লাফায়েত কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাফসা কানজওয়াল TRT World-কে বলেন, ‘কাশ্মীর নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এমন কারও কাছে এই তালিকা অবাক করার মতো কিছু নয়। ভারতের প্রায় আট দশকের দখলদারিত্বে কাশ্মীর সম্পর্কে তথ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে আসছে।’
তাঁর লেখা Colonizing Kashmir: State-building Under Indian Occupation বইটিও এই নিষিদ্ধ তালিকায় রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই নিষেধাজ্ঞা আসলে বহু বছরের ইন্টারনেট বন্ধ, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, সংবাদমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণেরই অংশ। এটি কাশ্মীর নিয়ে ভারতের নিরাপত্তাহীন মানসিকতারই প্রতিফলন।’
‘চ্যালেঞ্জ দিই, একটি লাইন দেখাক’
অনুরাধা ভাসিনের বই A Dismantled State: The Untold Story of Kashmir After Article 370–ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি এই নিষেধাজ্ঞাকে ‘বিকৃত মানসিকতার পরিচয়’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘এই বইগুলো গবেষণাভিত্তিক। কোথাও সন্ত্রাসবাদের গৌরবগাথা নেই। যারা বই নিষিদ্ধ করেছে, আমি তাদের চ্যালেঞ্জ জানাই—একটি শব্দ দেখাক, যেখানে সন্ত্রাসবাদকে আদর্শ বলা হয়েছে।’
বিকল্প ইতিহাস নির্মূলে ধারাবাহিক অভিযান
এর আগে ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মীরের শ্রীনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ জামাতে ইসলামী প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর লেখা প্রায় ৭০০ বই জব্দ করেছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও ইতিহাসভিত্তিক বিকল্প বয়ান নির্মূল করতেই এভাবে বই নিষিদ্ধ ও জব্দের পন্থা নিয়েছে ভারত।
ভারত ও পাকিস্তান—উভয় দেশই কাশ্মীরকে নিজেদের ভূখণ্ড দাবি করে। ১৯৮৯ সালে ভারত দখলকৃত কাশ্মীরে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়। অধিকাংশ মুসলিম বাসিন্দা স্বাধীনতা কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পক্ষে।
দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দীর্ঘদিনের। জাতিসংঘ কাশ্মীর ইস্যুতে একাধিকবার গণভোটের প্রস্তাব দিলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক ও প্রতিরোধ যোদ্ধা নিহত হয়েছেন।
সূত্র: TRT World





