প্রতিদিন ভোরে নতুন এক সংগ্রামের গল্প শুরু হয় ছয় সন্তানের বাবা আহমাদ নওফালের। গাজার নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরের পাশে, নেটসারিম করিডরের লাগোয়া মুফতি এলাকায়, ১৪ বছর বয়সী ছেলে মুহাম্মদকে নিয়ে ঘর ছাড়েন ফিলিস্তিনি এই বাবা। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় খাদ্যের সংকট চরমে। সেই দুরবস্থার মধ্যেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে কাঠ আর লোহা কুড়িয়ে বাজারে বিক্রি করেন আহমাদ, যেন পরিবারের ছয় সদস্যের মুখে অন্তত একবেলার খাবার তুলে দিতে পারেন।
যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে আহমাদের চেহারায়ও। এক সময় যিনি ছিলেন সুদর্শন, আজ তিনি ক্লান্ত, ভগ্নচেহারা। কণ্ঠে বিষণ্নতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন আমি আর মুহাম্মদ ঠেলাগাড়ি নিয়ে রওনা দিই। পেটে ভাত নেই, মাথার ওপর রোদের তাপ। অনেক দূর পথ পেরিয়ে পৌঁছাই নেটসারিম এলাকার কাছাকাছি, যেখানে চারদিকে শুধু আতঙ্ক।’

আহমাদ বলেন, ‘আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় যুদ্ধবিমান, সামনে থাকে ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক। ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি থেকে সংগ্রহ করি কাঠ আর লোহার টুকরো। অনেক কষ্টে সেগুলো ঠেলাগাড়িতে তোলে, তারপর বাজারে নিয়ে বিক্রি করি। যা পাই, তা দিয়েই চাল-আটা কিনে কোনো রকমে সংসার চালাই।’
বোমার ছায়ায় বেঁচে থাকা
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে একদিনের জন্যও স্বস্তি মেলেনি আহমেদ নওফাল ও তাঁর ছেলে মুহাম্মদের। প্রতিদিনই একই চিত্র—অত্যন্ত ক্লান্তিকর পথচলা, ক্ষুধার যন্ত্রণা, বেঁচে থাকার সংগ্রাম। গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাস্তবতায় জীবিকার তাগিদে বের হতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই। চারদিকে অস্থিরতা, আকাশছোঁয়া মূল্য, আর নিত্যপণ্যের অভাব। এখন কাঠ আর লোহা কুড়িয়ে বাজারে বিক্রি করাই এখন তাদের একমাত্র অবলম্বন।
তবে কাজটা মোটেই সহজ নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটতে হয়, খুঁজতে হয় নতুন এলাকা, পেরোতে হয় ধ্বংসস্তূপ, আর প্রতিনিয়তই মুখোমুখি হতে হয় বিপদের। আহমাদ ও মুহাম্মদ একাধিকবার ট্যাঙ্ক থেকে ছোড়া গোলার সামনে পড়েছেন। ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ড্রোন থেকে গুলিও ছোড়া হয়েছে তাঁদের দিকে। বেশ কয়েকবার অল্পের জন্য বেঁচে ফিরেছেন তাঁরা।
আহমাদ বলেন, ‘প্রতিদিনই মনে হয়, হয়তো এটাই আমাদের জীবনের শেষ দিন। হয়তো একদিন কারো কাঁধে করে ফেরত আসব, কিংবা সাদা কাফনে মোড়ানো অবস্থায়। কিন্তু এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। দরিদ্রতা আর না খেয়ে মরার ভয় আমাদের রোজ রাস্তায় নামিয়ে আনে।’

একদিন কাঠ-লোহা খুঁজতে গিয়ে আহমেদ ও তাঁর ছেলে ঢুকে পড়েন এক অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়—আশা ছিল, সেদিন বেশি কিছু জোগাড় হবে। আহমাদ বলেন, ‘একপর্যায়ে চারদিক থেকে আমাদের দিকে গুলি ছুটে আসেতে থাকে। কোনও মতে প্রাণ নিয়ে ফিরি। কিন্তু খালি হাতে। কিছুই জোগাড় করতে পারিনি, আটা কেনা তো দূরের কথা, একবেলার খাবারও জোটেনি।’
গাজায় ত্রাণ কার্যক্রমও মুখ থুবড়ে পড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতির পর আবার নতুন করে সংঘাত শুরু হলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ত্রাণ সহায়তা। ইসরায়েল তীব্র করে অবরোধ, শুরু করে পরিকল্পিতভাবে খাবারের অভাবে ফেলে শাস্তির কৌশল। বন্ধ হয়ে যায় রেশন, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র, লোকজনের জন্য চালু থাকা রান্নাঘরগুলো। লুটের শিকার হয় ত্রাণবাহী ট্রাক। আর কালোবাজারে এক মুঠো চাল বা আটার দাম আকাশছোঁয়া। সাধারণ মানুষের জন্য খাবার জোগাড় করাই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে কঠিন কাজ।
আহমাদ নিজেও যুদ্ধাহত। ২০০০ সালে আল-আকসা ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত হন। সে সময় থেকে সামান্য সরকারি ভাতা পেতেন, কিন্তু এখন সেটাও বন্ধ। ইসরায়েলি সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘সন্ত্রাসে জড়িত’ বন্দি ও আহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অভিযোগে ফিলিস্তিন সরকারের রাজস্ব থেকে অর্থ কেটে রাখে ইসরায়েল। তার পর থেকেই বন্ধ আহমাদের একমাত্র আয়ের উৎস।
গাজায় বেঁচে থাকার লড়াই, জীবন এখন এক দূরের স্বপ্ন
আহমদের কণ্ঠে বিষণ্নতা, গাজায় এখন কোনো চাকরি নেই, বেতনও নেই। যুদ্ধের কারণে কাজ-কর্ম বন্ধ। এর মধ্যে চাল-ডালের দাম বেড়েই চলেছে, বাজারে হাহাকার। আমার ছোট ছোট বাচ্চারা প্রতিদিনই আমাকে জিজ্ঞেস করে—‘বাবা, আজকে কী খাব? কখন খাব? কিভাবে খাব?’
এই প্রশ্নগুলোর সামনে অসহায় বোধ করেন তিনি। বলেন, ‘ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারি না। নিজেকে অপরাধী মনে হয়—যেন এমন এক অপরাধের বোঝা বইছি, যা করিনি। গাজায় এখন বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটা জিনিস—আটা, রুটি, পানি, ওষুধ—পেতে যুদ্ধ করতে হয়।’
আহমাদ বলেন, ‘চারপাশে মৃত্যু আর ধ্বংস। প্রতিটি পণ্যের আকাশচুম্বী মূল্য আমাদের জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ক্ষুধা আমাদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে। গাজায় এখন স্বাভাবিক জীবন প্রত্যাশা এক বিলাসী স্বপ্ন—যেখানে প্রতিদিনের বাস্তবতা কেবল অবরোধ, বোমা আর লাশ।’

নেটসারিম করিডরের আশপাশের এলাকা—আবু মাদিন, জাহরা ও মাগরাকা—একসময় ছিল গাজার উর্বর কৃষিজমি। কিন্তু করিডর সম্প্রসারণের সময় দখলদার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ওইসব জমি বুলডোজার দিয়ে চষে দিয়েছে, গাছপালা উপড়ে ফেলেছে, ভেঙে দিয়েছে বাড়িঘর। এখন এলাকাগুলোকে ‘সেনা নিরাপত্তা অঞ্চল’ ঘোষণা করে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে তারা। সার্বক্ষণিক নজরদারিতে আছে ড্রোন, ট্যাংক আর স্নাইপার বাহিনী।
তবে আহমাদের চোখে এই এলাকা এখন রুটিরুজির আশ্রয়। জমি চষে ফেলার পর পড়ে থাকা বড় বড় গাছের শিকড় আর ভাঙা গ্রিনহাউসের লোহার টুকরো কুড়াতে তিনি প্রতিদিনই ছেলেকে নিয়ে সেখানে ঢুকে পড়েন। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কাঠ ও লোহা সংগ্রহ করেন। কাঠ কেটে গুছিয়ে প্রাচীন পদ্ধতিতে তা বহন করেন। এর কিছু বিক্রি করে আনেন কিছুটা আটা কিংবা খাবার, বাকি কাঠ রাখেন চুলা ধরাতে—যাতে অন্তত একবেলা রান্না করা যায়।
গাজায় এখন রান্নার গ্যাস প্রায় নেই বললেই চলে। তাই হাজার হাজার মানুষ গ্যাসের বদলে কাঠেই ভরসা করছেন। এতে কাঠের চাহিদা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এক কেজি কাঠের দাম এখন প্রায় দুই ডলার, যা আগে ছিল মাত্র ২৫ সেন্ট।
কাঁধে জীবনের ভার, শৈশব হারানো মুহাম্মদ
যুদ্ধের কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে ছোট মুহাম্মদের। স্কুলব্যাগ ফেলে এখন বাবার সঙ্গে কঠিন শ্রমে দিন কাটে তার। আল জাজিরাকে সে বলে, ‘আমি চাই অন্যসব শিশুর মতো বাঁচতে—স্কুলে যেতে, নতুন জামা পরতে, প্রিয় কার্টুন দেখতে, নিজের ঘরে শান্তিতে থাকতে, মায়ের পাশে ঘুমাতে, আর যখন খুশি তখন খাবার খেতে।’
তার কণ্ঠে ক্ষোভ আর হাহাকার, ‘কিন্তু যুদ্ধ আমাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। ইসরায়েল—আল্লাহ যেন তাদের বিচার করেন—আমাদের জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে।’
মুহাম্মদের দিন এখন কেবলই দুঃস্বপ্ন—মৃত্যুর ভয়, ক্লান্তি আর ক্ষুধার সঙ্গে প্রতিদিনের লড়াই। সে বলে, ‘এখানে একটু খাবার জোগাড় করতে গেলেও মনে হয় শতবার মরতে হয়। তাও পেট ভরে না। শরীরটা টেনে নিয়ে কোনোরকমে বাঁচার চেষ্টা করি, যেন জীবন মানে শুধু বেঁচে থাকা।’

মুহাম্মদ বলে, তাদের প্রতিদিনের খাবার আসলে ‘খাবার’ বলার মতোও নয়। বেশির ভাগ সময়ই শুধু শুকনো রুটির কয়েক টুকরো থাকে প্লেটে। আর ভাগ্য ভালো হলে কোনোদিন জোটে এক বাটি ডাল।
সে জানায়, ‘স্কুলে যাওয়ার বদলে এখন বাবার সঙ্গে কষ্টের কাজ করি। আমরা মাটি খুঁড়ে পড়ে থাকা কাঠ আর লোহা কুড়িয়ে আনি। আমি বাবাকে ঠেলাগাড়ি টানতে সাহায্য করি। পরে সেটা নিয়ে বাজারে যাই, সেখানে ঘণ্টার পর ঘন্টা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে সেগুলো বিক্রি করি।’
আহমাদ শেষ করলেন এই কথায়, ‘যা পাই, তাই কিনে খাই। খাওয়া শেষ হলে শরীর একেবারে হাঁপিয়ে যায়, কাপড় থাকে ময়লা, গায়ে রোদের উত্তাপে জ্বালা ধরে যায়। এত কষ্টের পরও পানি পাই না গোসলের জন্য, কাপড় ধোয়ারও সুযোগ নেই। এই অবস্থাতেই ঘুমাতে হয়।’
গাজার নওফাল ও তাঁর ছেলে মোহাম্মদের গল্প কেবল একটি পরিবারের নয়—এটা একটি জাতির টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। যেখানে প্রতিদিন শুরু হয় অনিশ্চয়তা দিয়ে, আর শেষ হয় ক্ষুধা, ক্লান্তি আর মৃত্যুভয়ে। যুদ্ধ শুধু ভবন গুঁড়িয়ে দেয় না, গুঁড়িয়ে দেয় স্বপ্ন, শৈশব, ভবিষ্যৎ।
মুহাম্মদের মতো হাজারো শিশু আজ স্কুলের বদলে ঠেলাগাড়ি টানে, খেলাধুলার বদলে কুড়িয়ে আনে কাঠ-লোহার টুকরো। বাবা-মায়েরা খাবারের জন্য প্রাণ বাজি রাখে। দিন শেষে অনেকেরই আর ঘরে ফেরা হয় না।
গাজা এখন আর কেবল একটি ভূখণ্ড নয়, এটা বেঁচে থাকার প্রতিদিনের লড়াইয়ের নাম। আর এই লড়াইয়ে প্রতিটি রুটির টুকরো, প্রতিটি গ্লাস পানি, প্রতিটি শিশুর হাসি—সবকিছুই যেন হারিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের অতল গহ্বরে, আর দুর্ভোগের রেখা প্রতিদিন হয়ে উঠছে আরও গাঢ়।
সূত্র: আল জাজিরা