আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া। কিছুদিন আগে এই সংবাদে হইচই পড়ে গিয়েছিল বিশ্ব রাজনীতিতে। অবশ্য, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে রাশিয়া কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও আইনি নানা প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। রুশ পর্যবেক্ষকদের মতে, এই স্বীকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন, যার তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে গোটা অঞ্চলেই।
আসলে রাশিয়া তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পরই কার্যত স্বীকৃতি দিয়ে দেয়। তাই বলা যায়, এখন যে পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছে, তা মূলত একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া—বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার জন্য।
রুশ পর্যবেক্ষকদের ধারণা, রাশিয়ার এই পদক্ষেপ অন্য দেশগুলোর অবস্থানেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। কারণ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি অংশ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দিকে ঝুঁকছে।
রাশিয়া কেন স্বীকৃতি দিল
এই স্বীকৃতির মাধ্যমে রাশিয়া তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিযোগিতায় বিশ্বের প্রথম দেশ হয়ে উঠল। প্রায় চার বছর আগে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে আন্তর্জাতিকভাবে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ছিল তালেবান সরকার। যদিও চীন ও ভারতের মতো দেশের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা ও কূটনৈতিক আলোচনা ক্রমেই বাড়ছিল।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় মস্কো তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে একাধিক কারণে, যার মধ্যে রয়েছে—
• কাবুলের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের সঙ্গে রাশিয়ার কোনো বিরোধ না থাকা।
• মধ্য এশিয়ায় স্থিতিশীলতা রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
• আফগানিস্তান মস্কোর জন্য নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী সহায়তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ আঞ্চলিক সহযোগী হতে পারে।
• বাণিজ্য, অর্থনীতি ও লজিস্টিক্স দৃষ্টিকোণ থেকে আফগানিস্তানের গুরুত্ব
উল্লেখ্য, ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ থেকে আফগানিস্তানের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রেও রাশিয়া প্রথম দেশ ছিল।
মধ্য এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রমজান নুরতাজিন মনে করেন, আফগানিস্তানে তালেবান শাসনব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া রাশিয়ার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মধ্য এশিয়া বর্তমানে সন্ত্রাস, উগ্রবাদ, অপরাধচক্রের বিস্তার এবং মাদক পাচারের মতো হুমকির মুখে রয়েছে।

আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশেষজ্ঞ রমজান নুরতাজিন বলেন, আফগানিস্তান বহু বছর ধরে এসব অপরাধের উৎস ছিল। তাঁর মতে, তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া রাশিয়ার জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে কাবুলের সঙ্গে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং রাশিয়ার দক্ষিণ সীমান্তে নিরাপত্তা বলয় আরও জোরদার হবে। বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন আফগানিস্তানে কার্যকর কোনো বিরোধী শক্তি না থাকায় তালেবান সরকারের ক্ষমতা টিকে থাকার সক্ষমতা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
নুরতাজিনের মতে, এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো—নতুন আফগানিস্তানের সঙ্গে সহাবস্থানের কার্যকর পন্থা খুঁজে বের করা। আফগান ভূখণ্ড ভারতের মতো দেশের সঙ্গে লজিস্টিক সংযোগ বিস্তারের সম্ভাবনাময় একটি পথ, যা ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সঙ্গেও যোগাযোগের নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। তাঁর ভাষ্য, কাবুলের উন্নয়নের জন্য এখন প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক অংশীদার প্রয়োজন। তাই আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে খনিজ সম্পদ ও অবকাঠামো খাতে রাশিয়ান কোম্পানিগুলোর বড় ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিজয়
বিশেষজ্ঞ নুরতাজিনের মতে, রাশিয়ার এই স্বীকৃতি তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রনীতির জন্য এক ধরনের সাফল্যও বটে। গত চার বছর ধরে তালেবান যেভাবে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে এবং বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার পথ তৈরি করতে চেয়েছে—এই স্বীকৃতি সেই চেষ্টারই ইতিবাচক ফল।
এছাড়াও, রাশিয়ার এই পদক্ষেপ মধ্য এশিয়ার আফগানিস্তানসংলগ্ন মিত্র দেশগুলোকে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তাজিকিস্তানের কথা—যাদের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ। কারণ, দুশানবে আফগানিস্তানের উত্তরে অবস্থানরত তালেবানবিরোধী তাজিক নেতাদের সমর্থন দিয়ে আসছে।
এই প্রেক্ষাপটে মস্কো ও কাবুলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সহায়তা করতে পারে। পাশাপাশি, দীর্ঘমেয়াদে এটি তালেবানের অন্যান্য দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
অন্যদিকে, ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড রিজিওনাল স্টাডিজের (আইএসআরএস) পরিচালক সাইফউদ্দিন তুরসুনভের মতে, মস্কো যে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বড় কোনো পরিবর্তন আনবে না। কারণ, এই সিদ্ধান্ত মূলত বিদ্যমান সম্পর্ককে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে, নতুন করে তা জোরদার করার জন্য নয়।
আশংকা
আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড রিজিওনাল স্টাডিজের পরিচালক সাইফউদ্দিন তুরসুনভ বলেন, আফগানিস্তানের পুরো ভূখণ্ডে তালেবান এখনো পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কারণ, দেশটিতে এখনও বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের তৎপরতাও অব্যাহত রয়েছে। তাঁর মতে, এমন বাস্তবতায় তালেবান সরকারকে আঞ্চলিক সহযোগিতার বলয়ে যুক্ত করা সময়ের আগেই নেওয়া সিদ্ধান্ত, যা রাশিয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
তুরসুনভের মতে, রাশিয়ার মতো একটি প্রভাবশালী বিশ্বশক্তি যদি তালেবানকে আফগানিস্তানের সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে তা আন্তর্জাতিক আইনভিত্তিক বৈধতা- ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাঁর মতে, আফগানিস্তানের সঙ্গে যেকোনো ধরনের যোগাযোগের আগে দেশটির চরম অস্থিরতা এবং তালেবানের সঙ্গে দেশীয় ‘বিদ্রোহী’ গোষ্ঠীগুলোর চলমান সংঘাতের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।

তুরসুনভ বলেন, বর্তমান সময়ে আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে রাশিয়া ও তালেবানের মধ্যে কূটনৈতিক সহযোগিতার সম্ভাবনা সীমিত। আফগানিস্তান মূলত চীনের প্রভাব-বলয়ের অংশ, এছাড়া দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক বিচ্ছিন্নতার সম্মুখীন। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে মস্কোর সঙ্গে বিস্তৃত সহযোগিতার সুযোগ নেই আফগানিস্তানের।
তুরসুনভ শেষে বলেন, এগুলো বিবেচনায় নিয়ে রাশিয়ার তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়া কোনো নতুন সম্পর্কের সূচনা হিসেবে দেখা উচিত নয়। বরং এটি আঞ্চলিক সম্পর্ক স্থিতিশীল করা ও উত্তেজনা কমানোর একটি প্রচেষ্টা মাত্র। কারণ, প্রতিকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের সঙ্গে স্থায়ী যোগাযোগ রাশিয়ার জন্য আবশ্যক, যাতে আঞ্চলিক নিরাপত্তায় সম্ভাব্য ঝুঁকি ও হুমকি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
সূত্র : আল জাজিরা