মাহমুদ আব্বাসের ছয়টি নিরাপত্তা সংস্থা রয়েছে, যা মূলত অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের নির্দিষ্ট অঞ্চলে কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের উপর দমন-নিপীড়নের ক্ষেত্রে দখলদার বাহিনীর ভূমিকা পালন করে। এই ছয়টি সংস্থা হলো—সাধারণ গোয়েন্দা সংস্থা, প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা সংস্থা, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, বেসামরিক পুলিশ, জাতীয় নিরাপত্তা এবং প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংস্থা। এসব সংস্থার জন্য এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে, যা শিক্ষা ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত বাজেটের সমান।
বিশ্বজুড়ে মানুষ এই সংস্থাগুলোর সংখ্যা এবং গঠন দেখে বিস্মিত হতে পারে। দখলদারিত্বের অধীনে ভুক্তভোগী জনগণের জন্য বিশেষভাবে তৈরি এই সংস্থাগুলো তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরিবর্তে ইজরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষার কাজ করে থাকে। প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের জীবনে হস্তক্ষেপকারী এমন সংস্থা পৃথিবীর আর কোথাও নেই—এমনকি সবচেয়ে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায়ও নেই। সেখানে বিশেষায়িত সংস্থা থাকতে পারে, কিন্তু তারা নাগরিকদের জীবনে এতটা হস্তক্ষেপ করে না।
অসলো চুক্তির অধীনে এই সংস্থাগুলো অধিকৃত ফিলিস্তিন ভুখন্ডে প্রবেশ করে এবং ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তারা সেখানে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে নিজেদের দায়িত্ব (দখলদার বাহিনীর পক্ষে কাজ) পালন করেছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো ইজরায়েলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ বা অসলো চুক্তির বিরুদ্ধে যায় এমন যেকোনো পদক্ষেপ দমন করা। ইজরায়েলের রাজনৈতিক জীবন যখন ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং চুক্তি লঙ্ঘন ও বিরোধিতার ঘটনা বেড়ে যায় তখন থেকেই এই দখলদার বাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীদের ফিলিস্তিনিদের হত্যা, গ্রেফতার এবং নিজেদের বসতি সম্প্রসারণের জন্য অবারিত স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সংস্থাগুলো দখলদার বাহিনীর সাথে ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী, শ্রমিক, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকসহ সাধারণ নাগরিকদের গ্রেফতার করে আসছে—তাদের করা কোনো অপরাধের জন্য নয়, বরং তাদের দখলদারিত্ববিরোধী কার্যকলাপ এবং অসলো চুক্তির বিরোধিতার জন্য। যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার, বিশেষত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে খর্ব করে।
এই সংস্থাগুলোকে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় হস্তক্ষেপ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তারা রাতের বেলায় ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে যাকে খুশি গ্রেফতার করে, তাদের উপর হামলা চালায় এবং তাদের সম্পদ ধ্বংস করে—ঠিক যেমনটা করে দখলদাররা। একইভাবে দিনেও তারা রাস্তা, কর্মস্থল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুলগুলোতে হানা দেয় এবং সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার ও গুলি করে। দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রতিবাদ প্রতিহত করতে তারা প্রতিনিয়ত তৎপর।
বহু বছর ধরে আমি আইন বিশেষজ্ঞ এবং মাঠ পর্যায়ের গবেষণা দলের সাথে কাজ করে এই সংস্থাগুলোর অপরাধ পর্যবেক্ষণ এবং নথিভুক্ত করেছি। এই গবেষণার ফলাফল ভয়াবহ—কেননা এতে অকথ্য নির্যাতন, বাড়ি দখল, নির্যাতন, শোবার ঘরে গুপ্ত ক্যামেরা ও স্পাই ডিভাইস স্থাপন এবং অভিযানের সময় নারী ও শিশুদের মারধরের মতো ঘটনার অডিও এবং ভিডিও সাক্ষ্য রয়েছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, এই সংস্থাগুলোর ইজরায়েলি, আমেরিকান এবং ইউরোপীয় নিরাপত্তা সংস্থার সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সংস্থাগুলো তাদের থেকে সরাসরি অর্থনৈতিক সহায়তা এবং দমন ও তদন্তের প্রশিক্ষণ পায়। এমনকি ইজরায়েলের শিন বেট (ইজরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থা) এর সদস্যরাও নিয়মিত জেরিকো শহরে এসে ‘ইউনিভার্সিটি অব ইন্ডিপেনডেন্স’-এর নিরাপত্তা বিজ্ঞানের ছাত্রদের উদ্দেশ্য বক্তব্য প্রদান করে।
ইউরোপ, ব্রিটেন এবং আমেরিকায় যারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর অর্থায়ন করে, তারা এই কাজগুলোতে সন্তুষ্ট। তারা কখনোই সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার কিংবা মানবাধিকার সনদের প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতিকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়নি, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা ইজরায়েলের নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে, তারা ইজরায়েলকে যে সাহায্য প্রদান করে, তাতেও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি আনুগত্য করার প্রতিশ্রুতিকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয় না।
এই সংস্থাগুলো পুরোপুরি ইজরায়েলি সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিশে গেছে এবং তাদের নিরাপত্তা মতাদর্শকে এমনভাবে গ্রহণ করেছে যে, যারা দখলদারিত্বের শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়, তাদেরই এই সংস্থাগুলো নিজেদের শত্রু হিসেবে গণ্য করে। শুধু তাই নয়, এই সংস্থাগুলির বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের শাসক দল ‘ফাতাহ আন্দোলন’-এর কেউ যদি এই নীতির বিরোধিতা করে কিংবা প্রতিবাদ করে, তবে তাকে বাদ দেওয়া হয় বা হত্যা করা হয়, যেমনটা বহুবার ঘটেছে। এক বিশেষ সাক্ষ্যে একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এই সংস্থার সদস্যদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যে তারা আদেশ পালন করবে, এমনকি প্রতিপক্ষ যদি তাদের বাবা-মা-ও হন, তবুও। এতে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক বা সামাজিক রীতির কথা বিবেচনা করা হয় না।’
বিগত কয়েক দশক ধরে এবং আজও এই সংস্থাগুলোর পরিচালিত অভিযানগুলো ব্যাপক এবং নিয়মতান্ত্রিক, যা দখলদারদের দৈনন্দিন অভিযানের মতোই। তাদের লক্ষ্য হলো দখলদারিত্ব এবং কর্তৃপক্ষের এজেন্ডার বিরোধিতাকারী কর্মীদের দমন করা। কাজের এ সময়কালে তারা হাজারো মানুষকে গ্রেফতার করেছে, নির্যাতনের মাধ্যমে ৬০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং লক্ষাধিক মানুষের সম্পদ লুট করেছে।
সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো, যারা দখলদারদের অপরাধ এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে প্রতিবাদ করে, তাদের বিরুদ্ধে সাধারণত যে অভিযোগগুলো আনা হয় তা হলো—কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা করা, উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের অপমান করা এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে উস্কে দেওয়া। শেষের অভিযোগটি অত্যন্ত অবাক করার মতো, কারণ দখলদারিত্বে থাকা ফিলিস্তিনি অঞ্চলে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত এমন কোনো সম্প্রদায় নেই। বরং খ্রিস্টান এবং মুসলমান উভয়েই দখলদারদের অপরাধের শিকার এবং তারা একসঙ্গে দখলদারমুক্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছে।
এই সংস্থাগুলোতে ৭০,০০০ এরও বেশি সদস্য রয়েছে, যা প্রতি ১,০০০ জন নাগরিকের জন্য ১৬ জন নিরাপত্তা কর্মকর্তার অনুপাতে পৌঁছায়—যেটি সাধারণত শুধুমাত্র একনায়কতান্ত্রিক পুলিশ শাসনে দেখা যায়। এদের মধ্যে রয়েছে কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেল—যাদের দেখে দূর থেকে মনে হবে যে তারা একটি অদম্য এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধান। কিন্তু বাস্তবে তারা দখলদার শক্তির সেবক এবং দাস, যারা কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় বিশেষ অনুমতি নিয়ে চলাফেরা করে। চেকপয়েন্টে তাদের অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হয়। এবং যখন দখলদার বাহিনী তাদের এলাকায় অভিযান চালায়, তারা তাদের গর্তে লুকিয়ে পড়ে যতক্ষণ না দখলদাররা তাদের কাজ সম্পন্ন করে। এই সংস্থাগুলো কখনও দখলদার বাহিনী বা বসতি স্থাপনকারীদের হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি বা প্রতিরোধ করেনি। তারা কখনো কোনো বসতি স্থাপনকারীকে গ্রেফতার করেনি, এমনকি তাদের অপরাধের জন্য কোনোরূপ শাস্তিও দেয়নি। বরং, যদি তারা কোনো বসতি স্থাপনকারীকে গ্রেফতার করে, তবে তারা তাকে দখলদার শক্তির কাছে হস্তান্তর করে। যারা তাকে মুক্তি দেয় এবং সে পুনরায় অপরাধ করতে ফিরে আসে।
তাই, এই সংস্থাগুলোর এবং দখলদার বাহিনীর মধ্যকার সম্পর্ককে ‘সমন্বয়’ বলা অযৌক্তিক। বরং এটি একতরফা সহযোগিতা, যা বিশ্বাসঘাতকতা ও শত্রুর হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির সমান। তারা স্বাধীনতাকামী কর্মীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে, ফাইল প্রস্তুত করে এবং সেগুলো ইজরায়েলি ও আমেরিকানদের কাছে পৌঁছে দেয়।
এছাড়াও, বারবার গ্রেফতার এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি সমাজকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, ফিলিস্তিনি জনগণ দখলদারদের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে এবং তাদের স্বার্থ গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাত বছরের নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর প্রয়াত ইয়াসির আরাফাত নিজের হাতে তৈরিকৃত এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই সংস্থার অনেক সদস্য ২০০০ সালে আল-আকসা ইন্তিফাদার সময় সেই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন। তবে, রামাল্লায় বোমাহামলা এবং অবরোধের সময় মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন দুর্নীতির উৎসগুলো তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। একটি তদন্ত কমিটির ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, বর্তমান সময়ের একজন পরিচিত ও সফল নেতা একজন ডেন্টিস্টের মাধ্যমে তাকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করে।
২০০৪ সালে আরাফাতের হত্যার পর, নিরাপত্তা সংস্থাগুলো পুনর্গঠন করা হয়। জেনারেল ডেটনকে অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য পাঠানো হয় এবং একটি আমেরিকান-ইউরোপীয়-ইজরায়েলি কমিটি তৈরি করা হয়, যা এই সংস্থাগুলোর কার্যক্রম তদারকি করে নিশ্চিত করে যে তারা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো শত্রুতামূলক পদক্ষেপ প্রতিরোধে কাজ করছে। এই সংস্থাগুলোর বর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা ব্যাপকভাবে গ্রেফতার ও নির্যাতন চালাতে থাকে, অথচ দাতা ও সমর্থকদের অবস্থান কখনো পরিবর্তিত হয়নি।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কারাগারগুলো বন্দীদের দিয়ে পূর্ণ হয়ে যায়, এবং নিরাপত্তা সদর দপ্তরগুলোতে নির্যাতন মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ে। নির্যাতনের নৃশংসতা ও তীব্রতার কারণে জেরিকো কারাগারকে ‘স্লটারহাউজ’ বলা হতো।
এই সংস্থাগুলোর ইজরায়েলি সংস্থার সাথে যোগাযোগ লজ্জাহীনভাবে চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। শিন বেটের কর্মকর্তারা তদন্ত সেশনে উপস্থিত থাকত এবং তদারকি করত। যাদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত, তাদের ইজরায়েলি কারাগারে স্থানান্তর করা হতো—তদন্ত সম্পূর্ণ করার জন্য এবং বিচারের মুখোমুখি করার জন্য।
মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল দখলদার শক্তির সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতার মতবাদকে ‘পবিত্র’ বলে মেনে আসছে। বসতি স্থাপন সম্প্রসারণ ও হত্যাকাণ্ডের কারণে যখনই এই সহযোগিতার সমালোচনা বেড়েছে, আব্বাস বা ফাতাহ মুভমেন্টের কেন্দ্রীয় কমিটি নিরাপত্তা সহযোগিতা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এটি সবসময়ই ঘোষণার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল, কারণ এই সহযোগিতা কখনো এক মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেনি।
আজ, ৭ অক্টোবরের ঘটনা এবং গাজা উপত্যকায় চলমান গণহত্যার পরও কিছুই পরিবর্তন হয়নি। এই সংস্থাগুলো তাদের কাজ স্বাভাবিকভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে, গাজা উপত্যকার প্রতি সংহতিমূলক যেকোনো কার্যক্রমকে কঠোরভাবে দমন করছে। তারা ১৬ জন নাগরিককে হত্যা করেছে, শিশুসহ অনেককে আহত করেছে, এবং গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছে। পর্যায়ক্রমিক গ্রেফতারের এই প্রক্রিয়ায় সংস্থাগুলো দখলদার বাহিনীর সঙ্গে পালাক্রমে কাজ করেছে। পশ্চিম তীরে এই নিষ্ঠুর দমনপীড়ন জনগণের মনোযোগ গাজায় চলমান গণহত্যা থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
পশ্চিম তীরজুড়ে ব্যাপক হারে বসতি স্থাপন, আল-আকসা মসজিদে হামলা এবং সাধারণ নাগরিকদের উপর বসতি স্থাপনকারীদের হামলা, মারধর, গুলি চালানো ও সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা চলতে থাকার পাশাপাশি, স্মোট্রিচ ও বেন জিভিরের পশ্চিম তীরের ওপর ইসরায়েলি সার্বভৌমত্ব আরোপের হুমকির পরও, আব্বাসের সরাসরি নির্দেশে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বাহিনী পশ্চিম তীরজুড়ে দমন-পীড়নের মাত্রা আরও বাড়িয়েছে। এই দমন-পীড়নের চূড়ান্ত উদাহরণ হলো জেনিন শিবিরে টানা পঁয়ত্রিশ দিনের কঠোর অবরোধ।
এই নিরাপত্তা সংস্থাগুলো দখলদার বাহিনীর মতোই শহর, গ্রাম ও শরণার্থী শিবির অবরোধ করেছে। জেনিন শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দাদের শিবির ছেড়ে যেতে বাধা দিয়েছে এবং শিশুদের স্কুলে যেতে দেয়নি। বাসিন্দাদের খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানী থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তারা বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সেগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে এবং ধ্বংস করেছে।
এছাড়াও তারা নাগরিকদের গাড়ি পুড়িয়েছে, আরপিজি ব্যবহার করেছে এবং স্নাইপাররা ভবনের ছাদে উঠে যাকে ইচ্ছা তাকে গুলি করে হত্যা করেছে।
সাংবাদিক শাজা আল-সাব্বাহকে তার ভাতিজাদের সঙ্গে থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়। মাহমুদ আল-জালকামুসি ও তার ছেলেকে হত্যা করা হয় এবং তার মেয়েকে আহত করা হয়, যখন তারা পানি আনতে যাচ্ছিল। অবরোধের সময় এই সংস্থাগুলোর হাতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ জনে।
দখলদার শক্তি ও তাদের মুখপাত্ররা যেমন অপরাধ করে দায় অস্বীকার করে, ঠিক তেমনই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সংস্থার মুখপাত্র আনোয়ার রজবও লজ্জাহীনভাবে দায় অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠীকে দায়ী করেন, যা ঘটনাস্থলে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।
অধিকন্তু, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তথ্য মিথ্যা প্রমাণ করতে ও নিজেদের বয়ান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্ত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়, বিশেষ করে আল-জাজিরার ক্ষেত্রে। আব্বাস রামাল্লায় আল-জাজিরার অফিস বন্ধ করার নির্দেশ দেন এবং এর সম্প্রচার স্থগিত করেন। এমনকি একটি স্থানীয় আদালতকে তাদের ওয়েবসাইট ব্লক করার আদেশ দেন। এটি ইজরায়েলি দখলদার সরকারের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা জেনিন শিবিরে হামলার সময় দখলদার বাহিনীর অপরাধ ফাঁস হওয়া আটকানোর উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল।
এই সংকটময় ও কঠিন সময়ে, যখন ফিলিস্তিনি জনগণ চরম দুঃসময় পার করছে, কোনো দায়িত্বশীল রাজনীতিক এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, যা একটি শিবিরকে অবরুদ্ধ করে। এই শিবিরটি ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশার ইতিহাসের সাক্ষী, যা দখলদার সরকার মুছে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। গত এক বছরে দখলদার বাহিনী একাধিকবার হামলা চালালেও তারা ব্যর্থ হয়েছে।
নানান নাগরিক সমাজের সংগঠন ও গোষ্ঠী আন্তরিকভাবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে আনতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট আব্বাস সেই প্রচেষ্টাগুলো নষ্ট করেছেন। তিনি তেলআবিব ও ওয়াশিংটনের ইচ্ছা পূরণে মনোনিবেশ করেন এবং এমন নীতিমালা বাস্তবায়ন করেন, যা ফিলিস্তিনি জনগণের ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং তাদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে।
জাতিসংঘে আব্বাস নিয়মিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দখলদারিত্বের অবসান ও সুরক্ষার দাবি জানিয়ে আসছেন।
গতকাল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি গাজার চিকিৎসাকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলোতে দখলদার বাহিনীর চলমান আক্রমণের কারণে চোখের জল ফেলেন, যার মধ্যে সর্বশেষ হামলাটি করা হয়েছিল কামাল আদওয়ান হাসপাতাল পুড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে।
তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কাকে গুরুত্ব দেবে? দখলদার বাহিনীর অপরাধ থেকে ফিলিস্তিনি জনগণকে রক্ষা করবে, নাকি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অপরাধ থেকে? কর্তৃপক্ষের বাহিনী জেনিন হাসপাতালকে সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেছে এবং অবরুদ্ধ শিবিরের মধ্যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছে।
এটি এমন এক পরিস্থিতি, যেখানে স্বার্থান্বেষী ও দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দল নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য দখলদারদের কাছে সুবিধা আদায়ের চেষ্টায় ব্যস্ত। একই সঙ্গে তারা দখলদার বাহিনীর অপরাধের বিরুদ্ধে কিছু বিবৃতি দেয়, যা তাদের নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করার কেবল একটি ছল।
প্রাচীন এবং সমসাময়িক ইতিহাসে দেখা যায়, দখলদার শক্তির দ্বারা শাসিত জনগণ প্রায়শই কিছু দুর্বলচিত্ত ব্যক্তি বা দল দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে—যারা প্রতিনিয়তই দখলদারদের পক্ষে কাজ করে তাদের মনোবল ধ্বংস করতে এবং দখলদারিত্বকে স্থায়ী উপনিবেশে রূপান্তর করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু জনগণ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের সমস্ত শক্তি সংগঠিত করেছে এবং দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছে, তখন এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। যেমনটি ইউরোপীয়রা নাৎসি দখলদার ও তাদের দোসরদের মোকাবিলার সময় করেছিল।
ফিলিস্তিনি জনগণ এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে শত বছর ধরে। ব্রিটিশ শাসনের সময়, ১৯৩৬ সালে তথাকথিত ‘পিস ইউনিট’ গুলো গঠন করা হয়েছিল—যা মূলত ঔপনিবেশিক শক্তি এবং জায়নিস্টদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি, মুক্তিকামীদের তাড়া করা এবং তাদের হত্যা করার কাজে ব্যবহৃত হতো।
সময়ের সাথে সাথে তাদের মিশন শেষ হলে, এই ইউনিটগুলোও অপসারণ করা হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম এখনো পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
আজকের দিনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং এর বিভিন্ন সংস্থার ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় ও অনিশ্চিত। এর নীতির প্রতি জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। এমনকি যারা একসময় এটিকে সমর্থন করত, তাদের কাছেও এটি এখন একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এই কর্তৃপক্ষ তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে পুরোপুরি অক্ষম হয়েছে।
বর্তমান দখলদার সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে চরম ডানপন্থীরা, যারা পশ্চিম তীরের ওপর তাদের পূর্ণ আধিপত্য কায়েম করার, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বকে বিতাড়িত করার এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে সাধারণ ট্রাফিক পুলিশে রূপান্তরের সুযোগ খুঁজছে।
এখন এই সংস্থাগুলোকে সংস্কার করা বা তাদের একত্রিত করে ফিলিস্তিনি জনগণের সুরক্ষার জন্য একটি কার্যকর নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তোলা আর সম্ভব নয়। তারা এমন একটি পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যা শুধুমাত্র দখলদারদের এজেন্ডাকে বাস্তবায়ন করে। আব্বাসকে তার রাজনৈতিক নীতি পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়া কোনো কাজেই আসবে না। সময় পেরিয়ে গেছে। ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যায্য কারণটির প্রতি তিনি যে ক্ষতি করেছেন, তা কোনো পরামর্শ দিয়ে মেরামত করা সম্ভব নয়।
আব্বাস শীঘ্রই ৯০ বছরে পা দেবেন, কিন্তু তিনি এখনো ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের চারপাশের বিপদগুলো উপেক্ষা করে চলেছেন। দখলদার শক্তি তাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যেখানে তার নিজের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। হত্যা, গ্রেফতার ও বসতি স্থাপন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্তও প্রস্তুত। ট্রাম্প যদি আবার হোয়াইট হাউজে ফেরে আর স্মোটরিচ ও বর্তমান ডানপন্থী সরকারের পরিকল্পনা সফল হয়, তবে আব্বাস এবং তার কর্তৃপক্ষের ভবিষ্যৎ কী হবে?
সূত্র: মিডল ইস্ট মনিটর থেকে অনুবাদ করেছেন এম আক্তার
মধ্যপ্রাচ্য মার্চ ২৫ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত।