মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

গাজা যুদ্ধের ধাক্কায় মানসিক টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত ইসরায়েলি সমাজ

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এরান প্রায় ৩ লাখের বেশি সহায়তা কল পেয়েছে। এর মধ্যে ৪০ হাজার কল এসেছে সৈনিক ও তাঁদের পরিবারের কাছ থেকে, আর ৫৮ হাজার কল ছিল কিশোর-কিশোরীদের। অনেক সৈনিকই বলেছেন, ‘গাজায় মারা গেলে ভালো হতো’। এটি মূলত যুদ্ধ-পরবর্তী মানসিক যন্ত্রণারই প্রকাশ।
গাজা যুদ্ধের মানসিক ধাক্কা, যুদ্ধে ফিরতে না চাওয়ায় কারাগারে ৪ ইসরায়েলি সেনা
গাজা যুদ্ধের মানসিক ধাক্কা, যুদ্ধে ফিরতে না চাওয়ায় কারাগারে ৪ ইসরায়েলি সেনা । ছবি : সংগৃহীত

গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যে চলমান যুদ্ধ ইসরায়েলি সমাজে গভীরভাবে ছাপ ফেলেছে। একদিকে সরকার ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র আড়াল করার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে দেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি দিন দিন উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। এমন তথ্য উঠে এসেছে সাম্প্রতিক সরকারি পরিসংখ্যানে।

ইসরায়েলের বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে বেড়ে চলছে মানুষের ভিড় । যুদ্ধের ধাক্কা থেকে সৃষ্ট চাপে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন মানসিক অসুস্থতা, মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যার প্রবণতায়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা দেশটির বর্তমান সমাজকে বলছেন—‘একটি অসুস্থ সমাজ’।

এমন সব পারিবারিক ও মানসিক সমস্যা এখন সামনে আসছে, যেগুলোর অস্তিত্ব অতীতে খুব একটা দেখা যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে এসব সংকট মোকাবেলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। বাড়ছে পারিবারিক কলহ, গার্হস্থ্য সহিংসতা এবং মানসিক অসুস্থতার মাত্রা।

সমাজজুড়ে এই অব্যক্ত চাপ এখন এক বিশাল সংকটে রূপ নিচ্ছে, যার প্রতিক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

অবসাদ ও আত্মহননের ঢেউ

প্রায় ৬০০ দিন পেরিয়ে গেছে গাজা যুদ্ধ। এই দীর্ঘ যুদ্ধ ইসরায়েলি সমাজকে শুধু নিরাপত্তাহীনতা নয়, এক গভীর মানসিক সংকটের দিকেও ঠেলে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত বোমা, মৃত্যু ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন পার করা মানুষগুলো আজ আর তাদের মানসিক যন্ত্রণাকে লুকিয়ে রাখতে পারছে না।

ইসরায়েলের জরুরি মানসিক সহায়তা সংস্থা ‘এরান (ERAN)’ বলছে, তাদের হেল্পলাইনে প্রতিদিন আসা কলের ৪৮ শতাংশই উদ্বেগ, ট্রমা, একাকিত্ব, হতাশা ও অনিদ্রার মতো মানসিক সমস্যার অভিযোগ। সংস্থাটির ভাষায়, এটি এক ধরনের ‘মানসিক সুনামি’, যা ১৯৭১ সালে তাদের প্রতিষ্ঠার পর নজিরবিহীন।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এরান প্রায় ৩ লাখের বেশি সহায়তা কল পেয়েছে। এর মধ্যে ৪০ হাজার কল এসেছে সৈনিক ও তাঁদের পরিবারের কাছ থেকে, আর ৫৮ হাজার কল ছিল কিশোর-কিশোরীদের। অনেক সৈনিকই বলেছেন, ‘গাজায় মারা গেলে ভালো হতো’। এটি মূলত যুদ্ধ-পরবর্তী মানসিক যন্ত্রণারই প্রকাশ।

অনলাইন মানসিক সহায়তা সংগঠন ‘সাহার’ জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাদের হটলাইনে কলের সংখ্যা ২৪৫ শতাংশ বেড়েছে, কিশোরদের মধ্যে এই হার ৪৩০ শতাংশ।

ইসরায়েলি মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ সময়টি তাদের জীবনের সবচেয়ে জটিল সময়গুলোর একটি। গাজা যুদ্ধ ইসরায়েলিদের মানসিক স্বাস্থ্যকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে, যার প্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। উদ্বেগ, আতঙ্ক, একাকিত্ব, মানসিক যন্ত্রণা, দুঃসহ স্মৃতি ও মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা—এসব উপসর্গ বছরের পর বছর থেকে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ঘুমের সমস্যা, ওজন বৃদ্ধি, অ্যালকোহল গ্রহণ, ধূমপান ও দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্তের হার ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে মনোযোগ কমে যাওয়া, একাগ্রতা হ্রাস ও শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি—এসবই এখন নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা।

সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে, গাজা যুদ্ধের পর ইসরায়েলি সমাজ এক ভয়াবহ মানসিক ও স্নায়ুবিক সংকটে পড়েছে। আরবি পোস্ট–এর প্রতিবেদন বলছে, যুদ্ধের অভিঘাত দীর্ঘমেয়াদে ইসরায়েলিদের মানসিক স্বাস্থ্যে গভীর বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

একটি স্বাস্থ্যবিমা সংস্থার হিসাবে, যুদ্ধের পর আতঙ্ক, রাগ, অবসাদ, ধৈর্যহীনতা, আত্মবিচ্ছিন্নতা, ঘুম ও খাওয়ার অভ্যাসের পরিবর্তন এবং মনোযোগহীনতার মতো মানসিক সমস্যায় চিকিৎসা নেওয়ার হার ১৫০ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি মাসে গড়ে ৩২০০ জন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, অন্তত ৭ হাজার সেনা, অফিসার ও পুলিশ সদস্য যুদ্ধ-পরবর্তী মানসিক ও স্নায়ুবিক জটিলতায় ভুগছেন। রিজার্ভ বাহিনীর ১২ শতাংশ সদস্যের মধ্যে একাধিক মানসিক উপসর্গ দেখা গেছে। গাজা যুদ্ধকালে আহত ২০ হাজার মানুষের এক-তৃতীয়াংশ ট্রমাজনিত মানসিক রোগে আক্রান্ত।

জাতীয় বিমা কর্তৃপক্ষ বলছে, গাজা যুদ্ধের কারণে অন্তত ৬৫ হাজার ইসরায়েলি নাগরিক এখন স্নায়ুবিক ও মানসিক রোগে ভুগছেন। তাদের অনেকে স্থায়ীভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। গাজার আশপাশের এলাকার ৩০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত ওষুধ ও চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল।

‘কিশার’ নামের প্রতিবন্ধী সহায়তা সংস্থা জানিয়েছে, ৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে ১ লাখের বেশি ইসরায়েলি নাগরিক শারীরিক, মানসিক, স্নায়ুবিক ও আবেগগত প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁরা এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।

জাতীয় ট্রমা সেন্টার বলছে, গাজা যুদ্ধের পর সেনাবাহিনীর অন্তত ১২ শতাংশ সদস্য PTSD— অর্থাৎ যুদ্ধ-পরবর্তী মানসিক ট্রমায় ভুগছেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা একে চরম সংকট হিসেবে দেখছেন।

ইসরায়েলের নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক স্নায়ুবিক বিপর্যয়

তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নারী মানসিক স্বাস্থ্য সম্মেলনে প্রকাশিত তথ্য বলছে—গাজা যুদ্ধ চলাকালীন ইসরায়েলের বহু নারী গভীর মানসিক সংকটে পড়েছেন, বিশেষ করে যাঁরা ওই সময়ে মা হয়েছেন। গবেষণায় উঠে এসেছে, যুদ্ধকালীন সময়ে সন্তান প্রসবকারী নারীদের মধ্যে ৩২.৭ শতাংশ প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতায় (Postpartum Depression) ভুগছেন। এঁদের মধ্যে ৬২ শতাংশ নিয়মিত যুদ্ধসংক্রান্ত দুঃস্বপ্নে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ৭৩ শতাংশ নারী দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ইসরায়েলে নিবন্ধিত মানসিক রোগীর সংখ্যা ছিল আনুমানিক আড়াই লাখ। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়কালে নতুন করে আরও অন্তত ৮,৭০০ জন মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যুদ্ধ শেষ হলেও এর মানসিক অভিঘাত দীর্ঘমেয়াদি হবে। তাঁদের মতে, অন্তত ১৩ হাজার থেকে ৬০ হাজার ইসরায়েলি নাগরিক PTSD (Post-Traumatic Stress Disorder) বা যুদ্ধ-পরবর্তী মানসিক ট্রমা, উদ্বেগ, বিষণ্নতা, অনিদ্রা, আকস্মিক রাগ, ভয়, অতিরিক্ত ক্লান্তি, আত্মঘৃণা, স্মৃতিকেন্দ্রিক মানসিক আঘাত, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা ও নানা ধরনের মানসিক জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারেন।

‘আসুতা আশদোদ’ হাসপাতালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলে ‘হার্ট ব্রেক সিনড্রোম’—অর্থাৎ মানসিক আঘাত থেকে উদ্ভূত হৃদরোগের হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। একইসঙ্গে ঘুমের ওষুধ, স্নায়ু শান্তকারক, হরমোন ও সাপ্লিমেন্ট জাতীয় ওষুধের চাহিদা বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এমনকি প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হওয়া ওষুধের বিক্রিও বেড়েছে ১৫ শতাংশ।

যুদ্ধকালীন মানসিক চাপ থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন শারীরিক উপসর্গও। দাঁত ঘষা, চোয়ালে ব্যথা ও মুখের পেশিতে টান পড়ার মতো সমস্যাগুলো বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, এসব উপসর্গ মোকাবিলায় ব্যবহৃত ‘নাইট স্প্লিন্ট’ নামের চিকিৎসা পদ্ধতির চাহিদা ইসরায়েলে প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে।

একাধিক জরিপও এই সংকটের ভয়াবহতা তুলে ধরেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যেখানে ৫৯ শতাংশ ইসরায়েলি তাঁদের স্বাস্থ্যকে ‘খুব ভালো’ বা ‘চমৎকার’ বলে মনে করতেন, এখন সে সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৪৯ শতাংশে। বর্তমানে ২৬ শতাংশ মানুষ তাঁদের মানসিক অবস্থা ‘মাঝারি’ বা ‘খারাপ’ বলছেন—যা আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

সামাজিক সম্পর্ক, একাগ্রতা ও জীবনধারায় নেতিবাচক প্রভাব

যুদ্ধের প্রভাব শুধু সামরিক খাতেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি সাধারণ মানুষের জীবনেও গভীর ছাপ ফেলছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ৫৩% মানুষ তাঁদের সামাজিক কার্যক্রম কমিয়ে দিয়েছেন। ৪৮% জানিয়েছেন, তাঁদের মনোযোগ ও একাগ্রতা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। আর ৪৫% মানুষ দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আগের মতো মানসিক বা শারীরিক শক্তি অনুভব করছেন না।

স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকেও উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। প্রায় ২০% মানুষ চিকিৎসা গ্রহণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল বা পিছিয়ে দিয়েছেন।

পরিবারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাতেও যুদ্ধের ছায়া পড়েছে। প্রতি পাঁচজন ইসরায়েলির একজন তাঁদের পরিবারের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা পিছিয়ে দিয়েছেন। এর পাশাপাশি, ১২% মানুষ আগের চেয়ে বেশি অ্যালকোহল গ্রহণ করছেন, যা যুদ্ধের আগের তুলনায় দ্বিগুণ। ধূমপানও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে—৪০% মানুষ যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আরও বেশি ধূমপান শুরু করেছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উপাত্ত ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, স্বাস্থ্য খাতে এক গভীর সংকট ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। আর যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে এই সংকট আরও জটিল ও বিপজ্জনক আকার ধারণ করতে পারে।

যুদ্ধে নয়, আতঙ্কেই বিধ্বস্ত ইসরায়েলিরা

ইসরায়েলি সমাজে চলমান যুদ্ধ কী ভয়াবহ মানসিক প্রভাব ফেলেছে, তা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে। মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তায় নিয়োজিত সংস্থা ‘নাতাল’ জানিয়েছে, ২০২২ সালে যেখানে তারা প্রায় ১৫ হাজার ৪০০ জন ইসরায়েলিকে মানসিক চিকিৎসা দিয়েছিল, সেখানে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর—অক্টোবর ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪—মাত্র ৯ মাসেই এই সংখ্যা লাফিয়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজারে।

এই সময়ে ইসরায়েলিদের মধ্যে উৎকণ্ঠা, মানসিক আঘাত, প্রিয়জন হারানোর শোক এবং গভীর বিষণ্নতার কারণে সাহায্য চাওয়ার হার প্রায় ৯৫০ শতাংশ বেড়েছে। এই পরিসংখ্যান প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছে, যা যুদ্ধের মানসিক অভিঘাতকে নিঃসংশয়ভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।

চোখে পড়ার মতো হারে বেড়েছে ঘুমের ওষুধ, অবসাদ ও ব্যথানাশকের চাহিদা

৭ অক্টোবর হামলা ও গাজা যুদ্ধের দুঃসহ অভিজ্ঞতা ইসরায়েলিদের মানসিক স্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে ঘুমের ওষুধ, অবসাদ প্রতিরোধী এবং উদ্বেগ কমানোর ওষুধের ব্যবহার প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে।

তবে এখানেই শেষ নয়। ব্যথানাশক ওষুধের চাহিদাও বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে মারাত্মক আসক্তি তৈরিকারী ‘অপিয়েট’ জাতীয় পেইনকিলারের ব্যবহার তিন গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক অবস্থা দক্ষিণের গাজা সীমান্ত ও উত্তরের লেবানন সীমান্তঘেঁষা বসতি অঞ্চলে। এসব এলাকায় মানুষের মধ্যে মানসিক ওষুধ ব্যবহারের হার বেড়েছে যথাক্রমে ২০০% এবং ২৫০%—যা ভয়াবহ উদ্বেগের ইঙ্গিত দেয়।

বারবার রকেট হামলার সাইরেনে ইসরায়েলিদের মানসিক ভাঙন

গাজায় চলমান যুদ্ধ ইসরায়েলি সমাজে রেখে যাচ্ছে গভীর মানসিক ক্ষত। যুদ্ধের বিভীষিকা, বিস্ফোরণের আওয়াজ এবং একের পর এক রকেট হামলার সতর্কবার্তা ইসরায়েলিদের মধ্যে সৃষ্টি করছে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ। ঘন ঘন বিপদ সংকেত, শহর ও বসতিগুলোতে বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনি—সব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক উৎকণ্ঠায় ভরা পরিবেশ, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে মানুষের মানসিক স্বস্তি ও জীবনের ধারায়।

শুধু দৈনন্দিন রুটিনেই নয়, এর প্রভাব পড়ছে জীবনযাত্রার গুণগত মান এবং তাৎক্ষণিক স্বাচ্ছন্দ্যের ওপরও। এতে কমে যাচ্ছে মানুষের ইতিবাচকতা, মনোবল ও মানসিক স্থিতিশীলতা।

গাজা যুদ্ধ ইসরায়েলিদের মাঝে এক নজিরবিহীন মানসিক চাপ তৈরি করেছে। যুদ্ধের ক্ষত এখনও গভীরভাবে আঁচড় কাটছে ইসরায়েলি সমাজে। নিরাপত্তাহীনতা, রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাহীনতা আর বিশ্বাসঘাতকতার অনুভব এক ধরনের সামষ্টিক মানসিক বিপর্যয় তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ ইসরায়েলি নাগরিক নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন না। যুদ্ধ শুরুর প্রায় ২০ মাস পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতি উন্নতির পথে বলে যারা মনে করছেন, তারা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে রয়েছেন।

আত্মহত্যা বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান মনোবিজ্ঞানী ইউসি লেভি ব্লাজ বলেন, এখনও কোনো সুস্থতার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি, কারণ সবচেয়ে খারাপ সময়টা এখনো শেষ হয়নি। তার ভাষ্য অনুযায়ী, চলমান যুদ্ধে এক-তৃতীয়াংশ ইসরায়েলি নাগরিক পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা PTSD-তে আক্রান্ত। আর ৪৫ শতাংশ মানুষ হতাশা ও উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছেন।

বর্তমানে ইসরায়েলি জনজীবনে চরম উদ্বেগ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। দৈনন্দিন কাজেও এর প্রভাব স্পষ্ট। ৬০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তাদের সামাজিক ও মানসিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫০ শতাংশের ঘুম ব্যাহত হচ্ছে এবং তা পরে আর স্বাভাবিক হচ্ছে না। তারা সহজেই ধৈর্য হারাচ্ছেন, রাগ প্রকাশ করছেন, যার ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক হয়ে উঠছে উত্তেজনাপূর্ণ ও আক্রমণাত্মক। এমনকি অনেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছেন।

আরও উদ্বেগজনক তথ্য হলো—৬৫ শতাংশ ইসরায়েলি জানিয়েছেন, তাদের দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রের প্রতি মমত্ববোধ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ৬৭ শতাংশ বলছেন, তারা অন্য দেশে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন। এমন প্রবণতা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। তাদের বক্তব্য, ‘আমরা এখানে বসবাসে বাধ্য নই।’

গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলি সৈন্যদের মানসিক সংকট ও চ্যালেঞ্জ

গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলি সৈন্যরা মানসিকভাবে এক নতুন সংকটে নিমজ্জিত। যুদ্ধে অনেক সৈন্য শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে শোক ও মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তারা নতুন জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না, যার ফলে গভীর মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। 

৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে মানসিক চাপে ভুগছেন ইসরায়েলি সৈন্যরা। বসতি রক্ষা করতে না পারা, প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো এবং দিনের পর দিন একাকী অবস্থান—এসব তাদের মধ্যে গভীর অপরাধবোধ ও অক্ষমতার অনুভূতি তৈরি করেছে। কেউ কেউ লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছেন, পালিয়ে বেঁচেছেন। যার ফলে তাদের আত্মবিশ্বাসে তৈরি হয়েছে মারাত্মক ঘাটতি। 

বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা

ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশটিতে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩ হাজার ২০০ জন, যাদের অনেকেই আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে যুদ্ধ চলাকালে আত্মহত্যার প্রকৃত সংখ্যা এখনো নির্ধারণ করা যায়নি।

দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এবং এর কোনো সমাপ্তি দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় জনমনে উদ্বেগ ও মানসিক চাপ আরও বেড়েই চলেছে। অনেক ইসরায়েলি মনে করছেন, এই যুদ্ধ মূলত রাজনীতিকদের স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে, যা তাদের হতাশাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।

যদিও নানা পরিসংখ্যান সামনে আসছে, তবে ৭ অক্টোবরের হামলা এবং গাজা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের মানসিক ক্ষতির প্রকৃত মাত্রা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই যুদ্ধ সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে ইসরায়েলের মানসিক স্বাস্থ্য খাতে। এর অভিঘাত বহু বছর ধরে বহন করতে হবে দেশটিকে।

যুদ্ধ শুরুর আগেই ইসরায়েলে প্রায় তিন লাখ মানুষ গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন। আর অন্তত ১০ লাখ মানুষ মানসিক চিকিৎসার অপেক্ষায় ছিলেন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এই সংখ্যা আরও কয়েক লাখে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে না, অর্থনীতিতেও বড়সড় প্রভাব পড়বে।

এখন ইসরায়েলিদের বড় অংশ মানসিক চাপে ভুগছেন। উদ্বেগে আক্রান্তদের মধ্যে মনোরোগ চিকিৎসার জন্য রেফারেলের সংখ্যা কয়েক শত গুণ বেড়েছে। মাদক, অ্যালকোহল ও ট্রাঙ্কুইলাইজারের ব্যবহারও বেড়েছে মারাত্মক হারে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছেন সেনা সদস্যরা, বাস্তুচ্যুত মানুষ, নিহত ও আহতদের পরিবার, এবং উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে মানসিক চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৯০০ শতাংশ, যা যুদ্ধপূর্ব অবস্থার তুলনায় অন্তত ১৫ গুণ বেশি।

৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে ইসরায়েলি সেনাদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। সেনাবাহিনীর তথ্যমতে, এ পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার সেনাকে মানসিক সমস্যা, স্নায়ুবিক আঘাত এবং ব্যর্থতা ও অক্ষমতা বোধে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা দিতে হয়েছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, এসব মানসিক আঘাত অনেক সময় বাহ্যিকভাবে বোঝা যায় না, কিন্তু তা থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। কেউ কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে সহযোদ্ধাদের পুড়ে যাওয়া দেহের গন্ধ এখনও ভুলতে পারেননি, যার ফলে এখন আর মাংসের গন্ধও সহ্য করতে পারছেন না। অনেকে যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরলেও বেসামরিক জীবনে কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না।

কেউ কেউ পরিবার-পরিজনের সঙ্গেও স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারছেন না। স্ত্রী, সন্তান কিংবা বাবা-মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ তাঁদের স্মৃতিতে এখনও ভেসে ওঠে যুদ্ধক্ষেত্রে সহকর্মীদের মৃত্যু, গুরুতর আহত হওয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। এই মানসিক ক্ষত যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন থেকে যায়।

মানসিক আঘাত : মৃত্যুর আরেক নাম 

গাজা যুদ্ধের প্রতিটি দিন ইসরায়েলি সেনা ও কর্মকর্তাদের জীবনে এক কঠিন মানসিক যুদ্ধও। শুধু জীবন নিয়ে শঙ্কা নয়, বরং যুদ্ধের কারণে তাঁদের পেশাগত, পারিবারিক ও মানসিক জীবনে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধাবস্থা থাকার ফলে দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে এক মানসিক বিপর্যয়।

অনেক সেনা তাঁদের কাছের মানুষ, সহযোদ্ধা, নিহত বন্ধু কিংবা বাস্তুচ্যুত পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে এক অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছেন। ক্ষত এতটাই গভীর যে, অনেকেই এখনও মানসিকভাবে সুস্থতার প্রাথমিক ধাপে পৌঁছাতে পারেননি। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ বা PTSD-তে আক্রান্ত।

ফলে যুদ্ধশেষে কর্মস্থলে ফেরা, পরিবারে স্বাভাবিক জীবনযাপন কিংবা সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া—সবই তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকের ক্ষেত্রেই স্বজনদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা পর্যন্ত সম্ভব হচ্ছে না। যুদ্ধ শুধু শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনেনি, বরং বহু সেনার জীবনে ফেলে গেছে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক দুর্ভোগ।

যুদ্ধের আগে যেভাবে জীবন চলছিল, সেভাবে ফিরে যাওয়ার লড়াই এখন তাদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী একটি সংকট। এ মানসিক বিপর্যয় থেকে নিজে থেকেই পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া কঠিন। 

গাজা আজ এক ধ্বংসস্তূপ। ভাঙা দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে আছে শিশুদের নিথর দেহ, আর জীবিতরা খুঁজছে এক চুমুক পানি আর একটু ছায়া। প্রতিটি বোমা, প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র যেন ইসরায়েলের অপরাধে যোগ করছে আরেকটি রক্তাক্ত অধ্যায়। এরই মাঝে শোনা যাচ্ছে ইসরায়েলি সেনাদের মানসিক চাপ, হতাশা আর ক্লান্তির কথা। 

কিন্তু এই যন্ত্রণা আসলে যুদ্ধের ক্লান্তি নয়—এটা তাদের নিজেরই করা কাজের ফল। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে একটি নিষ্ঠুর রাষ্ট্র আজ নিজের তৈরি করা আগ্রাসনের পরিণতি ভোগ করছে।

ইতিহাস বলে,নিরপরাধ মানুষের রক্ত বৃথা যায় না। সেটি ফিরে আসে সংকট হয়ে, বিভ্রান্তি হয়ে, কখনো বা ধ্বংসের ছায়া হয়ে। আজ ইসরায়েল যে মানসিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি—তা তাদের নিজেদের কর্মফল ছাড়া আর কিছু নয়।

অ্যারাবিক পোস্ট,আল জাজিরা ও অন্যান্য কয়েকটি সাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলোকে এটি প্রস্তুত করেছেন আবদুল হান্নান হাসিব।

সর্বশেষ