ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসে পশ্চিমা বিশ্বের ঐক্যমতের পর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে—মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের অধিকার নেই?
আরব বিশ্বে বহুদিন ধরেই একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে—মুসলিম কিংবা আরব দেশগুলো যখনই পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে এগোয়, তখনই পশ্চিমারা তাতে হস্তক্ষেপ করে। এই ‘ভেটো’ অনেকেই দেখেন ইতিহাসের সেই ক্রুসেড যুদ্ধের আধুনিক রূপ হিসেবে।
এই ধারণা নিছক ধর্মীয় আবেগের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি, বরং এর পেছনে রয়েছে বাস্তব উদাহরণ। মুসলিম দেশগুলো যখনই পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জনের চেষ্টায় এগিয়েছে, তখনই তাদের ওপর চাপ বাড়ানো হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সব রাষ্ট্রেরই এই প্রযুক্তি অর্জনের অধিকার রয়েছে।
পশ্চিমা দেশের দ্বৈত আচরণ এ ধারণাকে আরও পোক্ত করেছে। একদিকে ইসরায়েলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে অনীহা, অন্যদিকে মুসলিম দেশগুলোতে শরিয়া আইনের আংশিক বাস্তবায়ন কিংবা তাদের পারমাণবিক প্রযুক্তিতে পশ্চাৎপদতা—সব মিলিয়ে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে মুসলিমদের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেন বাড়তি শঙ্কার কারণ।
পশ্চিমা শক্তিগুলো প্রকাশ্যেই বলে—ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় পরিচালিত কোনো গোষ্ঠী পারমাণবিক কর্মসূচিকে সমর্থন করলে, তা তাদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ পারমাণবিক প্রযুক্তি যখন ধর্মীয় পরিসরে পরিচালিত হয়, তখন তা ‘অবশ্যই’ হুমকি।
তবে প্রশ্ন জাগে—এই ভয় আসলে ধর্মীয় কারণে, নাকি রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ও নেতৃত্বের ধরন এর পেছনে কাজ করে? পশ্চিমারা কি আশঙ্কা করে যে, কোনো একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাতে এই অস্ত্র গেলে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে—যেখানে সিদ্ধান্ত নেবেন একজন এমন’ নেতা, যিনি কোনো সংসদ বা আদালতের কাছে জবাবদিহি করেন না?
কিন্তু সেই যুক্তিও টেকে না। কারণ, চীন, উত্তর কোরিয়া কিংবা রাশিয়ার মতো অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর হাতেও তো পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। এমনকি ভারত-পাকিস্তানের মতো দেশগুলোও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে পারমাণবিক শক্তিধর হয়েছে, তাতেও পশ্চিমাদের তেমন আপত্তি দেখা যায়নি।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তি অর্জনের সুযোগ পেয়েছিল মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বরাজনীতির বিভ্রান্তিকর এক পর্যায়ে। সেই সঙ্গে পশ্চিমা সামরিক বলয়ের বাইরে থাকাও তাদের এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়েছিল।
তবে সবচেয়ে বড় বৈষম্যের চিত্র ইসরায়েলের ক্ষেত্রে। বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও, ইসরায়েল পশ্চিমা সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তার কেন্দ্রবিন্দু:
- ফ্রান্স গড়ে দেয় ডিমোনা পারমাণবিক চুল্লি
- যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে সরবরাহ করে হেভি ওয়াটার
- যুক্তরাষ্ট্র দেয় ইউরেনিয়াম, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, এফ-১৫ ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান
- জার্মানি দেয় পারমাণবিক সক্ষমতাসম্পন্ন সাবমেরিন
- বেলজিয়াম দেয় ইউরেনিয়ামের কাঁচামাল
এমনকি ১৯৭৯ সালে ফ্রান্স থেকে কেনা ইরাকের পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংসে ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় মোসাদ অভিযান চালায়। পরে লিবিয়ার বিরুদ্ধেও একই কৌশলে চাপ প্রয়োগ করা হয়—নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিকভা একঘরে করে রাখা, এমনকি ন্যাটোর বোমা হামলা—সবই ছিল সেই ‘ভেটো’ বাস্তবায়নের পথ।
পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা এসব পদক্ষেপকে যৌক্তিক বলার চেষ্টা করলেও, বাস্তবে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্যের ছবিটা পরিষ্কার।
জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্লেষক ড্যানিয়েল সারওয়ার বলেন—যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে এগোয়, তবে কয়েক মাসের মধ্যেই আরও চারটি মধ্যপ্রাচ্য দেশ একই পথে হাঁটতে পারে। এমন অঞ্চলে যেখানে পারস্পরিক অবিশ্বাস তীব্র, সেখানে মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে।
এটাই বর্তমান বাস্তবতা। এর বিপরীতে রয়েছে পশ্চিমা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মুখোশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ইউরোপ নিজেদের ‘খ্রিস্টান-ইহুদি সভ্যতার উত্তরাধিকারী’ হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করে। ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়লেই এই ধর্মীয় পরিচয় আরও উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করা হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক জোট ‘পিপলস পার্টি’ এক বিবৃতিতে বলেছে, ইউরোপের ‘জিউডিও-ক্রিশ্চিয়ান হেরিটেজ’ রক্ষা করতে হবে। বেলজিয়ামের ফ্লেমিশ প্রধানমন্ত্রী জ্যান জাম্বন এক বক্তব্যে বলেছিলেন—ইউরোপ গঠিত হয়েছে খ্রিস্টান-ইহুদি ঐতিহ্য, গ্রিক গণতন্ত্র এবং রোমান আইনের ভিত্তিতে।
এই ধর্মভিত্তিক পরিচয় রাজনীতির প্রভাব পড়ে পশ্চিমা দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও। অনেক প্রভাবশালী ধর্মীয় গোষ্ঠী বিশ্বাস করে—ইসরায়েলের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাই মসিহর আগমনের পূর্বশর্ত। তাই ইসলামি সভ্যতার পুনর্জাগরণের যে কোনো চেষ্টাকেই তারা প্রতিপক্ষ ও হুমকি হিসেবে দেখে।
ফলে ইরানকে লক্ষ্য করে বারবার যুদ্ধের হুমকি, নিষেধাজ্ঞা আর আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ দেখা যায়। যেন মুসলিম বিশ্বে পারমাণবিক ক্ষমতা ছড়াতে না পারে।
সারসংক্ষেপে, এটা শুধু অস্ত্রের প্রশ্ন নয়—এটা একটা বৃহৎ সভ্যতা সংঘাত। পশ্চিমা দুনিয়া স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে—মুসলিমরা পারমাণবিক শক্তির দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারবে না। প্রয়োজনে যুদ্ধ করে হলেও তা প্রতিহত করা হবে।
সূত্র: আল জাজিরা