২০২৩ সালের নভেম্বর মাস, ইসরায়েল গাজায় শতাব্দির সবচেয়ে নৃশংস বোমা হামলা শুরু করে। তার ঠিক এক মাস পর ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলগামী ও ইসরায়েল-সম্পৃক্ত জাহাজ লক্ষ্য করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো শুরু করে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি এবং গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন থামাতে চাপ তৈরি করাই ছিল এই হামলার মূল উদ্দেশ্য। এই হামলার ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে সামনে আসে মহামারি করোনার পর সবচেয়ে বড় বাধা।
হুথিদের হামলার ভয়ে ইউরোপ থেকে এশিয়াগামী জাহাজগুলো আর সুয়েজ খাল হয়ে লোহিত সাগর ও অ্যাডেন উপসাগর পার হতে পারছিল না। এর পরিবর্তে, তারা দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অফ গুড হোপ ঘুরে দীর্ঘ, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ পথে বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু করে। ফলাফল, গত দুই বছরে অ্যাডেন উপসাগর হয়ে জাহাজ চলাচল কমে যায় প্রায় ৭০ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার কয়েকজন মিত্র হুথিদের ঠেকাতে ইয়েমেনে পাল্টা বিমান হামলা শুরু করে। এই হামলা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মেয়াদের শেষ পর্যন্ত চলমান থাকে। তবে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েল ও প্রতিরোধ আন্দোলনের মধ্যে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময় এসব হামলাও স্থগিত থাকে। কিন্তু, যুদ্ধ আবার শুরু হলে হুথিরাও ফের সক্রিয় হয়। ইসরায়েলগামী জাহাজে নতুন করে হামলা চালানো শুরু করে।
এদিকে এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রও তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে ইয়েমেনে নজিরবিহীন বোমা হামলা শুরু করে। সাত সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এক হাজারেরও বেশি লক্ষ্যবস্তুর ওপর চালানো হয় তীব্র হামলা। লক্ষ্য ছিল, হুথিদের দমন করা ও ইসরায়েল কিংবা আমেরিকার স্বার্থে হামলা করা থেকে তাদের বিরত রাখা।
অবশেষে, ৭ মে ২০২৫-এ ওমানের মধ্যস্থতায় হুথি বিদ্রোহী ও যুক্তরাষ্ট্র একটি সমঝোতায় পৌঁছে। চুক্তি অনুযায়ী, হুথিরা বাণিজ্যিক জাহাজ ও মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা বন্ধে রাজি হয়, তবে ইসরায়েলি জাহাজ ও ইসরায়েলের অভ্যন্তরে তাদের হামলা অব্যাহত থাকবে। এর বদলে যুক্তরাষ্ট্রও ইয়েমেনে বোমা হামলা বন্ধে সম্মত হয়।
দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই সমুদ্রযুদ্ধে হুথিরা শুধু নিজেদের সামরিক অবস্থানই শক্তিশালী করেনি, তারা দেশীয় ও আরব বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অপ্রতিরোধ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিতিও পেয়েছে। অবশ্য এই অর্জনের মূল্য ছিল খুব চড়া। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রবল বিমান হামলায় ইয়েমেনের শহর, বন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহিদ হয়েছে অনেক বেসামরিক নাগরিক। তবুও, হুথি বিদ্রোহীরা পিছু হটেনি। যার ফলে, এই সমুদ্রযুদ্ধ তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব আরও দৃঢ় ও বিস্তৃত করেছে।
১৮ মাসের সমুদ্রযুদ্ধে কী পেল হুথি বিদ্রোহীরা
গত ১৮ মাসে হুথি বিদ্রোহীরা ২৫০টিরও বেশি সামরিক ও বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়েছে। পাশাপাশি তারা ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর ও সামরিক স্থাপনায় ড্রোন ও ব্যালেস্টিক মিসাইল দিয়ে একের পর এক হামলা চালিয়ে গেছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই-এর তথ্য মতে, এসব হামলার ফলে লোহিত সাগরে যে বিশাল বাণিজ্যিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, তা হুথিদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একধরনের রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাবকে সুদৃঢ় করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছে।
এই সামরিক অভিযান হুথিদের মতে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের সংহতির প্রকাশ। এই সংহতির প্রকাশ কখনও ছিল আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজে হামলার মাধ্যমে, আবার কখনও ছিল ইসরায়েলে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে। ইয়েমেনের বহু নাগরিক মনে করেন, হুথিরা ‘গাজার পাশে দাঁড়িয়ে সঠিক পক্ষে অবস্থান নিয়েছে’। আর এই ধারণাই হুথিদের জন্য একটি শক্তিশালী ঘরোয়া প্রচারণার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে হুথিরা নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সদস্য সংগ্রহে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। ইতালির আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা ISPI-এর বিশিষ্ট গবেষক এলিওনোরা আরদিমাগনি বলেন, ‘ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইকে ব্যবহার করে তারা নতুন যোদ্ধা নিয়োগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।’
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে হুথিদের যোদ্ধার সংখ্যা যেখানে ছিল ২ লাখ ২০ হাজার, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজারে। বিশেষজ্ঞ আরদিমাগনি বলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর তারা তরুণ ও কিশোরদের আরও বেশি করে টার্গেট করে প্রচারণা চালাচ্ছে। এজন্য তারা পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন, সামার ক্যাম্প আয়োজন এবং নানা উপায়ে সামরিক চেতনা ও যুদ্ধ পরিস্থিতির স্বাভাবিকীকরণ করছে।
এই যুদ্ধ হুথিদের শুধু জনপ্রিয়তা নয়, সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগও এনে দিয়েছে। তারা এই সময়ে যু্দ্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার ও পরীক্ষা করেছে। যেমন ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল, ড্রোন, এমনকি ড্রোনচালিত নৌকাও।
ইরানের উৎপাদিত অস্ত্র, নিজস্ব তৈরি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের সমন্বয়ে হুথিরা যুক্তরাষ্ট্রের বহু ব্যয়বহুল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে সফলভাবে। এতে তারা ‘প্রতিরোধ ফ্রন্ট’ নামে পরিচিত ইরান-সমর্থিত জোটে আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে এবং তার বাইরেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অর্জন করেছে সম্মান ও সমর্থন।
এই অভিযানের আরেকটি বড় অর্জন হলো, আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে বাস্তবভিত্তিক সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। আরদিমাগনি বলেন, ‘লোহিত সাগরে ধারাবাহিক এই হামলা তাদের ইরাক ও আফ্রিকান হর্ন অঞ্চলের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে। ফলে, অস্ত্রের বিনিময়ে পারস্পরিক সহযোগিতার মানচিত্র তৈরি হচ্ছে ভূমধ্যসাগর থেকে শুরু করে আরব সাগর পর্যন্ত।’
হুথিদের এই সংযোগ শুধু ইরান-ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সোমালিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আশ-শাবাব ও ইয়েমেনের আল-কায়েদার সঙ্গেও।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে রাশিয়াও হুথিদের সঙ্গে সামরিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিনিধিদলের সফর, ইয়েমেনে হুথি-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে রুশ গোয়েন্দা উপস্থিতি এবং রুশ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নৌ-চলাচল সংক্রান্ত তথ্যের আদান-প্রদান।
সব মিলিয়ে বলা যায়, দেড় বছরের সামুদ্রিক যুদ্ধ শুধু প্রতিরোধ নয়, বরং হুথিদের জন্য ছিল সামরিক সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, কৌশলগত সম্পর্ক ও স্থানীয় পরিসরে প্রভাব বিস্তারের একটি সফল কৌশল।
কেন পিছিয়ে গেলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
উত্তর ইয়েমেনের জাওফ অঞ্চলের হুথি সামরিক কমান্ডার আলি বিশ্বাস করেন, ইয়েমেনে হামলা চালিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন বড় একটি শিক্ষা পেয়েছেন।
মিডল ইস্ট আই-কে আলি বলেন, ‘যখন ট্রাম্প বিমান হামলা শুরু করেন, তখন তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন—তিনি আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। অথচ এখন তিনিই সেনাবাহিনীকে বিমান হামলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। ইয়েমেনের সঙ্গে যুদ্ধ কোনো সহজ অভিযান নয়।’
আলি জানান, গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে হুথিরা সাতটি মার্কিন এমকিউ-৯ ‘রিপার’ ড্রোন এবং দুটি এফ-১৮ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। এসব হামলা হয়েছে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হ্যারি ট্রুম্যানকে লক্ষ্য করে চালানো অভিযানের সময়।
আলি আরো বলেন, ‘ওয়াশিংটনে কেউ ভাবেনি যে, তাদের এত বড় ক্ষতি হতে পারে।’
তাইজ শহরে অবস্থানরত গবেষক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ আস-সামি বলেন, ‘লোহিত সাগরে হুথিদের চালানো হামলাগুলো তাদের একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এখন তারা কোন বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি প্রভাবশালী শক্তি।’
সাম্প্রতিক সময়ে হুথিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আকস্মিক সমঝোতা হয়েছে। এমনকি এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও প্রকাশ্যে হুথিদের দৃঢ়শক্তি ও সাহসের প্রশংসা করেন। হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা তাদের ওপর প্রবল আঘাত হেনেছি, কিন্তু তারা যে রকম সাহস দেখিয়েছে, তা অবিশ্বাস্য।
এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী দ্য আটলান্টিক মন্তব্য করেছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত হুথিদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে এবং ইসরায়েলকে একা ছেড়ে দিয়েছে।
এদিকে হুথিদের যুদ্ধ শেষ করার কোনো ইঙ্গিতও নেই। বরং তারা এক বিবৃতিতে হুঁশিয়ার করে বলেছে, ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলাগুলে বিনা জবাবে পার পেয়ে যাবে না। গাজার ব্যাপারে ইয়েমেন তার অবস্থান থেকে একচুলও নড়বে না।
অন্যদিকে ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকী একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে শিরোনাম দিয়েছে, ‘কীভাবে হুথিরা আমেরিকার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেখাল’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য যুদ্ধবিরতি ছিল এক ধরনের পালানোর পথ অর্থ্যাৎ একটি ব্যয়বহুল ও ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠা সামরিক অভিযান থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ভেতরও এ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছিল যে, দেশটি আবারও মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে।
এদিকে এটার সমর্থন করছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং প্রশাসনের সেই অংশ, যারা শুরু থেকেই বিদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং নতুন একধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতির (isolationism) পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ট্রাম্প যদি ইসরায়েলের ওপর চলমান হুথিদের হামলাকে উপেক্ষা করে চলেন, তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে, হুথিরা আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কোনো ধরনের হামলা চালাবে না। এমনকি মার্কিন বোমাবর্ষণ অব্যাহত থাকলেও, হুথিরা হয়তো দৃঢ়পদই থাকত। তবে যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় তাদের হাতে এখন কৌশলগতভাবে অনেক বাড়তি সুবিধা এসে গেছে।
ফরেন অ্যাফেয়ার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হুথি নেতারা এখন দাবি করতে পারেন, তারা সরাসরি একটি পরাশক্তির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে বিজয়ী হয়েছে। কিছুদিন আগেও মার্কিন বিমান হামলার চাপে তারা যে বিপর্যয়ের মুখে ছিল, এখন অনেকটাই সেই পরিস্থিতি থেকে তারা মুক্ত। ফলে হুথিরা এখন পুরো মনোযোগ দিতে পারছে ইসরায়েলের দিকে। ফলে, ইসরায়েল লক্ষ্য করে তারা প্রতিশোধমূলক হামলা চালাচ্ছে। এসব হামলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো তেলআবিব কাঁপিয়ে দেওয়া বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে হুথিদের ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হুথিদের হওয়া সাম্প্রতিক চুক্তির ফলে এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেন সরকারের—যা মূলত হুথি-বিরোধী বিভিন্ন বিভক্ত গোষ্ঠীর একটি জোট এবং দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে— পক্ষ থেকে হুথিদের বিরুদ্ধে কোনো স্থল অভিযান চালালে, ওয়াশিংটনের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
এদিকে দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এই চুক্তি হুথিবিরোধী ইয়েমেনি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও গভীর অসন্তোষ তৈরি করেছে। কেউ কেউ আশা করেছিলেন, মার্কিন চাপের মুখে হুথিরা ক্ষমতা ভাগাভাগির কোনো সমঝোতায় আসবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার আবার রাজধানী সানা’য় ফিরে যেতে পারবে। অন্যরা চেয়েছিল মার্কিন অভিযানের সম্প্রসারণকে কাজে লাগিয়ে হুথিদের বিরুদ্ধে নতুন করে স্থল হামলা চালাতে।
কিন্তু এখন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, এই অর্জনগুলোর পর হুথিরাই আক্রমণাত্মকভাবে এগিয়ে যাবে। কারণ, ইয়েমেনের অন্য কোনো বাহিনী এই মুহূর্তে হুথিদের সমতুল্য নয়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের পর থেকে হুথিদের যোদ্ধার সংখ্যা বারো গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ পঞ্চাশ হাজারে।বিপরীতে, তাদের প্রতিপক্ষরা আজও বিভক্ত, শৃঙ্খলাহীন এবং অনেকটাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়।
সবচেয়ে বিস্ময়কর দিকটি তুলে ধরেছে দ্য ইকোনমিস্ট। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—এই সংঘাতে ইসরায়েল কার্যত আমেরিকাকে পাশে পাচ্ছে না। মার্চ মাসে হুথিরা ইসরায়েলের ওপর হামলা শুরু করলে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে সক্রিয় হন। অথচ চুক্তিতে হুথিদের জন্য কোনো শর্ত রাখা হয়নি যে, তারা ইসরায়েলের ওপর হামলা বন্ধ করবে। হুথিরা পরিষ্কার ভাষায় বলেছে, যতদিন গাজায় ইসরায়েলি অবরোধ চলবে, তারা হামলা চালিয়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি হয়তো নেতানিয়াহুর প্রতি ট্রাম্পের হতাশার ইঙ্গিত, অথবা ইরানের সঙ্গে একটি বড় চুক্তির প্রস্তুতি। যেটাই হোক না কেন, এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েল ট্রাম্পের কৌশলগত সমীকরণ থেকে অনেকটাই ছিটকে পড়েছে।
প্রতিরোধের দায়ভাগ, যেভাবে মূল্য দিচ্ছে ইয়েমেন
লোহিত সাগরে হুথিদের সাম্প্রতিক অভিযান কারও কাছে সাহসী প্রতিরোধের নিদর্শন। আবার কারও চোখে এটিই ইয়েমেনের জন্য আরও এক নতুন দুঃস্বপ্নের সূচনা। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দরিদ্র এই দেশটি আগেই এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধের ভারে বিপর্যস্ত। ২০১৪ সালে হুথিরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সরকারকে রাজধানী সানা থেকে উৎখাত করলে দেশটি কার্যত ভাগ হয়ে যায়। বিদেশি সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন পক্ষের দখলে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে গোটা ভূখণ্ড।
গত বছর স্বল্পমেয়াদি একটি যুদ্ধবিরতির পরও স্থায়ী শান্তির পথে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। বরং লোহিত সাগরে সাম্প্রতিক উত্তেজনা নতুন করে সেই সম্ভাবনাকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে। রাজধানী সানার এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সালেহ তাহের মিডল ইস্ট আই–কে বলেন, হুথিদের ইসরায়েলবিরোধী অভিযান আমাদের জন্য এক নতুন সংকট তৈরি করেছে। এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পুরো একটি প্রজন্ম লেগে যাবে।
সানার আরেক বাসিন্দা সামি সামির ভাষায়, গাজায় বাস্তব পরিস্থিতি এতটুকু বদলায়নি। ইসরায়েলের বর্বরতা যেমন ছিল, তেমনই আছে। হুথিদের এসব আক্রমণে গাজাবাসীর কোনো উপকার হয়নি।
অভ্যন্তরীণভাবে ইয়েমেনকেও এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় প্রাণ গেছে বহু বেসামরিক মানুষের, আহত হয়েছে অনেকে, ভেঙে পড়েছে অবকাঠামো। হুথিরা জানিয়েছে, সানা বিমানবন্দরে সাম্প্রতিক এক ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ কোটি ডলার।
এদিকে, লোহিত সাগর এড়িয়ে বিকল্প পথে নৌবাণিজ্য পরিচালনার ফলে দেশটিতে খাদ্য সংকট আরও তীব্র হয়েছে। মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ইয়েমেনের কোটি কোটি মানুষের জন্য এটা এক নতুন দুঃসহ বাস্তবতা।
২০২৪ সালে সানা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ পরিচালিত এক জরিপ বলছে, ৭৬ শতাংশ ইয়েমেনি মনে করেন হুথিদের এই অভিযান দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের শান্তি-প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে। আঞ্চলিক কিছু মহলে হুথিদের অবস্থান যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের নিয়ে সংশয় ও অবিশ্বাস থেকেই যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আবারও হুথিদের ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে, যার ফলে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে বহুগুণে।
তবু ইয়েমেনের অনেকেই হুথিদের এই অবস্থানকে সমর্থন করছেন। তাঁদের মতে, এটা জলুমের বিরুদ্ধে একটি সাহসী জবাব। সানার বাসিন্দা আবদুল করিম বলেন, আমরা জানতাম এর মূল্য দিতে হবে। জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করা কখনোই সহজ কিছু নয়, কিন্তু আমরা হার মানিনি।
প্রতিরোধের এই পথ ইয়েমেনকে কোথায় নিয়ে যাবে—স্বাধীনতার দিকে, না আরও দীর্ঘতর সংকটের দিকে, সে প্রশ্নটাই এখন সবার সামনে।
সূত্র: অ্যারাবিক পোস্ট