মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

পূর্ব নোটিশ ছাড়াই অসহায় আফগানদের তাড়িয়ে দিচ্ছে ইরান

পূর্ব নোটিশ ছাড়াই লক্ষ লক্ষ অসহায় আফগানদের তাড়িয়ে দিচ্ছে ইরান
পূর্ব নোটিশ ছাড়াই লক্ষ লক্ষ অসহায় আফগানদের তাড়িয়ে দিচ্ছে ইরান

১৯৭৯ সাল। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন চলছে। বোমা, বন্দুক আর সহিংসতায় ছিন্নভিন্ন দেশ। সেই ভয়াবহ সময়ে হাজারো আফগান নাগরিক যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী দেশ ইরানে।

ইরানও সাড়া দেয় মানবিকতার ডাকে। সীমান্ত খুলে দেয়, আশ্রয় দেয় শরণার্থীদের। সেই হাজারো মানুষ সময়ের পরিক্রমায় রূপ নেয় কয়েক মিলিয়ন জনসংখ্যায়। ইরানের মাটিতে গড়ে তোলে জীবনের নতুন ঠিকানা, গড়ে তোলে স্বপ্নের নতুন আবাস।

বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ইরান ছিল আফগান শরণার্থীদের অন্যতম প্রধান আশ্রয়স্থল। যদিও এই সময়টা পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ ছিল না, তবু ইরানে অবস্থানরত আফগানদের জীবন ছিল তুলনামূলক নিরাপদ। তারা পেত শিক্ষা, চিকিৎসা, কাজের সুযোগ—সব মিলিয়ে একটা সম্মানজনক সহাবস্থান।

কিন্তু সময় এখন আর আগের মতো নেই।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগান শরণার্থীদের জন্য ইরান যেন পরিণত হয়েছে আতিথেয়তার মুখোশধারী এক অচেনা দেশে। রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক চাপে জর্জরিত ইরান এখন আর সেই উদার মনোভাব দেখাচ্ছে না। বরং বেড়েছে অব্যবস্থাপনা, জোরপূর্বক দেশে ফেরত পাঠানো এবং নানা ধরনের নিপীড়ন। একসময়ের আতিথেয়তাপূর্ণ স্মৃতিকে হার মানিয়েছে বর্তমানের তিক্ত বাস্তবতা।

সরকারের উদ্বেগ ও নানা জটিলতা

সম্প্রতি আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলানা আমির খান মুতাক্কি কাবুলে ইরানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, আফগান শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য ‘সুনির্দিষ্ট ও সংগঠিত একটি প্রক্রিয়া’ তৈরি করা জরুরি। কারণ, এভাবে হঠাৎ করেই যদি হাজারো মানুষকে ফেরত পাঠানো হয়, তা হলে শুধু তাদের সম্পদই ধ্বংস হবে না, আফগানিস্তানের ভিতরেও তৈরি হবে ভয়াবহ এক মানবিক ও সামাজিক সংকট।

আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার—তালেবান শাসিত ‘ইসলামি আমিরাত’—ইতোমধ্যেই নানা চাপের মধ্যে রয়েছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা, বেকারত্ব, স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা—এসব পরিস্থিতির মধ্যে নতুন করে হাজার হাজার মানুষ ফিরিয়ে দিলে তাদের মানসিক ও শারীরিক পুনর্বাসন যেমন কঠিন হয়ে পড়বে, তেমনি দেশের ভঙ্গুর অবকাঠামোর ওপরও চাপ বাড়বে বহুগুণ।

ফিরে আসার পথও যেন কাঁটায় ভরা

অবৈধপথে বা জোর করে ফেরত পাঠানো এসব মানুষ কেবল একটি নিরাপদ জীবনের আশায় পাড়ি জমিয়েছিল ইরানে। কেউ কেউ দোকান দিয়েছে, কেউ কাজ করেছে ইটভাটায়, কেউ আবার পড়াশোনা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকে তাদের জীবনের সবচেয়ে কর্মক্ষম সময়টুকু কাটিয়েছে সেখানে। এখন যদি তারা সবকিছু হারিয়ে ফিরে আসে, তবে তা শুধু একটি ব্যক্তির ক্ষতি নয়—বরং একটি রাষ্ট্রের ওপরও বিশাল সামাজিক চাপ তৈরি করবে।

এই প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগান সরকারকেও সামনে এগিয়ে এসে একটি ‘পুনর্বাসন পরিকল্পনা’ তৈরি করতে হবে। যেখানে থাকবে কর্মসংস্থান, আবাসন, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ—যাতে ফিরে আসা মানুষগুলো সমাজে আবারও সম্মানজনকভাবে মিশে যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছায়া

ইরান-ইসরায়েল সাম্প্রতিক উত্তেজনা এই শরণার্থী সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে। কিছু আফগান শরণার্থীর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে, যদিও তারা এমন অভিযোগ অস্বীকার করছে। প্রকৃতপক্ষে, এসব মানুষ শুধু বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। তারা রাজনীতি বোঝে না, গোয়েন্দা খেলা তো আরও নয়।

তারা শুধু চায়—একটি নিরাপদ আশ্রয়, এক মুঠো সম্মানজনক রুজি।

যে আশা এখনও বেঁচে আছে

যদিও পরিস্থিতি কঠিন, তবু আফগানরা এখনো আশাবাদী। তারা মনে করে, ইরান অতীতেও ধৈর্য ও সহানুভূতির পরিচয় দিয়েছে। এবারও তাই হবে। কারণ, দুই দেশের সম্পর্ক শুধু সীমান্তে সীমাবদ্ধ নয়। এই সম্পর্ক ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ও আত্মীয়তার সুতোয় গাঁথা। তাই বর্তমান সংকট যদি সুবিবেচনা, মানবতা ও যৌথ পরিকল্পনার মাধ্যমে মোকাবিলা করা যায়, তবে সেটি দুই দেশের মধ্যেই আস্থার সেতু গড়ে তুলবে।

শরণার্থী সমস্যা শুধু মানবিক ইস্যু নয়, এটি রাজনৈতিক দূরদর্শিতারও পরীক্ষা।
যে জাতি আশ্রয় দেয়, সে সম্মান পায়। আর যে জাতি মানুষকে সম্মান দিয়ে ফেরত পাঠায়, সে পায় কৃতজ্ঞতা। এখন দেখার বিষয়—ইরান কোন ইতিহাসের অংশ হতে চায়।

সর্বশেষ