মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

‘ভারতকে এমন শিক্ষা দিয়েছি, ওরা কোনোদিনও ভুলতে পারবে না’ 

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরীর বিশেষ সাক্ষাৎকার
‘আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচিতে হাত দেওয়ার সাহস কারও নেই’ : পাক সেনাবাহি
পাক সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আহমেদ শরীফ চৌধুরী। ছবি : আল জাজিরা

সম্প্রতি ভারতের চালানো হামলাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সফলভাবে প্রতিহত করেছে এবং ভারত তার নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তর—আইএসপিআর–এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী।

আল–জাজিরাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় বাহিনীকে এমন এক শিক্ষা দিয়েছে, যা তারা কোনোদিন ভুলবে না। এই যুদ্ধে আমাদের  সামরিক কৌশল আগামী কয়েক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে সামরিক শিক্ষাক্রমে পড়ানো হবে।

নিচে আল-আল জাজিরার ইসলামাবাদ প্রতিনিধির নেওয়া সাক্ষাৎকারটি পাঠকের জন্য তুলে দেয়া হলো।

প্রথমেই সরাসরি প্রশ্ন—সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধে কে জয়ী হলো ?

আমরা সব সময় বলি—এই লড়াই আমাদের, কিন্তু বিজয় একমাত্র আল্লাহর। তাই এই প্রশ্নের নিরপেক্ষ উত্তর খুঁজে পাওয়ার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশ্ববাসী এবং বিশ্লেষকদের ওপর বর্তায়।

এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আপনাকে যেতে হবে পাকিস্তানের রাজপথে, শহর থেকে শহরে। সেখানে আপনি দেখতে পাবেন—পাকিস্তানি জনগণের মুখে বিজয়ের হাসি, উচ্ছ্বাস ও উদযাপন। অর্থাৎ, জবাবটা একেবারেই স্পষ্ট।

কেন? কারণ এই সংঘাত কেবল সামরিক শক্তির প্রতিযোগিতা ছিল না। বরং এর পেছনে ছিল চিরাচরিত সত্য-মিথ্যার লড়াই। আর সেখানেই পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছে ভারতের তৈরি মিথ্যার জাল। পাশাপাশি উন্মোচিত করেছে তাদের স্বভাবজাত প্রতারণা, জবরদস্তি ও আগ্রাসনের মুখ ও মুখোশ।

এই যুদ্ধে ভারত একটি মনগড়া গল্প দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানের অবস্থান ছিল পরিষ্কার। যদি কোনো পাকিস্তানি নাগরিক এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকে—প্রমাণ দিন। সেটা হতে পারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে, কোনো নিরপেক্ষ সংস্থার কাছে, কিংবা তৃতীয় পক্ষের কাছে। যাতে করে একটি স্বচ্ছ তদন্ত করা সম্ভব হয়। কিন্তু ভারতের হাতে তখনও কোনো প্রমাণ ছিল না, এখনও নেই।

ভারত তাদের বিমানবাহিনীর সর্বোচ্চ প্রস্তুতি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ নিজেরাই সময় ও স্থান নির্ধারণ করে আক্রমণে নামে আর আমরা সেই আক্রমণ রুখে দিয়েছি, ছয়টি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছি। এখানেই আমাদের কৌশলগত সাফল্য প্রমাণিত হয়। আমরা তাদের এমন কঠিন জবাব দিতে পেরেছি, যেটা তারা কল্পনাও করেনি। বিশ্বের চোখের সামনেই লাইন অব কন্ট্রোলসহ একাধিক সীমান্ত চৌকিতে ভারতের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়ে এবং কোথাও কোথাও সাদা পতাকাও উড়তে ।

আমরা আক্রমণ করিনি, পাল্টা জবাবে রাতের অন্ধকারে কাপুরুষের মতো হামলাও করিনি। আমরা আগেই বলে দিয়েছিলাম—পাল্টা জবাব আসবে, তাই প্রস্তুত থাকো। আমরা ২৬টি টার্গেট নির্ধারণ করেছিলাম এবং প্রতিটিতেই নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ। 

তথ্য ও সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রেও আমরা ছিলাম স্বচ্ছ ও সত্যবাদী । আমরা সত্য বলেছি, মিথ্যা বানাইনি, তথ্য বিকৃত করিনি। আর একই সময়ে ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে গণমাধ্যম পর্যন্ত একের পর এক মিথ্যা ও বানোয়াট গল্প বানিয়ে গেছে। 

তাই আমাদের সংক্ষিপ্ত উত্তর—পাকিস্তানের জনগণের মুখের দিকে তাকান। তাহলেই বলতে পারবেন, কে বিজয়ী হয়েছে। 

আর বিস্তৃত উত্তর—আপনারা যেভাবে বিশ্লেষণ করতে চান, করুন। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাদের এমন এক বিজয় দিয়েছেন, যেটা আমরা উদযাপন করেছি শান্তির বার্তা দিয়ে। 

কিন্তু ভারত তো বলছে, এই যুদ্ধে তারাই বিজয়ী হয়েছে?

ভারতীয়রা তো কত কিছুই বলে। তারা বলছে—করাচি বন্দরে বোমা ফেলেছে, একাধিক পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান গুঁড়িয়ে দিয়েছে, এমনকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকেও নাকি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হয়েছে! তাদের হাইকমিশনার কিছু মানুষের ছবি দেখিয়ে দাবি করছিলেন—এরা সন্ত্রাসী। অথচ যাঁদের ছবি দেখানো হয়েছে, তাঁদের একজন নামাজ পড়াচ্ছিলেন, ছিলেন একেবারে সাধারণ একজন নাগরিক।

ভারত আরও বলছে, আমরা নাকি পারমাণবিক হামলা চালিয়েছি। কিছু একটা ঘটেছে বটে, কিন্তু তারা যেভাবে প্রচার করছে, সেটা মিথ্যা আর অতিরঞ্জনে ভরা। এখনই সময় বিশ্বের প্রযুক্তি খাতের মানুষদের হস্তক্ষেপ করার—এমন দাবি তোলাও শুরু করেছে তারা।

আসলে এসব নিছক মিথ্যাচার ছাড়া কিছু নয়। দায়িত্বশীল কোনো সংস্থা বা বিশ্বাসযোগ্য কোনো পক্ষের উচিত নয় এসব দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া। কারণ আমরা জানি—তাদের একটা সমস্যা আছে, আর সেটা হলো নিজেদের ওপর অতি আত্মবিশ্বাস।

এই আত্মবিশ্বাস আসে কোথা থেকে, বোঝা যায় না। ওদের ধারণা ছিল—পাকিস্তানে ঢুকে বেসামরিক এলাকায়, এমনকি মসজিদেও হামলা চালাবে, আর কিছুই হবে না। কোনো প্রতিক্রিয়া আসবে না। কেউ যেন তাদের বুঝিয়েছিল—পাকিস্তান সব সহ্য করবে, জবাব দেবে না।

তাই যখন বাস্তবে তাদের হিসাব ভুল প্রমাণিত হলো, তখন এমনসব আষাঢ়ে গল্প বানাতে শুরু করেছে। আর এতে তারা বেশ পটুও বটে। গণমাধ্যম, সিনেমা, থিয়েটার—এসব ক্ষেত্রে তারা অনেক এগিয়ে। তাই একটার পর একটা নতুন গল্প নিয়ে হাজির হচ্ছে। 

যেমন—গতকালই তারা বলছে, পাকিস্তান নাকি অমৃতসরের শিখদের পবিত্র স্বর্ণমন্দিরে হামলা চালিয়েছে। এর চেয়ে হাস্যকর আর কিছু হতে পারে?

আমরা আত্মরক্ষা করছি, পাঞ্জাব রক্ষা করছি। এই অঞ্চলের সব ধর্মীয় স্থান ও সব সম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা আছে। শিখদের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে, বন্ধুত্ব আছে, ভাষার মিল আছে। ধর্মীয় বা বেসামরিক স্থানে হামলা চালানো আমাদের স্বভাব নয়—এটা আমাদের বিশ্বাস, আমাদের ধর্মও এর অনুমতি দেয় না।

ভারতের উচিত আগে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে তোলা। আর সেটা করতে হয় সত্য বলার মধ্য দিয়ে। হাজারো ওয়েবসাইট বন্ধ করে, সংবাদমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, কিংবা সরকারের সমালোচনার কারণে মানুষকে জেলে পাঠিয়ে কোনো জাতি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারে না।

আর একবার ভাবুন—সাম্প্রতিক সংঘাতে পাকিস্তান কি কোনো সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে? না, করেনি। আপনারাও দেখেননি। কারণ আমরা এগুলো করি না। এটাই আমাদের বিশেষত্ব।

এই সামরিক সংঘর্ষে আসল ভূমিকা কি পাকিস্তান বিমান বাহিনী পালন করেছে ?

আমরা আমাদের পাইলটদের নিয়ে গর্বিত, গর্বিত তাদের কৃতিত্বের জন্য। সাম্প্রতিক এই সামরিক সংঘাতে আমরা দেখেছি স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর মধ্যে দারুণ সমন্বয়। একইভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে এবং পাকিস্তানি জনগণের মধ্যেও ছিল ঐক্য। একটি সুদৃঢ় প্রাচীরের মতো।

আমাদের একতা ছিল এক কঠিন ইস্পাতের প্রাচীরের মত। যা পাকিস্তান গড়ে তুলেছিল যেকোনো ভারতীয় আগ্রাসনের মোকাবেলায়। এই প্রাচীর ছিল অবিচল প্রতিরোধ— বশ্যতা চাপিয়ে দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের জনগণ, আমাদের কূটনীতিকেরা, গণমাধ্যম, সব দলের রাজনীতিক, সেনাবাহিনীর সব শাখা—বিমান, নৌ ও স্থলবাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ছিল একত্রে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। এবং নিঃসন্দেহে আমরা আমাদের বিমানবাহিনী নিয়ে গর্বিত।

পাকিস্তান বিমানবাহিনী যেভাবে ৬ ও ৭ মে রাতের আকাশযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তা দেখেছে পুরো বিশ্ব। আমি মনে করি, এ ঘটনাগুলো ভবিষ্যতে কয়েক দশক ধরে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হবে, বিশ্লেষণ করা হবে বিভিন্ন বিমানযুদ্ধ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ও আন্তর্জাতিক সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

পাকিস্তানি সামরিক অভিযান ‘বুন্-য়ানুম মারসুস’ এর তাৎপর্য কী?

আমরা এই নামটি নিয়েছি কুরআন থেকে—সূরা আস-সাফ থেকে। এর অর্থ হলো ‘ইস্পাতবেষ্টিত দেয়াল’, যা অশুভ শক্তির মোকাবিলা করে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই ইস্পাতবেষ্টিত দেয়াল গঠিত হয়েছে পাকিস্তানের জনগণ এবং সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বয়ে।

JF-17 থান্ডার পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কতটা শক্তিশালী করেছে?

যেকোনো নতুন সরঞ্জাম যুক্ত করার ক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত সচেতন ও নিরীক্ষাপূর্ণ মূল্যায়ন করি। সেটা JF-17 থান্ডার হোক, কিংবা J-8 ও J-10C যুদ্ধবিমান, প্রধান যুদ্ধ ট্যাংক, ভারী কামান, নৌবাহিনীর অস্ত্র কিংবা সাবমেরিন—সবক্ষেত্রেই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম।

কারণ, আমাদের হাতে ভারতের মতো বিপুল অর্থসম্পদ নেই। আমার জানা মতে, ভারত প্রতিরক্ষা খাতে বছরে ৮০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বরাদ্দ রাখে। কিন্তু, আমরা অত্যন্ত কার্যকর ও সূক্ষ্ম পরিকল্পনা তৈরি করি। আমরা অত্যন্ত সচেতনভাবে বাছাই করি—কী কিনব, কীভাবে ব্যবহার করব এবং আমাদের সামরিক কাঠামোর সঙ্গে কীভাবে তা একীভূত করব।

JF-17 থান্ডার ও এর CS সংস্করণ—আপনারা যেগুলোর সঙ্গে পরিচিত, সেগুলোর সঙ্গে মাটিতে প্রদর্শিত ‘৪১’ ও ‘৪২’ নম্বর ক্ষেপণাস্ত্র ছিল। এগুলো পাকিস্তানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে উন্নয়নকৃত কিছু অস্ত্রের উদাহরণমাত্র। এর অনেকগুলোই ইতোমধ্যে অস্ত্রভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে। এগুলো নমুনা মাত্র। এর বাইরেও আরও অনেক কিছু রয়েছে, যেগুলো এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

এই সংঘাতে আমরা আমাদের সব প্রচলিত বাহিনী মোতায়েন করিনি। কারণ, আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় বেলুচিস্তানে সক্রিয় রয়েছে। সেখান থেকে আমরা কোনো সেনা সরাইনি। একইভাবে আমরা আমাদের সব প্রযুক্তি বা সামরিক সক্ষমতাও প্রকাশ করিনি। আমাদের জবাব ছিল পরিমিত, সুপরিকল্পিত ও কৌশলনির্ভর। কারণ, সংঘাত কোন দিকে যাচ্ছে বা যাবে তা ছিল পুরো আমাদের নিয়ন্ত্রণে। 

আধুনিক আকাশযুদ্ধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ড্রোনের গুরুত্ব কী?

যুদ্ধের ধরন বদলে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোন, পরোক্ষ যুদ্ধ এবং তথ্যযুদ্ধ—এসব এখন আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা। চলমান সংঘর্ষে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে।

অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, ভারত এখনো যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ছায়াযুদ্ধ ও অনানুষ্ঠানিক মিলিশিয়াগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল। এসব প্রতিনিধিত্বশীল গোষ্ঠী এখনো সংঘাতপ্রবণ এলাকায় সক্রিয়, এবং ভারত সেগুলোকে সুচারুভাবে ব্যবহার করে আসছে।

আঞ্চলভিত্তিক আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীগুলো এখন এ ধরনের বৈচিত্র্যময় হুমকি মোকাবিলায় অনেক বেশি প্রস্তুত।

যুদ্ধবিরতির কারণ কী? কোনো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক শক্তি কি মধ্যস্থতা করেছে?

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো আন্তর্জাতিক পরাশক্তি এবং সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আমাদের মিত্র দেশগুলো খুব ভালো করেই বোঝে—দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ বেধে যাওয়া হবে চরম অবিবেচকের কাজ, যার পরিণতি হবে ধ্বংসাত্মক।

ভারত গত কয়েক বছর ধরেই যুদ্ধের ময়দান প্রস্তুতের চেষ্টা করছে। বলা  যায়, তারা যেন আগুন নিয়ে খেলছে।

এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান দেখিয়েছে দায়িত্বশীল আচরণ। পুরো সংঘাতের সময় আমরা ছিলাম উত্তেজনার গতিপথ নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষ। ৬ ও ৭ মে রাতেই আমরা চাইলে ছয়টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারতাম, কিন্তু তা করিনি। ওরা সম্মিলিত ড্রোন হামলা চালিয়েছিল, আমরা সবকটিই সফলভাবে ভূপাতিত করেছি।

ভারতের বেপরোয়া আচরণ দেখুন। তারা শুধু পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে নয়, এমনকি নিজেদের দেশের শিখ জনগোষ্ঠীর দিকেও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে—এটা ছিল তাদের সাজানো পরিকল্পনার অংশ। এই সংঘাতকে ঘিরে একটি বানোয়াট কাহিনি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চালিয়েছে তারা যুদ্ধর পুরো সময় জুড়ে।

৯ ও ১০ মে রাতেও তারা আমাদের বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়। তাদের দাবি ছিল—তারা ‘প্রতিরোধ’ করছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি—পাকিস্তানের জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীকে দমন করা কিংবা ভয় দেখানো যায় না। আমরা কখনো ভারতীয় দাপট বা হুমকির সামনে মাথা নত করিনি, করবও না।

১০ মে সকালে ‘বুন্-য়ানুম মারসুস’ অভিযানের সময় আমরা একটি বড় কিন্তু পরিকল্পিত ও ভারসাম্যপূর্ণ জবাব দিয়েছি। এটি ছিল ন্যায়সংগত প্রতিক্রিয়া, যার ফলে ভারত পিছু হটতে বাধ্য  হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র প্রকাশ্যে এসে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানান।

আমরা বললাম, ‘কেন নয়?’

আপনি কি মনে করেন, এই দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি টিকে থাকবে?

যুদ্ধবিরতির অর্থ হচ্ছে—দুই পক্ষ আপাতত একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই স্থগিত করেছে। কিন্তু প্রকৃত শান্তি তখনই আসবে, যখন ভারত তাদের যুদ্ধপ্রবণ রাজনৈতিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসবে। তাদের রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির মধ্যে সেরকম চিন্তাধারা বদ্ধমূল আছে, বলতে পারেন এক ধরনের বদ্ধ উন্মাদনা। এর ভিত্তিতে তারা বিশ্বাস করে—মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো একটি স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য ব্যাপার।

এই সমস্যা শুধু মুসলমানদের সঙ্গেই নয়, খ্রিস্টান, শিখ এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও। দেশজুড়ে প্রচুর নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। আপনারা জানেন।

ফলে যারা দমন-পীড়নের শিকার, তাদের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের এসব সমস্যার সমাধানে আগ্রহ নেই। বরং নিপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিরোধমূলক যেসব কার্যক্রম দেখা দেয়, সেগুলোকেই নিপীড়নের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে তারা। মূলত এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ সংকট।  কিন্তু বানোয়াট প্রচারণা ও ভিত্তিহীন উপর্যুপরি অভিযোগের মাধ্যমে পাকিস্তানকে দোষারোপ করে সেই সংকটকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দিতে চায় তারা। যতদিন না ভারত এই অভ্যন্তরীণ সংকটের প্রকৃত সমাধান করবে এবং কাশ্মীর সংকট—যা একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু, যেখানে পাকিস্তান, ভারত ও চীন তিনটি পক্ষই জড়িত—তা জাতিসংঘের প্রস্তাব ও জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে সমাধান করবে, ততদিন এই অঞ্চলে প্রকৃত শান্তি আসবে না।

ভারতের সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

শুধু একজন পাগলই ভাবতে পারে যে, সে ২৪ কোটি মানুষের পানির সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারবে। এটা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে।

বাস্তবতা হলো, কাশ্মীর থেকে ছয়টি নদীর উৎস, আর এই কাশ্মীর অঞ্চলটি জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী একটি বিরোধপূর্ণ এলাকা। দীর্ঘ আলোচনার পর, ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার অধীনে ছয়টি নদীর মধ্যে তিনটি নদীর পানি পাকিস্তানের জন্য এবং তিনটি নদীর পানি ভারতের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।

যদি ভারত এই চুক্তি মানতে অস্বীকার করে, তাহলে মনে রাখতে হবে—কাশ্মীর একটি বিরোধপূর্ণ অঞ্চল। ভবিষ্যতে যদি কাশ্মীরবাসীর ইচ্ছানুযায়ী কাশ্মীর পাকিস্তানে যোগ হয়, তাহলে এই ছয়টি নদীও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তখন ভারতের জন্য কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং আমরা দেখব, কীভাবে তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করা যায়। এটাই বাস্তবতা।

সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে চীনের সাথে আপনাদের অংশীদারত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

পাকিস্তান ও চীনের বন্ধুত্ব বহু দশকের পুরোনো। এই দুই দেশের মধ্যে বহুস্তরীয় অংশীদারত্ব রয়েছে। চীন, যেহেতু ভারতের প্রতিবেশী এবং এ অঞ্চলেরই অংশ, তাই ভারতের রাজনৈতিক এবং চরমপন্থী উপাদানগুলোর প্রকৃতি ভালোভাবেই বোঝে। 

আমি এর আগেও এই বিষয়ে সতর্ক করেছিলাম—এর পরিণতি কী হতে পারে এবং এই অঞ্চলে কী ঘটছে, তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছিলাম।

পাকিস্তান ও চীন এমন একটি বহুমুখী সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ, যার ভিত্তি একটি অভিন্ন ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। যার লক্ষ্য এই অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা।

আমরা, চীন এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশ শান্তির পক্ষে। কারণ বিশ্ব এখন দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পাকিস্তান এসব সংকট আরও গভীরভাবে অনুভব করছে।

এই সংকট মোকাবিলার জন্য আমাদের দরকার মানবকল্যাণভিত্তিক চিন্তা ও সমাধান। কিন্তু ভারতের মতো কিছু দেশ এখনো মনে করে, যুদ্ধ ও আগ্রাসনই সংকটের সমাধান। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, বিপজ্জনকও।

অন্যদিকে, পাকিস্তান, চীন ও অন্যান্য সহযোগী দেশগুলো এমন একটি সমাধান কাঠামো গড়ে তুলতে চায়, যা পাকিস্তানের জনগণের কল্যাণ ও উন্নয়নে সহায়ক। এটাই আমাদের কৌশল, এটাই আমাদের অবস্থান।

সাম্প্রতিক সংঘাতে ভারতের পাশে ইসরায়েলের ভূমিকা কী ছিল?

আমি ভারতীয়দের বলতে চাই—পাকিস্তান তার যুদ্ধ নিজেই লড়েছে, কাউকে ডেকে আনেনি। ভারতীয়দের মধ্যে যদি সামান্য আত্মমর্যাদাবোধ থেকে থাকে, তাহলে তাদেরও উচিত নিজেদের যুদ্ধ নিজেরাই লড়া। আমি শুধু এটুকুই বলি, সম্মান বজায় রেখে, দায়িত্বশীলভাবে নিজেদের যুদ্ধ ভারতীয়দের নিজেরাই পরিচালনা করা উচিত।

সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা কি বেড়েছে?

এই প্রশ্নটি করা উচিত পাকিস্তানের জনগণকে। তাদের মুখের দিকে তাকান, রাস্তায় যান, বাজারে যান, বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে যান—আপনি তাদের আবেগ বুঝতে পারবেন। শুধু সাম্প্রতিক ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নয়, বরং কারণ হলো—পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী গড়ে উঠেছে এই জনগণের মধ্য থেকেই। এদের কেউ এলিট শ্রেণি থেকে আসেনি।

তারা এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে—করাচি থেকে গাওয়াদার, খাইবার থেকে গিলগিট পর্যন্ত। এসেছে গ্রাম, শহর ও নগর থেকে। নানা ভাষাভাষী ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা একত্র হয়ে সেনাবাহিনীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করে।

পাকিস্তানের জনগণ ও তাদের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে রয়েছে এক গভীর, সুপ্রতিষ্ঠিত সম্পর্ক—সময়ের পরীক্ষায় বারবার যা প্রমাণিত হয়েছে। যারা সেনা পোশাক পরে দেশের জন্য লড়াই করে এবং জীবন উৎসর্গ করে, তাদের প্রতি এই সম্মান ও ভালোবাসা নিঃসন্দেহে অনন্য।

গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

আমি বলতে চাই—সেখানে যা ঘটছে, তা নিছক কোনো সংঘাত নয়, বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত গণহত্যা। এটি সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য এবং মানবতার বিবেকের ওপর এক স্থায়ী কালো দাগ। এই পরিস্থিতি আমাদের— পাকিস্তান এবং আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে—একটি বড় শিক্ষা দেয়, আত্মনির্ভর হতে হবে, নিজেদের শক্তি গড়ে তুলতে হবে এবং যারা আমাদের দুর্বল ভাবতে চায় বা হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে, তাদের সামনে দৃঢ় হয়ে দাঁড়াতে হবে।

এই কারণেই প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব—নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত থাকা এবং জাতির শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি করা। কারণ আজকের বাস্তবতা হলো—এই পৃথিবীতে কিছু বিকৃত ও ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক মানসিকতা আছে, যারা গণহত্যার মতো অপরাধও কল্পনা করতে পারে এবং বাস্তবায়ন করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। গাজায় যা ঘটছে, তা-ই তার উদাহরণ। একই রকম নিপীড়ন চলছে কাশ্মীরে মুসলমানদের ওপর, এমনকি ভারতের অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপরও।

একটা ধারনা আছে, যেখানে ধর্ম, জাত বা ডিএনএ-র ভিত্তিতে মানুষকে শ্রেষ্ঠ কিংবা অধম বিবেচনা করা হয়। মানবসভ্যতা কখনোই এই বিভাজনের পথ ধরে এগোয়নি। পাকিস্তান ও মুসলিম বিশ্ব এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্বকে কখনোই দেখে না। আমাদের নৈতিক বোধ ও জীবনচর্চা ভিন্ন, এবং অবশ্য মানবিক।

তাই যখন এমন নৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়, তখন দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়, সজাগ থাকতে হয়। পাকিস্তানের মানুষ প্রতিদিন সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে।

সূত্র: আল জাজিরা

সর্বশেষ