মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন সম্প্রতি সিরিয়ার ওপর থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো, নতুন প্রেসিডেন্ট আহমাদ আশ-শারার নেতৃত্বে সিরিয়াকে স্থিতিশীল হতে সহায়তা করা এবং সেই সাথে উদীয়মান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে কৌশলগত সুযোগ নেওয়া, যা যুক্তরাষ্ট্র-সিরিয়া সম্পর্কে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটাতে পারে।
তবে এই নীতিগত পরিবর্তনের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের মধ্যে এক স্পষ্ট মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।
একদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বকে একটি সম্ভাবনা হিসেবে দেখছে, ভবিষ্যতে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আশা করছে। অন্যদিকে, ইসরায়েল এখনো সিরিয়াকে একটি কৌশলগত হুমকি হিসেবেই বিবেচনা করে এবং দেশটিকে দুর্বল রাখতে আগ্রহী, এমনকি দেশটির ভেতরে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মাধ্যমে ফেডারেল কাঠামো তৈরির চিন্তা পর্যন্ত করছে।
এছাড়াও, ভিন্নমত শুধু সিরিয়ার নেতৃত্ব নিয়েই নয়—ট্রাম্প প্রশাসন সিরিয়ায় তুরস্ক ও সৌদি আরবের সক্রিয় অংশগ্রহণকে স্বাগত জানালেও, ইসরায়েল তুরস্কের উপস্থিতিকে হুমকি হিসেবে দেখছে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই ঘনিষ্ঠ মিত্রের মধ্যে এমন মতানৈক্য বিরল হলেও, ট্রাম্প প্রশাসনের চারটি প্রধান কৌশল থেকে এই মতপার্থক্যের কারণগুলো স্পষ্টভাবে বোঝা যায়:
১. সিরিয়াকে নতুন মিত্রে পরিণত করার সুযোগ
সিরিয়ার পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্রকে এমন একটি দেশের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ দিচ্ছে, যা দীর্ঘদিন ধরে তার বিরোধীপক্ষে ছিল। এই সম্পর্ক কেবল সিরিয়ার সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়, লেবানন ও ইরাকের মতো আশপাশের দেশগুলোতেও মার্কিন প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা তৈরি করছে। কিন্তু ইসরায়েল এখনো সিরিয়াকে অস্থিতিশীল রাখার পক্ষে, যা যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
২. আঞ্চলিক শক্তিগুলোর বৃহত্তর ভূমিকা চায় ট্রাম্প
ট্রাম্পের দৃষ্টিতে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি উপস্থিতি কমিয়ে এনে তুরস্ক ও সৌদি আরবের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মাধ্যমে কৌশলগত লক্ষ্য পূরণ করাই যুক্তিযুক্ত। এই কাঠামোর অংশ হিসেবে সিরিয়ার অন্তর্ভুক্তি একটি নতুন আঞ্চলিক ভারসাম্য তৈরি করতে পারে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র নেপথ্যে থাকলেও মূলত থাকবে নেতৃত্বে। কিন্তু ইসরায়েল এই পরিবর্তনের অংশ হতে অনাগ্রহী এবং এতে জটিলতা বাড়ছে।
৩. সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি
আহমাদ আশ-শারার সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে এক প্রকার সক্রিয় ভূমিকায় রয়েছে, যার উদ্দেশ্য সিরিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এই ভারসাম্য নষ্ট হলে পুনরায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যার সুযোগে আইএস (দায়েশ)-এর মতো উগ্র গোষ্ঠী ফিরে আসতে পারে। পাশাপাশি রাশিয়া ও ইরান হস্তক্ষেপ বাড়াতে পারে এবং ইসরায়েল-তুরস্ক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে। অথচ ইসরায়েলের বর্তমান অবস্থান এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
৪. সিরিয়া-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য
ট্রাম্প প্রশাসন চায়, আরও বেশি মধ্যপ্রাচ্য দেশ যেন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। এই প্রক্রিয়ায় সিরিয়াকে যুক্ত করা গেলে এক ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন সম্ভব। কিন্তু ইসরায়েল যদি নতুন সিরিয়ান সরকারকে দুর্বল রাখার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে, তবে এই উদ্যোগ ব্যর্থ হতে পারে—যা তাদের নিজের কৌশলগত স্বার্থেরও পরিপন্থী।
ইসরায়েলি নীতিতে নমনীয়তার ইঙ্গিত
ট্রাম্প প্রশাসনের এই নতুন কৌশলগত অবস্থানের কারণে ইসরায়েল ধীরে ধীরে তাদের অবস্থানে নমনীয়তা দেখাতে শুরু করেছে। এর তিনটি প্রধান লক্ষণ ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে:
১. সিরিয়ায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
২. নতুন সিরিয়ান সরকারের সঙ্গে পরোক্ষ সংলাপ শুরু করেছে ইসরায়েল।
৩. তুরস্কের সঙ্গে উত্তেজনা কমাতে সংলাপের পথে হাঁটছে ইসরায়েল।
তবে এই নমনীয়তা কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র-সিরিয়া সম্পর্ক কতটা গভীর ও স্থিতিশীল হয় তার উপর। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ছয় মাসের জন্য সাময়িকভাবে তুলে নিয়েছে—যা একপ্রকার পরীক্ষামূলক সময়কাল। এই সময়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত হলে ইসরায়েলকেও তার অবস্থান নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে হতে পারে।
বর্তমানে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতির পুরোটা বাস্তবায়ন হয়তো কঠিন, তবে সিরিয়াকে ঘিরে নতুন এক সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। তাতে আহমাদ আশ-শারার সরকার সাময়িক স্বস্তিতে আছে, অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের দিকে এগোচ্ছে এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষায় কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকায় তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে সহযোগিতার সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে, যেখানে শুধু সংঘর্ষ এড়ানোই নয়, বরং যৌথভাবে সিরিয়ায় কাজ করার পথও খোঁজা হচ্ছে। ট্রাম্প চান, সিরিয়া যেন নতুন আঞ্চলিক কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থাকবে প্রবল, কিন্তু সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকবে সীমিত।
সূত্র: আল জাজিরা