চার দশক ধরে চলা সশস্ত্র আন্দোলনের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়েছে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে)। সোমবার তুরস্কের একাধিক সংবাদমাধ্যম জানায়, সম্প্রতি দলের দ্বাদশ সম্মেলন শেষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পিকেকে-ঘনিষ্ঠ সংবাদ সংস্থা ‘ফিরাত’ জানায়, সংগঠনটি তাদের কাঠামো ভেঙে দিয়ে সব ধরণের সামরিক কার্যক্রম থেকে সরে এসেছে। সংগঠনের ভাষায়, তারা তাদের ‘ঐতিহাসিক দায়িত্ব’ পালন করে ফেলেছে।
‘ফিরাত’ আরও জানায়, কুর্দি রাজনীতির ভবিষ্যৎ এখন রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে। পিকেকে মনে করে, কুর্দি ও তুর্কিদের মধ্যকার সম্পর্ক পুনর্গঠনের প্রয়োজন রয়েছে।
সিরিয়ার কুর্দি পরিস্থিতির নতুন বাস্তবতা
সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুর্দি নেতৃত্বাধীন ‘সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস’ (এসডিএফ), যাকে কুর্দি ভাষায় ‘কাসাদ’ বলা হয়— এর অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র আল-জাজিরাকে জানিয়েছে, বাহিনীর প্রধান কমান্ডার হচ্ছেন মজলুম আবদি। তবে সামরিক কার্যক্রমের দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করছেন জিগার সোর। গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন কুর্দি নারী জিনদা।
সবশেষ নির্দেশনা আসে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির কাছ থেকে, যিনি ‘ডক্টর’ ছদ্মনামে পরিচিত এবং কন্দিল পাহাড়ে অবস্থান করছেন। জানা গেছে, এই পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া সিরিয়ান যোদ্ধারা দেশে ফিরতে পারলেও, বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। তুর্কি আরবভাষী নাগরিকদের সিরিয়ায় ‘মাকতুমি কাইদ’ অর্থাৎ অননুমোদিত নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, পিকেকে’র বিলুপ্তির পর বহু বিদেশি যোদ্ধা সিরিয়া ছেড়ে গেছে। বর্তমানে বেশিরভাগ সামরিক ইউনিট আরব কর্মকর্তাদের হাতে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে পিকেকে’র সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করতে পারে এসডিএফ, তবে শঙ্কা রয়েছে, যদি পিকেকে তুরস্কের সঙ্গে কোনো গোপন সমঝোতায় যায়, তবে সিরিয়ার কুর্দিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক রূপান্তরের পথে
সূত্র মতে, পূর্ব সিরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি বর্তমানে স্থিতিশীল। এসডিএফ-এ নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তি বন্ধ থাকায় বাহিনীর সদস্য সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। কুর্দি নিরাপত্তা বাহিনী ‘আসায়েশ’ এখন আর সামরিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে না; বরং তাদের একাডেমিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সিরিয়ান নিরাপত্তা বাহিনীতে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সরকারি দপ্তরগুলো পুনরায় চালুর লক্ষ্যে দামেস্ক থেকে প্রতিনিধি পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। রাক্কা অঞ্চলের কমান্ডার ‘অ্যানগিন’ ও তাবকা অঞ্চলের কমান্ডার ‘গারিবোজ’— উভয়েই সিরিয়ান কুর্দি। মজলুম আবদি পিকেকে’র বিলুপ্তির সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন এবং সূত্র মতে, এর পেছনে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থনও রয়েছে।
আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া ও তুরস্কের অবস্থান
তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্টির মুখপাত্র ওমর চেলিক বলেন, পিকেকে যদি সত্যিই নিজেদের বিলুপ্তি ঘোষণা করে, অস্ত্র জমা দেয় এবং সব অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করে, তবে এটি হবে এক ‘টার্নিং পয়েন্ট’।
তুর্কি বিষয়ক বিশ্লেষক তাহা ওদা ওগলু বলেন, সিরিয়ায় রাজনৈতিক সমাধানের অগ্রগতিই পিকেকে’র এই সিদ্ধান্তের পেছনে মূল চালিকাশক্তি। দুই পক্ষের (তুরস্ক ও কুর্দি) মধ্যে পারস্পরিক পদক্ষেপ প্রত্যাশিত। তিনি আরও বলেন, পিকেকে’র নেতা আবদুল্লাহ ওজালানের ভবিষ্যৎ এখনো তুরস্কের জন্য বড় প্রশ্ন।
তার মতে, কুর্দি ইস্যু এখন শুধুমাত্র তুরস্কের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়; বরং এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক জটিলতায় পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে সিরিয়ার ক্ষেত্রে।
এসডিএফ বা কাসাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
ওগলু মনে করেন, এসডিএফ ভেঙে ফেলা বা অস্ত্র জমা দেওয়া এখনো অনেক দূরের বিষয়। কারণ, বাহিনীটি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, বিশেষ করে আইএস বিরোধী অভিযানে। কাসাদকে সিরিয়ান বাহিনীতে একীভূত করার পথে গঠনগত অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা নির্ভর করছে তুরস্ক ও সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক পরিস্থিতির উপর।
সম্প্রতি দামেস্ক ও কাসাদ-এর মধ্যে জ্বালানি সম্পদ নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে, তবে মার্কিন উপস্থিতি থাকায় এই আলোচনার বাস্তব রূপ পাওয়া কঠিন।
তুরস্কের কৌশলগত সিদ্ধান্তও এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের সাম্প্রতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা এবং আমেরিকার প্রভাব সমন্বয়ে আঙ্কারা নতুন কৌশল নির্ধারণ করতে পারে।
সিরিয়ার জন্য সম্ভাবনার নতুন দরজা
ওগলুর মতে, উত্তর সিরিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে রাজনৈতিক অগ্রগতির পথ সহজ হবে এবং সিরিয়ার পুনর্গঠন সম্ভব হবে। এই স্থিতিশীলতা কুর্দিদের সঙ্গে সমঝোতার সুযোগ তৈরি করবে।
বিশ্লেষকদের মতে, পিকেকে’র বিলুপ্তির ফলে:
তুরস্কের পক্ষ থেকে এসডিএফ-এর উপর সামরিক চাপ কমবে;
সিরিয়ার কুর্দিদের জন্য রাজনৈতিক অংশগ্রহণের নতুন দরজা খুলবে;
পিকেকে সিরিয়া থেকে সম্পূর্ণ সরে গেলে এসডিএফ-এর তুর্কি অংশ নিষ্ক্রিয় হবে;
নতুন কুর্দি নেতৃত্ব গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হবে, যারা দামেস্কের সঙ্গে সহযোগিতায় আগ্রহী হবে।
বিকল্প চিত্র: সতর্ক বার্তা
বিশ্লেষক ফিরাস আলাউই মনে করেন, পিকেকে’র এই সিদ্ধান্ত সীমান্ত অঞ্চলের উত্তেজনা কমাতে সহায়তা করবে এবং তুরস্ক তার হস্তক্ষেপমূলক নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি পিকেকে’র নেতারা সিরিয়ার অভ্যন্তরে সামরিক নেটওয়ার্ক পুনর্গঠনের চেষ্টা করে, তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
তার মতে, যদি এসডিএফ-এর ভেতর কঠোরপন্থীদের প্রভাব কমে, তবে তুরস্ক কূটনৈতিকভাবে বেশি কার্যকর হতে পারবে। অন্যথায়, সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা থেকেই যাবে।
উল্লেখ্য, মার্চ মাসে দামেস্ক সরকার ও কাসাদ-এর মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে, যার আওতায় কাসাদ-কে নতুন সিরিয়ান সেনাবাহিনীতে একীভূত করা এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সূত্র: আল-জাজিরা