সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ—এই নামটা উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বিজয়ীর ছবি। যিনি কেবল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্তিম পরিণতি টেনেই থেমে যাননি, বরং ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখেছেন কনস্টান্টিনোপল জয় করে। গ্রীস, আনাতোলিয়া আর বলকান জয়ের পরও তাঁর বিজয়রথ থামেনি, বরং সে গড়িয়েছিল ইউরোপের হৃদয়ভূমি ইতালির সীমান্ত পর্যন্ত। কিন্তু এই বীর যোদ্ধার মৃত্যু ঘিরে রহস্য ও বিতর্ক আজও থামেনি।

মাত্র ৪৯ বছর বয়সে হঠাৎ করেই তিনি ইন্তেকাল করেন। শেষ জীবনে রিউম্যাটিজম ও গাউটের মতো একাধিক অসুখে ভুগছিলেন তিনি। তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যুই ইতিহাসবিদদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যা নিয়ে বিতর্ক আজও অব্যাহত।
৮৫৫ হিজরি, অর্থাৎ ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে, অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ, যিনি শক্ত হাতে সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছেন, জীবনের শেষ পর্বে দুনিয়াবিমুখ হয়ে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ছেড়ে দেন তাঁর কিশোর পুত্র মুহাম্মদের হাতে। এই মুহাম্মদই পরে ‘আল-ফাতিহ’ নামে ইতিহাসের মহানায়ক হয়ে উঠেন।
তবে বলকান অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সামরিক হুমকি সুলতান দ্বিতীয় মুরাদকে আবার সিংহাসনে ফিরতে বাধ্য করে। তিনি নিজের শেষ দিনগুলোতেও রাষ্ট্ররক্ষার দায়িত্ব পালন করে মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর একই বছর, মাত্র বিশ বছর বয়সে সুলতান মুহাম্মদ দ্বিতীয় বারের মতো অটোমান সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই যুদ্ধ, রাজনীতি আর রাজদরবারের নানা ঘটনা তাঁর চোখের সামনে ঘটেছে। বিশেষ করে কনস্টান্টিনোপল অবরোধের ব্যর্থ চেষ্টাগুলো তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন।
অল্প ক’দিনের মধ্যেই তরুণ এই সুলতান এক ঐতিহাসিক অভিযানে নামেন। বসফরাস প্রণালী পেরিয়ে, সুপরিকল্পিত এক সেনা অভিযানের মাধ্যমে তিনি ইসলামি বিশ্বের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করেন—কনস্টান্টিনোপল জয় করেন। এই বিজয়ের মাধ্যমে মুসলিম ও বাইজেন্টাইনদের শতাব্দীজুড়ে চলা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে।
এই অভিযান কেবল একটি সামরিক জয় নয়, বরং তা ছিল এক সভ্যতার বিজয়। আজও এই ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চমকপ্রদ অধ্যায় হিসেবে অধ্যয়ন করা হয়।
সুলতান থেকে মৃত্যুর শেষ অধ্যায়
কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ একের পর এক দুর্ধর্ষ ও চমকপ্রদ জয় ছিনিয়ে আনেন। তাঁর নেতৃত্বে উসমানীয় বাহিনী দ্রুতই বলকান অঞ্চল জয় করে ফেলে—গ্রিস, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি ছাড়িয়ে বিজয় ছড়িয়ে পড়ে ইতালীয় উপদ্বীপ পর্যন্ত।
জীবনের শেষ দুই বছরে উসমানীয় নৌবাহিনী দক্ষিণ ইতালির উপকূলে অবতরণ করে, রোমান বাহিনীকে পরাজিত করে, এবং রোম অভিমুখে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্তু ঠিক সেই সময়ই সবকিছু থেমে যায়—সুলতান মুহাম্মাদ আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর মাঝখানে ছিলেন, ইস্তাম্বুল থেকে খুব বেশি দূরে নয় এমন এক স্থানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।
সুলতানের ইন্তেকাল ঘটে ৮৮৬ হিজরি সালের সফর মাসে, অর্থাৎ মে ১৪৮১ সালে। তখন তিনি আনাতোলিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ‘যুল কাদির’ নামক একটি তুর্কোমান আমিরাত দখল করতে যাচ্ছিলেন। যদিও এই আমিরাত কার্যত স্বাধীন ছিল, তবু তা সিরিয়া ও মিশর নিয়ন্ত্রিত মামলুকদের আনুগত্যে ছিল।
সুলতানের শাসনকালের শেষদিকে মামলুকদের সঙ্গে উসমানীয় সম্পর্ক ক্রমেই টানাপোড়েনে জর্জরিত হয়। বিশেষ করে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর উসমানীয়দের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে যাওয়ায়, তিনি মামলুক-আধিপত্যাধীন তুর্কোমান আমিরাতগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে সেখানে উসমানীয় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালান।
তবে মুহাম্মাদ আল-ফাতিহের হঠাৎ মৃত্যু তিন দশকের টানা জয়যাত্রায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত সমাপ্তি টেনে দেয়। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন—যুবক বয়স থেকেই যিনি নিজেকে উসমানীয় সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন, যিনি এই সাম্রাজ্যকে এক বিশ্বশক্তিতে রূপান্তর করেছিলেন।
তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে রহস্যের জাল আজও কাটেনি। ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, এটি স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না—বরং তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। কিছু বর্ণনা অনুসারে, এই বিষক্রিয়া ঘটান তাঁর নিজস্ব চিকিৎসক ইয়াকুব পাশা, যিনি ছিলেন ইতালীয় বংশোদ্ভূত একজন ইহুদি।
সুলতান ফাতিহের মৃত্যু: ষড়যন্ত্রের জালে লারির ছায়া, না কি ইয়াকুবই ছিলেন মূল চর?
সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ-এর মৃত্যুকে ঘিরে ইতিহাস আজও রহস্যে মোড়ানো। ঘটনাটির শুরু তাঁর ইস্তামবুলের কাছের সামরিক শিবিরে। হঠাৎ করেই সুলতান পেটের প্রচণ্ড ব্যথায় ভুগতে থাকেন। এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েন যে ঘোড়ায় চড়াও সম্ভব হয়নি। অবশেষে তাঁকে একটি বিশেষ গাড়িতে করে সরিয়ে নেওয়া হয়। চিকিৎসকদের মধ্যে জরুরি বৈঠক বসে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন—সুলতানের পানীয় ও ওষুধের মাত্রা বাড়াতে হবে, ব্যথা কমানোর জন্য বিশেষ পানীয়ও দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই অবস্থার উন্নতি হয় না, বরং দ্রুত অবনতি ঘটে। একসময় সুলতান রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যু উপস্থিত সবার মধ্যে হতবাক ভাব ও সন্দেহের জন্ম দেয়।
যদিও অনেকেই ধারণা করেন, ফাতিহকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল, তবে খ্যাতিমান উসমানীয় ইতিহাসবিদরা—যেমন লুৎফি পাশা বা সুলাকজাদা—এই তত্ত্বে সরাসরি সায় দেননি। ফলে সুলতানের মৃত্যু আজও এক অপূরণীয় ধোঁয়াশা হয়ে আছে।
কিন্তু ঐতিহাসিক কিছু বিবরণ বলছে, মৃত্যুর আগ মুহূর্তে অটোমান প্রাসাদের অভ্যন্তরে ছিল গভীর উত্তেজনা। তখনকার প্রধানমন্ত্রী (উজিরে আজম) কারামানি মুহাম্মদ পাশা ও সুলতানের প্রিয় চিকিৎসক ইয়াকুব পাশার মধ্যে দাপট ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে চলছিল গোপন দ্বন্দ্ব। সুলতান যখন ইয়াকুব পাশাকে উচ্চপদে উন্নীত করে একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন, তখন সেটা ভালোভাবে নেননি কারামানি। নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে তিনি পুরনো চিকিৎসকদের—বিশেষ করে হামিদুদ্দিন লারি আজমিকে—পুনরায় সুলতানের ঘনিষ্ঠ চিকিৎসা-চক্রে ফিরিয়ে আনেন।
রোমাঞ্চকর তথ্য হলো, কিছু সূত্র বলছে লারি আজমি সুলতানের জন্য এমন ওষুধ দেন, যা তাঁর শরীরের জন্য উপযোগী ছিল না। ফলস্বরূপ, সুলতানের শরীর আরও দ্রুত ভেঙে পড়ে। অথচ এই সংকটে বিশ্বস্ত চিকিৎসক ইয়াকুব পাশার হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল, কিন্তু তিনি নীরব দর্শকের মতো শুধু পর্যবেক্ষণ করেই ক্ষান্ত থাকেন—যা একধরনের অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক আচরণ।
এই ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, সুলতানের মৃত্যু কাকতালীয় নয় বরং এটি একটি সুচিন্তিত ষড়যন্ত্র ছিল। কারামানি মুহাম্মদ পাশা ও লারি আজমি এতে জড়িত ছিলেন বলেই ধারণা করা হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সুলতানকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর দুই পুত্র—বায়েজিদ ও জেম-এর মধ্যে সিংহাসন নিয়ে সংঘাত বাধানো। পরে সেই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে কারামানি পাশা সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অনেকটাই নিজের হাতে নিয়ে নেন।
তবে এখানেই শেষ নয়। সমসাময়িক কিছু গবেষণায় এক নতুন ও বিতর্কিত তত্ত্ব উঠে আসে—এবার কাঠগড়ায় সুলতান ফাতিহ-এর প্রিয় চিকিৎসক ইয়াকুব পাশা। ইতালীয় বংশোদ্ভূত এই ব্যক্তি প্রথমে ইহুদি ছিলেন, পরে ইসলাম গ্রহণ করে অটোমান প্রশাসনে উচ্চপদে আসীন হন এবং ফাতিহ তাঁকে মন্ত্রীও নিযুক্ত করেন। কিন্তু কিছু গবেষক সন্দেহ করছেন, তাঁর ইসলাম গ্রহণ ছিল কেবল বাইরে দেখানোর জন্য। তিনি আসলে ছিলেন ইতালীয় বা ভেনিসীয় (বেনেডিক্স) গোয়েন্দা, যারা তখন অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
সুতরাং, ফাতিহ-এর মৃত্যুর দায় কাকে দেওয়া যায়—লারিকে, যিনি ভুল ওষুধ দিলেন? ইয়াকুবকে, যিনি নীরব থেকেও অনেক কিছু বোঝালেন? না কি পুরো ঘটনাটিই ছিল এক গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র? পুরো বিষয়টা আজও ধোঁয়াশা পূর্ণ।
ইতালি: অটোমানদের গোপন লক্ষ্য!
অটোমান বাহিনী সেই সময়ে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর ও তার দ্বীপপুঞ্জে নজরকাড়া সাফল্য অর্জন করে। এরপর তারা কৌশলগতভাবে দক্ষিণ ইতালির দিকে এগোয়। এ প্রসঙ্গে তুরস্কের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ইয়ালমাজ ওজতুনা তাঁর ‘দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য অটোমান সাম্রাজ্য’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ শুধু একজন বিজেতা নন, বরং তিনি স্বপ্ন দেখতেন একীভূত রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হওয়ার। তিনি কনস্টান্টিনোপল জয় করে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের (বাইজেন্টাইন) মুকুট অর্জন করেন, আর এবার তাঁর লক্ষ্য ছিল রোম—পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী।
অতএব, ইতালিতে অভিযান ছিল শুধু এক সামরিক অভিযান নয়; বরং এটি ছিল রোমান সভ্যতার প্রতীকী ঐক্য সাধনের একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক গবেষক মনে করেন—সুলতানের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছিল, যাতে নেতৃত্ব দেন ইয়াকুব পাশা। অনেকের ধারণা, এই চক্রান্তেরই ফল ছিল সুলতান ফাতিহের রহস্যময় মৃত্যু।
জীবনের শেষদিকে সুলতান ফাতিহ যে বিশাল সামরিক পরিকল্পনা হাতে নেন, তার অন্যতম ছিল ইতালি অভিযান। ১৪৭৯ ও ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দ (৮৮৪–৮৮৫ হিজরি) নাগাদ একটি সুসংগঠিত কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি হয়, যার পেছনে বরাদ্দ ছিল বিপুল বাজেট। এর নেতৃত্বে ছিলেন অভিজ্ঞ সেনানায়ক গেদিক আহমেদ পাশা। তাঁর অধীনে প্রায় ১৮ হাজার অটোমান সৈন্যকে পাঠানো হয় দক্ষিণ ইতালির উপকূলে।
তারা একে একে স্থানীয় দুর্গ ও ঘাঁটি দখল করে নেয়, নেপলসের রাজার বাহিনীকে পরাজিত করে এবং গোটা দক্ষিণ ইতালির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ১৪৮০ সালের শেষ নাগাদ, রোমের দরজাও তাদের জন্য খুলে যায়।
এই সময়, গেদিক পাশা সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহের কাছ থেকে নির্দেশ পান পরবর্তী বসন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। কারণ সুলতান নিজেই রোমা বিজয়ের জন্য অভিযানে নামার পরিকল্পনা করেছিলেন, যেখানে ইতালিতে অপেক্ষমাণ উসমানী বাহিনীর সঙ্গে একত্র হয়ে চূড়ান্ত আঘাত হানার কথা ছিল। তবে পরিস্থিতি হঠাৎ করেই পাল্টে যায়। সুলতান মমলুক সুলতানাতের সঙ্গে এক উত্তেজনাপূর্ণ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন, ফলে তার দৃষ্টি রোমার বদলে নিজ সাম্রাজ্যের ভেতরে আনাতোলিয়ার দিকে ঘুরে যায়, যেখানে তিনি প্রথমে অভ্যন্তরীণ ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন।
তবে কিছু ইতিহাসবিদের মতে, আনাতোলিয়ায় অগ্রযাত্রার এই ঘোষণা ছিল আসলে একটি কৌশলী ছলনা—এক ধরনের সামরিক ধোঁকা। উসমানী রাজনীতিতে এ ধরনের চালাকি বহু আগেই প্রতিষ্ঠিত ছিল, যা আগের অনেক সুলতান ব্যবহার করেছিলেন। সুলতান প্রথম সেলিম যেমন শাম ও মিশরের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় একই কৌশল নিয়েছিলেন।
এমন পরিস্থিতিতে, সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখনও তিনি ইস্তাম্বুলের কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন। তার এই আকস্মিক অসুস্থতা রাজসভায় এবং বিশেষ করে জেনেসারি বাহিনীর মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা ও সন্দেহের জন্ম দেয়।
সন্দেহের কেন্দ্রে ছিলেন রাজদরবারের চিকিৎসক ইয়াকুব পাশা। তিনি ইতালীয় বংশোদ্ভূত এবং পূর্বে ইহুদি ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ধারণা করা হয়, ইউরোপের শত্রু রাষ্ট্র—বিশেষ করে ইতালির—সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগ ছিল এবং অনেকেই মনে করেন তিনি সুলতানকে গোপনে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন। এই মতকে সমর্থন করেন বিখ্যাত উসমানী ইতিহাসবিদ আশিক পাশাজাদা, যিনি তার কবিতায় তীব্র ভাষায় অভিযোগ আনেন—‘রাষ্ট্র ও সুলতানের বিষয়ে প্রতিটি নীচু ইহুদির হস্তক্ষেপ’ নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তবে অন্যপক্ষে, আরেক উসমানী ইতিহাসবিদ আলী এই অভিযোগ খণ্ডন করেন এবং ইয়াকুব পাশার পক্ষে সাফাই দেন। তিনি বলেন, ইয়াকুব ও নতুন প্রধান মন্ত্রী বা উজিরে আজম কারামানি মুহাম্মদ পাশার মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণেই চিকিৎসায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ইয়াকুব যখন তার নিজের ওষুধ দিয়ে সুলতানকে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন, তখন প্রধান মন্ত্রী অন্য একজন চিকিৎসক—লারী আজমিকে চিকিৎসায় যুক্ত করেন। এই দুই চিকিৎসকের ওষুধে যে প্রতিক্রিয়া হয়, তা-ই সম্ভবত সুলতানের মৃত্যু ঘটায়।
আলী ইয়াকুব পাশার পক্ষে বলেন, ‘তিনি ছিলেন তার যুগের সক্রেটিস ও হিপোক্রেটিস’—এই উক্তির মাধ্যমে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইয়াকুবের দক্ষতা ও সম্মানজনক অবস্থান তুলে ধরেন এবং তাকে সুলতানের মৃত্যুর জন্য দায়ী করার অভিযোগ নাকচ করে দেন।
একদিকে কিছু ইতিহাসবিদ দাবি করেন, সুলতানের মৃত্যুর পরই ক্ষুব্ধ, জেনেসারিরা ইয়াকুব পাশাকে হত্যা করে। কিন্তু কিছু ভিন্নমত রয়েছে যা এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে। যেমন, গবেষক আহমেদ আখ কুন্দুজ তার বই ‘দ্য আননোন অটোমান স্টেট’-তে উল্লেখ করেন, ইয়াকুব পাশা সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ-এর শাসনামলেও একই পদে বহাল ছিলেন। তিনি বলেন, ‘যদি তাকে সত্যিই হত্যা করা হতো, তাহলে দ্বিতীয় বায়েজিদ-এর আমলে তিনি আর দায়িত্বে থাকতেন না।’ তাই তার মতে, ইয়াকুবের ওপর হত্যার অভিযোগ সন্দেহজনক ও প্রমাণহীন।
জার্মান ইতিহাসবিদ ফ্রানৎস বাবিঞ্জার তাঁর বই ‘সুলতান মেহমেদ দ্য কনকারর অ্যান্ড হিজ এজ’-এ দাবি করেন, সুলতানের চিকিৎসক ইয়াকুব ছিলেন ভেনিসবাসীদের হয়ে কাজ করা একজন গুপ্তচর। তবে তুর্কি ইতিহাসবিদ আখ কুন্দুজ এই দাবি নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাঁর মতে, ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিলপত্র বিশ্লেষণ করলে এ অভিযোগের পক্ষে তেমন কিছুই পাওয়া যায় না, বরং তা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। কুন্দুজ স্পষ্ট করে বলেন, এই ঘটনার চূড়ান্ত সত্য আজও অজানাই রয়ে গেছে—কারণ ‘অদৃশ্য বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই সব জানেন’।
বাবিঞ্জার অবশ্য সন্দেহের তালিকায় আরও একটি নাম যুক্ত করেছেন—আরেক চিকিৎসক হামিদউদ্দিন আল-লারি। তিনি ছিলেন ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমের লারিস্তান অঞ্চলের বাসিন্দা। বাবিঞ্জার লেখেন, ফাতিহের অসুস্থতার শুরুতেই এই পারস্যের চিকিৎসক তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু ফাতিহের জীবনের শেষ পর্বে তাঁর ভূমিকা নিয়েও ব্যাপক সন্দেহ তৈরি হয়। তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে ব্যর্থ হন। এমনকি তাঁর মৃত্যুও রহস্যময় বলে ধরা হয়। বলা হয়, তিনি ১৪৮৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এদিরনেতে মারা যান, যেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে একটি মসজিদ নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন (যা পরে ১৫১৪ সালে শেষ হয়)। তখনকার জনশ্রুতি অনুযায়ী, তাঁকে সুলতান দ্বিতীয় বাইয়াজিদ এর নির্দেশে জোর করে অতিরিক্ত আফিম খাওয়ানো হয়, যা তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়।
অন্যদিকে, খ্যাতিমান তুর্কি ইতিহাসবিদ ইলবের ওর্তায়লি তাঁর একটি প্রবন্ধে—‘যদি তিনি ৪৯ বছর বয়সে মারা না যেতেন’—এই ঘটনা সম্পর্কে বলেন, এটি এখনও উসমানি ইতিহাসের অন্যতম রহস্যঘেরা ও বিতর্কিত অধ্যায়। ওর্তায়লি নিজেও বিশ্বাস করেন যে সুলতানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর মতে, ইতালিয়ান চিকিৎসক ইয়াকুব পাশা, যিনি সুলতানের নিঃসন্দেহ আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন, ফাতিহের গেঁটে বাত রোগসহ নানা শারীরিক সমস্যার বিস্তারিত জেনে সুযোগ নিয়েছিলেন। হয়তো ইতালীয় ও ভেনিসীয়দের হুমকিতে, অথবা লোভের বশে, তিনি সুলতানকে গোপনে বিষপ্রয়োগ করেন।
ওর্তায়লি মনে করেন, সুলতান ফাতিহের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল এই চিকিৎসকের ওপর অন্ধ বিশ্বাস করা—যেটা তাঁর জন্য ডেকে আনে এক রহস্যময় ও আকস্মিক পরিণতি।
অবশেষে, সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ দুনিয়া ছাড়েন, কিন্তু পেছনে রেখে যান এক বিশাল সামরিক ও প্রশাসনিক উত্তরাধিকার। তিনি কনস্টান্টিনোপল জয় করে ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে ওঠেন। বাইজান্টাইনের শেষ কিছু রাজ্য যেমন ত্রাবজোন দখল করেন, সার্বিয়া, বসনিয়া, আলবেনিয়া অধিকার করেন, এবং আনাতোলিয়ার ভেতরের অঞ্চলগুলো নিজের শাসনে আনেন। বলকান অঞ্চলজুড়ে তাঁর প্রভাব বাড়ে—গ্রিস, হাঙ্গেরি ও দক্ষিণ ইতালির অংশ পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়। তবে তাঁর মৃত্যুর পর পশ্চিমা শক্তিরা কিছু অঞ্চল পুনরুদ্ধার করে। পরে তাঁর নাতি সুলতান সুলায়মান আল-কানুনি সেই ধারাবাহিকতায় রোডস দ্বীপ জয় করেন।
এভাবেই, সুলতান ফাতিহের মৃত্যু আজও ইতিহাসের এক রহস্যময় অধ্যায় হয়ে আছে। তাঁর অগণিত সাফল্য সত্ত্বেও, মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিতর্ক চলছেই—আর হয়তো চলবে, যতদিন না গবেষণায় স্পষ্ট প্রমাণ সামনে আসে, যা এই গূঢ় পরিণতির পর্দা তুলে ধরবে।
সূত্র: আল-জাজিরা ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট