মোগাদিশু, সোমালিয়া:
সোমালিয়ার সমুদ্র সীমা থেকে উত্তোলিত তেল ও গ্যাসের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব তুরস্ক পাবে—সম্প্রতি এমন এক চুক্তি প্রকাশ্যে আসায় ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবার নর্ডিক মনিটর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই তুর্কি পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (TPAO) ও সোমালি পেট্রোলিয়াম কর্তৃপক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত এ হাইড্রোকার্বন চুক্তির আওতায়, তুর্কি কোম্পানিটি ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে তিনটি অফশোর ব্লকে অনুসন্ধান ও উৎপাদনের একচেটিয়া অধিকার পেয়েছে। নর্ডিক মনিটর প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, এই বিপুল সম্পদের রাজস্ব থেকে সোমালিয়া পাবে মাত্র ৫ শতাংশ।
চুক্তির ৪.৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, তুরস্ক ‘ব্যয়বহুল পেট্রোলিয়াম’ ব্যবস্থার আওতায় বাৎসরিক উৎপাদনের ৯০ শতাংশ অধিকার পাবে। এর মাধ্যমে অনুসন্ধান ও উৎপাদন ব্যয়ের টাকা আদায়ের সুযোগ থাকবে তাদের। তুরস্কই এ খাতে বিনিয়োগ করবে, আর সোমালি সরকার থাকবে কেবল অংশীদার হিসেবে।
চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। বছরের শুরুতে এ চুক্তি অনুমোদনকারী সোমালি আইনপ্রণেতাদের কয়েকজন নর্ডিক মনিটরকে বলেন, তাঁরা কখনো চুক্তির মূল নথি দেখেননি। এতে স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। সোমালি সরকারি কর্মকর্তারা এখনো এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি।
বিশেষজ্ঞ ও কূটনীতিকদের মতে, চুক্তিটি পুনঃমূল্যায়ন না করা হলে সোমালিয়ার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকিতে পড়তে পারে। কারণ দেশটিতে আনুমানিক ৩০ বিলিয়ন ব্যারেল অব্যবহৃত তেলের মজুত রয়েছে। নাইরোবিভিত্তিক এক জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ‘এই চুক্তি সোমালিয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।’ তিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
এই চুক্তিকে তুরস্ক-সোমালিয়া কৌশলগত অংশীদারিত্বের অংশ হিসেবেও দেখা হচ্ছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা স্মারকলিপিতে তুরস্ক সোমালিয়ার নৌবাহিনী পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ সহযোগিতা সোমালিয়ার একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৩০ শতাংশ রাজস্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
৭ মার্চ, ২০২৪ তারিখে ইস্তাম্বুলে যৌথ অফশোর অনুসন্ধান নিয়ে একটি রূপরেখা নির্ধারিত হয়, যার ধারাবাহিকতায় ২৫ অক্টোবর অনশোর হাইড্রোকার্বন প্রকল্প নিয়েও চুক্তি হয়।
তুরস্কের ভূকম্পন জরিপ জাহাজ ওরুচ রেইস গত বছরের ২৫ অক্টোবর সোমালিয়া উপকূলে সাত মাসব্যাপী অভিযান শুরু করে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্লকগুলিতে থ্রিডি জরিপ চালায় জাহাজটি। এক্স-এ প্রকাশিত তথ্যমতে ইতিমধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তুরস্কের জ্বালানিমন্ত্রী আলপারস্লান বায়রাক্টার জানান, প্রাথমিক তথ্যগুলো উল্লেখযোগ্য মজুদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। পরবর্তী ধাপে একটি ড্রিলিং জাহাজ পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
মোগাদিশুতে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি, বন্দর ও বিমানবন্দর পরিচালনা এবং এখন হাইড্রোকার্বন চুক্তি—সব মিলিয়ে সোমালিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে তুরস্কের সক্রিয়তা বাড়ছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এটি তুরস্কের আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের কৌশলের অংশ, বিশেষ করে ইথিওপিয়ার মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবেলায়।
তবে, সোমালিল্যান্ড ইস্যুতে ইথিওপিয়ার সঙ্গে চলমান উত্তেজনা এবং ওই জলসীমায় তুর্কি জাহাজের চলাচলে সোমালিল্যান্ডের নিষেধাজ্ঞা নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
চুক্তির শর্তাবলী নিয়ে উঠা প্রশ্ন এবং সোমালিয়ার প্রাপ্তির হার এ বিষয়কে ঘিরে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্নও সামনে এনেছে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে অগ্রসর হওয়ার পাশাপাশি এখন দেশটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে—এই চুক্তি আদৌ কতটা ন্যায্য?
সূত্র: গ্যারো অনলাইন