সম্পূর্ণ বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান চলবে—এমনটাই ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। শনিবার এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, হামাসের সামরিক ও বেসামরিক সক্ষমতা ধ্বংস না করা পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ হবে না। গাজা গণহত্যা ১৯তম মাসে পা রাখতেই তিনি এই মন্তব্য করলেন।
নেতানিয়াহু বলেন, যুদ্ধ বন্ধের শর্তে হামাস ইসরায়েলের জীবিত অর্ধেক বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি একে “অগ্রহণযোগ্য শর্ত” হিসেবে অভিহিত করেন।
একই সঙ্গে নেতানিয়াহু জানান, লেবানন ও সিরিয়ার ভেতরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যে “নিরাপত্তা অঞ্চল” গড়ে তুলেছে, তা আগামীতেও বহাল থাকবে। এ ধরনের পদক্ষেপকে নিজেদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে লেবানন ও সিরিয়া, এবং তারা এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
অন্যদিকে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় ইসরায়েলের ভেতরে ক্ষোভ বাড়ছে। যুদ্ধ থামানো এবং কূটনৈতিকভাবে বন্দি মুক্তির আহ্বানে সেখানকার সাবেক সেনা, রিজার্ভ সদস্য ও সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে। বিরোধীরা বলছে, এই যুদ্ধ নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার।
গাজা থেকে এক বিবৃতিতে হামাসের শীর্ষ নেতা খলিল আল-হাইয়া সতর্ক করে বলেছেন, আংশিক চুক্তিগুলো আসলে ইসরায়েলের যুদ্ধ দীর্ঘ করার কৌশল মাত্র। তিনি জানান, হামাস একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তিতে যেতে প্রস্তুত—যেখানে যুদ্ধবিরতি, দখলদার বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, অবরোধ তুলে নেওয়া এবং গাজা পুনর্গঠনের বিনিময়ে সব বন্দিকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে।
নেতানিয়াহু আরও বলেন, হামাসের শাসন অব্যাহত থাকলে ৭ অক্টোবরের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। তিনি বলেন, “সব বন্দিকে ফিরিয়ে আনা এবং গাজাকে ভবিষ্যতে হুমকি হিসেবে গড়ে ওঠা থেকে ঠেকানো ছাড়া যুদ্ধ শেষ হবে না।”
তিনি দাবি করেন, হামাস এমন আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তা চাইছে, যাতে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া সীমিত হয়ে যায়। নেতানিয়াহু এটিকে “ইসরায়েলকে পঙ্গু করার” প্রচেষ্টা বলে আখ্যা দেন।
এদিকে, ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ এক্স-এ ( টুইটার) এক পোস্টে গাজা পুরোপুরি দখল করে সেখানে সামরিক শাসন চাপানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “হামাস ধ্বংস এবং গাজার স্থায়ী হুমকি দূরীকরণই হওয়া উচিত যুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্য।”
স্মোত্রিচ এর আগেও বহুবার গাজা দখল ও ফিলিস্তিনিদের সেখান থেকে উৎখাতের আহ্বান জানিয়েছেন।
শনিবারই নেতানিয়াহুর মুখপাত্র ওমের দোস্ত্রি জানান, গাজা থেকে সব বন্দিকে একসঙ্গে ফিরিয়ে আনা বর্তমানে সম্ভব নয়। ইসরায়েলি হিসাব অনুযায়ী, এখনো ৫৯ জন বন্দি গাজায় রয়েছেন, যাদের মধ্যে ২৪ জন জীবিত।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতির আংশিক চুক্তি হলেও মার্চে ইসরায়েল ফের হামলা শুরু করে, ফলে চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়ন হয়নি।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউয়াভ গালান্ত বলেছেন, গাজা উপত্যকায় ব্যাপক উচ্ছেদের অংশ হিসেবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সেখানে একাধিক “নিরাপত্তা অঞ্চল” ঘোষণা করেছে, যা সাময়িক কিংবা স্থায়ী—দুই ধরনেরই হতে পারে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এসব ঘোষণার ফলে গাজার প্রায় ৬৬ শতাংশ এলাকায় সাধারণ ফিলিস্তিনিদের প্রবেশ কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া চলমান যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত ও আহত হয়েছেন, যাদের বড় একটি অংশ নারী ও শিশু। নিখোঁজ রয়েছেন ১১ হাজারের বেশি মানুষ। জাতিসংঘ ও ফিলিস্তিনি বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল এই যুদ্ধে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এসব লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের আন্তর্জাতিক বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও উঠেছে বিশ্বজুড়ে।
সূত্র: টিআরটি