মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

‘আমার কোড যেন কোন শিশুর মৃত্যুর কারণ না হয়’ : মাইক্রোসফটের নারী প্রকৌশলীর প্রতিবাদে উত্তাল প্রযুক্তি দুনিয়া

ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় বরখাস্ত ইবতিহালের পাশে মিশর
ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় বরখাস্ত ইবতিহালের পাশে মিশর

‘আমার সবচেয়ে বড় ভয় হলো, যদি কোনো দিন জানতে পারি আমার লেখা কোড দিয়ে কোনো শিশু মারা গেছে!’—এই কথাটা বলেছেন এক সাহসী তরুণী ইবতিহাল আবু সাদ। তিনি একজন মেধাবী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। জন্ম মরক্কোতে, পড়াশোনা করেছেন আমেরিকার বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) নিয়ে কাজ শুরু করেন মাইক্রোসফট কোম্পানিতে।

প্রথমদিকে সব ঠিকই ছিল। কিন্তু একসময় তিনি জানতে পারেন, মাইক্রোসফটের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। যেসব ড্রোন গাজায় বোমা ফেলছে, কিংবা যেসব সিস্টেম দিয়ে নিরীহ মানুষকে নজরদারি করে টার্গেট করা হচ্ছে—তার পেছনে মাইক্রোসফটের প্রযুক্তি ও কোড রয়েছে। আর এসব দিয়েই হামলা চালানো হচ্ছে গাজার মানুষের ওপর। এই খবরে ইবতিহাল ভীষণ কষ্ট পান। মনে মনে এক ভয় তাকে তাড়া করে বেড়াতে থাকে। তিনি বলেন— যদি একদিন ঘুম থেকে উঠে জানতে পারি, আমি যে সফটওয়্যার বানিয়েছি, সেটা দিয়েই একটা শিশু মেরে ফেলা হয়েছে—তাহলে আমি কীভাবে নিজেকে ক্ষমা করব? এই কথাগুলো বলেছিলেন মরক্কোর তরুণী ইবতিহাল আবু সাদ। সম্প্রতি তিনি আলোচনার কেন্দ্রে এসেছেন ভিন্ন এক কারণে—এক সাহসী প্রতিবাদ।

ঘটনা মাইক্রোসফটের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে। কোম্পানির এআই বিভাগের প্রধান মুস্তাফা সুলেইমান মঞ্চে বক্তব্য দিচ্ছেন। হঠাৎ করেই তাকে থামিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যান ইবতিহাল। গলা উঁচু করে বললেন, কীভাবে আমরা উৎসব করি, যখন আমাদের প্রযুক্তি দিয়ে গাজার মানুষ মেরে ফেলা হচ্ছে?

হঠাৎ থেমে গেল অনুষ্ঠান। চারপাশে নেমে এল স্তব্ধতা। চমকে উঠেছিল পুরো অডিটোরিয়াম। মাইক্রোসফটের জাঁকজমকপূর্ণ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী চলছিল। আর ঠিক তখনই সাহস করে উঠে দাঁড়ান ইবতিহাল আবু সাদ। তার প্রতিবাদের সুরে মুহূর্তেই বদলে যায় পুরো পরিবেশ। পরে নিরাপত্তাকর্মীরা এসে তাকে ও তার সহকর্মী ভানিয়া আগরওয়ালকে হল থেকে বের করে দেয়। শুধু তাই নয়, দুজনের মাইক্রোসফট অফিস অ্যাকাউন্টও বন্ধ করে দেওয়া হয়। মানে, পরোক্ষভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়—তাদের চাকরি শেষ।

কিন্তু এখানেই থামেননি ইবতিহাল। বরং আরও জোরালো কণ্ঠে বলে ওঠেন—আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিতে পারে, অপমান করতেও পারে। কিন্তু কোনো কিছুতেই আমি এতটা ভয় পাই না, যতটা ভয় পাই এটা ভেবে—আমি এমন একটি প্রযুক্তি বানাচ্ছি, যেটা দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। এই কথায় ছিল একজন প্রকৌশলীর বিবেকের ঝাঁপসা কান্না। সাহস করে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, যখন চারপাশ নীরব।

ইবতিহাল আবু সাদের জন্ম ১৯৯৯ সালে, মরক্কোর রাজধানী রাবাতে। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী ও উদ্যমী। স্কুলজীবনে বিজ্ঞান আর গণিতে দারুণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। আর সেই পথ ধরেই ২০১৭ সালে তিনি স্কলারশিপ পান যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পড়াশোনা করেন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) নিয়ে। স্নাতক শেষ করে ২০২২ সালে তিনি যোগ দেন বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটে। কাজ করছিলেন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দলে—ক্লাউড সেবা, নজরদারি ব্যবস্থা ও তথ্য বিশ্লেষণ সংক্রান্ত নানা প্রকল্পে।

সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু একদিন আচমকা যেন ভেতরে একটা ঝাঁকুনি লাগল। তিনি বুঝতে শুরু করলেন—যে কাজ তিনি করছেন, সেই প্রযুক্তি হয়তো ব্যবহৃত হচ্ছে সরাসরি সহিংসতায়। তিনি বলেন, আমাকে কেউ বলেনি, এই কোডগুলো একদিন বিক্রি হবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে। কেউ বলেনি, আমার প্রযুক্তি ব্যবহার হবে ডাক্তার, সাংবাদিক আর অসহায় পরিবারগুলোকে হত্যা করার কাজে—এই উপলব্ধি তার ভিতরে এক ভয় আর অনুশোচনার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় প্রতিবাদ।

মাইক্রোসফট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও চুপ থাকেননি ইবতিহাল। তিনি অনেক সহকর্মীকে ইমেইল করে একটা সহজ কিন্তু তীব্র প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। তিনি লিখেছিলেন—
আপনার সন্তানেরা যদি একদিন আপনাকে জিজ্ঞেস করে—তুমি কী বানিয়েছিলে? আপনি কি সত্যি বলতে পারবেন—আমি এমন কিছু বানিয়েছিলাম যা মানুষ মারার কাজে ব্যবহার হয়েছিল? ইবতিহালের এই প্রশ্ন আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। প্রযুক্তি কি শুধু পণ্যের মতো, না কি এরও কিছু দায় আছে? কিছু বিবেক?

তরুণ প্রজন্মের চোখে ইবতিহাল এখন আর শুধু একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার নন, বরং এক প্রেরণার নাম। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন—যে কোড লেখা হয় মাথা দিয়ে, তার পেছনে একটা হৃদয়ও থাকতে পারে। এবং সেই হৃদয় থেকে যদি প্রতিবাদ আসে, তা পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা