গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নতুন করে হামলা ও অবিরাম বোমা বর্ষণের পরও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা কেন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না, তা নিয়ে সামরিক বিশেষজ্ঞ কর্নেল হাতেম কারিম আল-ফালাহি পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি গাজার সামরিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেন, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের আগ্রাসনের জবাব দেওয়া থেকে সতর্কভাবে বিরত রয়েছেন। ইসরায়েলের বোমা বর্ষণ ও স্থল অভিযানের বিরুদ্ধে তারা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি।
ফালাহি এই পরিস্থিতির পেছনে পাঁচটি কৌশলগত কারণ চিহ্নিত করেছেন:
১.গোপনীয়তা বজায় রাখা: গাজা উপত্যকার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা, সামরিক ক্ষমতা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে। ইসরায়েলি ড্রোনের মাধ্যমে পুরো এলাকায় নজরদারি চলায় এই গোপনীয়তা কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. সামরিক সম্পদ সংরক্ষণ: গাজায় চলমান অবরোধের কারণে প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের শক্তি, সামরিক সক্ষমতা ও সম্পদ সংরক্ষণে মনোযোগ দিচ্ছেন। এ সময় অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এড়িয়ে চলা তাদের জন্য জরুরি।
৩. নেতজারিম অঞ্চলের উন্মুক্ততা: ইসরায়েলি বাহিনী পূর্বের নেতজারিম অঞ্চলে প্রবেশ করে এলাকাটি সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করেছে। বর্তমানে এলাকাটি উন্মুক্ত ও খালি থাকায় এটি প্রতিরক্ষার জন্য উপযুক্ত নয়। সশস্ত্র বাহিনী ও সাঁজোয়া যান সহজেই এখানে প্রবেশ করতে পারে।
৪.স্থল অভিযানের সীমিত গুরুত্ব: এই স্থল অভিযানটি তেমন গুরুত্ব বহন করে না। ৪৭১ দিন ধরে চলমান যুদ্ধের পর ইসরায়েলি বাহিনী নেতজারিম অঞ্চলে সামরিক স্থাপনা নির্মাণ ও উত্তরে-দক্ষিণে প্রসারিত করতে সক্ষম হলেও, এই দীর্ঘ যুদ্ধ ও দখল অভিযান শেষ পর্যন্ত কোনো বড় প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইসরায়েলি বাহিনী তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার পরই সেখান থেকে সরে গেছে।
৫. কৌশলগত পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা: সালাহউদ্দিন স্ট্রিট ও রশিদ স্ট্রিট (সমুদ্র) পর্যন্ত পৌঁছানো ইসরায়েলি সামরিক অপারেশনের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ নয়। এই পদক্ষেপ কেবল গাজা উপত্যকার উত্তর অংশকে মধ্য ও দক্ষিণ অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এতে সামরিক ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইসরায়েলের সীমিত স্থল অভিযান
বুধবার ইসরায়েলি বাহিনী একটি সীমিত স্থল অভিযান শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের দাবি, এই অভিযানের মূল লক্ষ্য হলো প্রতিরক্ষামূলক অঞ্চল সম্প্রসারণ এবং গাজা উপত্যকার উত্তর অংশকে দক্ষিণ অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। ইসরায়েলি বাহিনী জানিয়েছে, তাদের সৈন্যরা নেতজারিম অঞ্চলের কেন্দ্রীয় অংশ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। পাশাপাশি, গোলানি ব্রিগেডের সৈন্যরা দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থান নেবে এবং গাজার অভ্যন্তরে যেকোনো অভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুত থাকবে।
কৌশলগত বিশ্লেষণ
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, যেকোনো স্থল অভিযান পরিচালনার জন্য ভৌগোলিক অবস্থা ও গোয়েন্দা তথ্যের সঠিক মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো সক্রিয় প্রতিক্রিয়া না দেখানোর কৌশলগত অর্থ হলো, নিজেদের অবস্থান গোপন রাখা। এতে ইসরায়েলি বাহিনী তাদের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ে ব্যর্থ হবে।
ফালাহির মতে, যুদ্ধের উভয় পক্ষই পরবর্তী ধাপের জন্য কৌশলগত প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস, সামরিক শক্তির পুনর্গঠন ও সম্পদের পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করা। ইসরায়েল গাজায় সরাসরি সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, যাতে প্রতিরোধ বাহিনীর অবস্থান শনাক্ত ও তাদের কৌশল উদঘাটন করা সম্ভব হয়।
ইসরায়েলের উদ্বেগ
ফালাহি আরও উল্লেখ করেন, প্রতিরোধ বাহিনীর পরিকল্পনা সম্পর্কে ইসরায়েলের অজ্ঞতা তাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, যুদ্ধবিরতির সময় ইসরায়েলি বিমান ও গোয়েন্দা অভিযান বন্ধ থাকায় তারা প্রতিরোধ বাহিনীর বর্তমান অবস্থান ও প্রস্তুতি সম্পর্কে নিশ্চিত নয়। এছাড়া, যুদ্ধ শুরুর সময়কার ভৌগোলিক বাস্তবতা ও বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হয়েছে, যা ইসরায়েলের কৌশলগত হিসাবকে আরও জটিল করে তুলেছে।
নেতজারিম থেকে সেনা প্রত্যাহার
গত ৯ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েলি বাহিনী নেতজারিম থেকে পুরোপুরিভাবে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। তারা এই অঞ্চলটি দীর্ঘ একবছর তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে দখলে রেখেছিল। এই প্রত্যাহারকে ইসরায়েলের কৌশলগত পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইসরায়েলি আগ্রাসনের জবাব না দেওয়ার পেছনে কৌশলগত ও সামরিক কারণ রয়েছে। এই পরিস্থিতি ভূরাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত জটিল, এবং উভয় পক্ষই পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।