২০২১ সালের আগস্টে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর রাজধানী কাবুলে নজরদারি ক্যামেরার নেটওয়ার্ক ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। সরকারের দাবি, এটি শহরের নিরাপত্তা জোরদার এবং অপরাধ কমানোর লক্ষ্যে নেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, অনেকেই এটিকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
নজরদারির সম্প্রসারণ
তালেবান ক্ষমতায় ফেরার আগে কাবুলে মাত্র ৮৫০টি নজরদারি ক্যামেরা ছিল। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ৬২,০০০-এ পৌঁছায় এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা ৯০,০০০ ছাড়িয়ে যায়। শহরের বিভিন্ন প্রবেশপথ, প্রধান সড়ক ও জনসমাগমস্থলে এসব ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এসব ক্যামেরার মাধ্যমে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং অপরাধের হার কমানো সহজ হয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে কাবুলে অপরাধের হার প্রায় ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল মতিন কানি বলেন, ‘নজরদারি ক্যামেরাগুলো নিরাপত্তা উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। আমরা কাবুলের প্রবেশ ও বহির্গমন পথগুলোতে আরও বেশি ক্যামেরা স্থাপনের পরিকল্পনা করছি।’

কন্ট্রোল রুম ও নজরদারি পদ্ধতি
কাবুলের পুলিশ সদর দপ্তরে বেশ কয়েকটি বিশাল পর্দার মাধ্যমে রাজধানীর প্রায় ৬০ লাখ মানুষের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। পুলিশের মুখপাত্র খালিদ যাদরান জানান, এই কন্ট্রোল রুম থেকে পুরো কাবুল শহর নজরদারি করা হয়। মাদক সেবন বা সন্দেহজনক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে, তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় পুলিশ পাঠানো হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘উচ্চ প্রযুক্তির ক্যামেরাগুলোর মাধ্যমে কয়েক কিলোমিটার দূরের বস্তু বা ব্যক্তিও স্পষ্টভাবে দেখা সম্ভব। ক্যামেরাগুলো মানুষের চেহারা শনাক্ত করতে পারে এবং বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করতে পারে। এছাড়া, স্বয়ংক্রিয় নম্বর প্লেট শনাক্তকারী প্রযুক্তির মাধ্যমে যানবাহনের গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করা হয়।’
কন্ট্রোল রুমে ৩০ জনের বেশি কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। তারা কোনো কিছু সন্দেহজনক মনে করলে দ্রুত নিরাপত্তা বাহিনীকে জানিয়ে দেন।
মানবাধিকার ও গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ
তবে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো তালেবানের এই নজরদারি কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ‘সরকার এটিকে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহার করার কথা বললেও, এটি মূলত জনগণের—বিশেষ করে নারীদের স্বাধীনতা সংকুচিত করার একটি মাধ্যম।’
সংস্থাটির মতে, ব্যাপকহারে নজরদারি ক্যামেরা ব্যবহার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়া, ক্যামেরাগুলোর তথ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো কঠোর আইন বা নীতিমালা নেই, যা উদ্বেগজনক। তাদের আশঙ্কা, তালেবানবিরোধী গোষ্ঠীগুলো এই প্রযুক্তি হ্যাক করে অপব্যবহার করতে পারে।
সরকারের পাল্টা যুক্তি
এই অভিযোগের বিষয়ে পুলিশের মুখপাত্র খালিদ যাদরান বলেন, ‘ক্যামেরায় ধারণকৃত তথ্য অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় না এবং এটি অ্যাক্সেস করতে কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সংরক্ষিত তথ্য তিন মাস পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে ফেলা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বহু উন্নত দেশেও নজরদারি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয় এবং নিরাপত্তা বজায় রাখতে এটি অত্যন্ত কার্যকর।’

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতামত
আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে ক্যামেরা স্থাপন গুরুত্বপূর্ণ হলেও, কেবল এটির ওপর নির্ভরশীল হওয়া যথেষ্ট নয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক জাওয়িদ বামির বলেন, ‘নজরদারি ক্যামেরা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, তবে আরও কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন। যেমন, সকল ফোন সিম নিবন্ধন করা, বাড়ির নম্বর বরাদ্দ করা এবং বিমানবন্দরকে সীমান্ত ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করা—যাতে জানা যায়, কে দেশে প্রবেশ করছে ও বের হচ্ছে।’
বাসিন্দাদের প্রতিক্রিয়া
কাবুলের কিছু বাসিন্দা নজরদারি ক্যামেরার কার্যকারিতা স্বীকার করলেও, অনেকে এতে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
উত্তর কাবুলের বাসিন্দা আহমদ করিম বলেন, ‘পুলিশ আমাদের নিজ খরচে নজরদারি ক্যামেরা কিনে বাড়ির সামনে স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে। আমরা যদি তা না করি, তাহলে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ কেটে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।’
এই পরিস্থিতিতে, একদিকে তালেবান সরকার যখন তাদের নিরাপত্তা কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে চাইছে, অন্যদিকে নাগরিকরা গোপনীয়তা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষার দাবি তুলছেন। আগামী দিনে এই বিতর্ক কীভাবে গতি পায়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
সূত্র : আল জাজিরা