সিরিয়ার কুর্দি গোষ্ঠী সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) এবং দেশটির সরকার দামেস্কের মধ্যে সম্প্রতি হওয়া চুক্তির পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কারণ কাজ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার, তুরস্কের ক্রমবর্ধমান সামরিক হুমকি এবং সিরিয়ার সরকারের নীতিগত পরিবর্তনই মূলত এই সমঝোতার পথ তৈরি করেছে। তবে চুক্তিটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যা ভবিষ্যতে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে।
সামরিক বিশ্লেষক কর্নেল হাতেম কারিম আল-ফালাহি মনে করেন, চুক্তিটি একাধিক সামরিক ও কৌশলগত বাস্তবতার প্রতিফলন। প্রথমত, উত্তর-পূর্ব সিরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার এসডিএফের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার সহায়তায় সক্রিয় থাকা এসডিএফ হঠাৎ করেই নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, তুরস্কের সামরিক হুমকি ক্রমশ বাড়তে থাকায় এসডিএফের অস্তিত্ব সংকট তৈরি হয়। তুরস্ক বরাবরই এসডিএফকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখে এবং তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তুরস্কের হামলা বেড়ে যাওয়ায় এসডিএফ নিজেদের রক্ষা করতে সিরিয়ার সরকারকে তাদের একমাত্র বিকল্প হিসেবে দেখে।
তৃতীয়ত, সিরিয়ার সরকারও পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে এসডিএফকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় আনতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। দেশটির প্রেসিডেন্ট আহমেদ শারার এবং এসডিএফের প্রধান মাজলুম আবদির মধ্যে এক বৈঠকের পর চুক্তিটি চূড়ান্ত হয়।
চুক্তি অনুযায়ী,
১. সিরিয়ার ভূখণ্ডের অখণ্ডতা বজায় রাখা ও বিভক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান জোরদার করা হবে।
২. এসডিএফকে সিরিয়ার সামরিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
৩. যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকবে এবং এসডিএফ পরিচালিত কারাগারগুলোর নিয়ন্ত্রণ সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
৪. উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার প্রশাসনিক কাঠামোকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বিত করা হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তির ফলে সিরিয়ার সামরিক সক্ষমতা বাড়বে। কারণ এসডিএফের কাছে উন্নত অস্ত্র রয়েছে এবং তারা যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ফলে সরকার তাদেরকে নিজেদের বাহিনীতে যুক্ত করে সামরিক শক্তি বাড়াতে পারবে।
চুক্তির বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এসডিএফের নেতৃত্ব কাঠামোকে সিরিয়ার সামরিক কাঠামোর সঙ্গে একীভূত করা। বিশেষ করে তাদের কমান্ড সিস্টেমকে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা কঠিন হতে পারে।
এছাড়া, এসডিএফের হাতে যে পরিমাণ অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে, তা নিয়ে তুরস্ক উদ্বিগ্ন। তারা চাইবে, এসব অস্ত্র যেন সিরিয়ার কুর্দি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে না থাকে। ফলে চুক্তির শর্ত মেনে এসডিএফের অস্ত্রভাণ্ডারের ভাগাভাগি কিভাবে হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এসডিএফের ভেতরকার বিভক্তি। সংগঠনটির মধ্যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বাহিনী রয়েছে—কুর্দি, আরব ও সিরিয়ান মিলিশিয়া। সবাই কি এই চুক্তিকে মেনে নেবে? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসডিএফের কিছু অংশ এই চুক্তি মানতে চাইবে না এবং তারা আলাদা হয়ে যেতে পারে।
চুক্তির ফলে এসডিএফ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো সিরিয়ার সরকারের হাতে চলে যাবে, কিন্তু তুরস্কের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তুরস্ক চাইবে না যে, সিরিয়ার কুর্দি গোষ্ঠীগুলো সিরিয়ার সামরিক কাঠামোর অংশ হয়ে শক্তিশালী হোক।
এছাড়া, এসডিএফ বর্তমানে তেলক্ষেত্র, কৃষিজমি ও সীমান্তবন্দর নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব অঞ্চলের প্রশাসনিক কাঠামো কিভাবে পরিবর্তন হবে, তা নিয়ে আরো আলোচনা প্রয়োজন হবে।
সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চুক্তি বাস্তবায়ন কঠিন হবে, কারণ—
১. এসডিএফের মোট সদস্যসংখ্যা এক লাখের বেশি, যা একীভূত করা একটি বড় লজিস্টিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ।
২. এসডিএফের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো আরব সংখ্যাগরিষ্ঠ, যা সিরিয়ার সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক জটিল করে তুলতে পারে।
৩. তুরস্ক যদি এই চুক্তির বিরোধিতা করে, তাহলে আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে।
এসডিএফ ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সিরিয়ার হাসাকা অঞ্চলে গঠিত হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল আইএসবিরোধী লড়াই। এই বাহিনীর প্রধান শক্তি হলো কুর্দি গোষ্ঠী ‘ইউনিটস অব প্রটেকশন পিপল’ (ওয়াইপিজি), যা তাদের কেন্দ্রবিন্দু।
এছাড়া, এসডিএফের মধ্যে নারী যোদ্ধাদের বিশেষ বাহিনী (ওয়াইপিজি-র নারী শাখা), আরব ও সিরিয়ান মিলিশিয়া অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফলে এটি কেবল কুর্দিদের নয়, বরং একটি বহুজাতিক সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
তবে এখন প্রশ্ন হলো, এসডিএফ যদি সিরিয়ার সরকারে একীভূত হয়, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে? তারা কি আগের মতোই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, নাকি সরকার তাদের কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে?
দামেস্ক ও এসডিএফের চুক্তি সিরিয়ার রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতির বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এটি সিরিয়ার সরকারকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করতে পারে, আবার আঞ্চলিক অস্থিরতার কারণও হতে পারে।
চুক্তির সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করবে—
১. এসডিএফকে কীভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
২. তুরস্কের প্রতিক্রিয়া কী হয়।
৩. সিরিয়ার সরকার কিভাবে এসডিএফের অস্ত্র ও সম্পদের ভাগাভাগি করে।
তবে একথা নিশ্চিত যে, এই চুক্তি সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিতে যাচ্ছে, যার প্রভাব শুধু সিরিয়া নয়, পুরো অঞ্চলের ভূরাজনীতিতেও পড়বে।
সূত্র: আল জাজিরা