ইসরায়েলের বিরোধী নেতা ইয়াইর লাপিদ সম্প্রতি গাজার প্রশাসনিক দায়িত্ব মিশরের হাতে দেওয়ার একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিকল্পনা মূলত ফিলিস্তিনি সংকটকে নতুনভাবে বিন্যাস করার প্রচেষ্টা, যা মূলত ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
লাপিদের পরিকল্পনা অনুসারে, মিশরকে অন্তত আট বছর (যদি প্রয়োজন হয়, ১৫ বছর পর্যন্ত) গাজার প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে হবে। এর পরিবর্তে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিশরের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সহায়তা করবে। পাশাপাশি, গাজায় একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা হবে, যা প্রশাসনিক কার্যক্রম ও পুনর্গঠনের দায়িত্ব পালন করবে।
এই প্রস্তাবের মাধ্যমে গাজার সংকটকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা চলছে, যাতে এটি ফিলিস্তিনি জাতীয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে না থেকে আরব বিশ্বের জন্য একটি পৃথক সমস্যা হয়ে ওঠে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি নতুন কোনো পরিকল্পনা নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কৌশলেরই অংশ, যার মাধ্যমে ফিলিস্তিন সংকটকে অধিকারের প্রশ্ন থেকে সরিয়ে প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে পরিণত করা হচ্ছে।
• ইসরায়েলের লক্ষ্য গাজাকে ফিলিস্তিনের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা করা।
• গাজার দায়িত্ব একটি আরব রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ইসরায়েল তার দখলদারির দায় এড়াতে চায়।
• ফিলিস্তিন সংকটকে একটি মানবিক ও প্রশাসনিক সমস্যায় রূপান্তরিত করার মাধ্যমে স্বাধীনতার দাবিকে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন মিশরের জন্য গুরুতর রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
১. গাজার শাসনভার গ্রহণের চাপ
ইসরায়েল চায়, মিশর যেন গাজার প্রধান প্রশাসক হয়ে যায়। তবে, এর ফলে মিশরকে গাজার রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির সম্পূর্ণ দায় নিতে হবে, যা তাকে সরাসরি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে পারে।
২. অর্থনৈতিক চুক্তির আড়ালে রাজনৈতিক ফাঁদ
লাপিদের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, মিশরের ঋণ পরিশোধে আন্তর্জাতিক সহায়তা দেওয়া হবে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি মিশরের অর্থনৈতিক সংকটকে কাজে লাগিয়ে তাকে একটি জটিল ভূরাজনৈতিক অবস্থানে ফেলার কৌশল।
৩. ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পথে বাধা
গাজার ওপর মিশরের নিয়ন্ত্রণ বসানো মানে গাজাকে পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা, যা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ব্যাহত করতে পারে।
৪. উপসাগরীয় দেশগুলোর ভূমিকা
লাপিদ স্বীকার করেছেন এই পরিকল্পনা তিনি উপসাগরীয় আরব মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করেই উত্থাপন করেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ফিলিস্তিন ইস্যুকে উপেক্ষা করার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
কায়রো এই পরিকল্পনা গ্রহণ করবে কি না, তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি। তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মিশর সম্ভবত এই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করবে।
সম্ভাব্য কারণগুলো:
১. ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্বের প্রতি মিশরের অঙ্গীকার – মিশর সবসময় গাজাকে ফিলিস্তিনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখে এসেছে।
২. গাজায় মিশরের নিরাপত্তা ভূমিকার বিরোধিতা – কায়রো কোনোভাবেই গাজায় ‘নিরাপত্তারক্ষী’ হতে চায় না, কারণ এতে তার সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
৩. অর্থনৈতিক বিনিময়ে কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন না করা – বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মিশর কখনো অর্থনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে তার কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন করবে না।
৪. আরব ঐক্যের ওপর জোর – মিশর চাইবে, এই সংকটের সমাধান আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে হোক, কোনো একক রাষ্ট্রের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজার সংকটের সমাধান কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সম্ভব নয়। প্রকৃত সমাধান হলো ইসরায়েলের দখলদারিত্বের অবসান ও ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন।
লাপিদের পরিকল্পনা গাজাকে ফিলিস্তিন সংকট থেকে বিচ্ছিন্ন করে আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক মহলের ওপর দায় চাপানোর একটি কৌশল।
কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র গঠনের পথ আরো কঠিন হয়ে উঠবে। তাই কূটনৈতিকভাবে এটি প্রতিহত করাই ফিলিস্তিনি স্বার্থের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র : আল মায়াদিন