টানা ১৬ মাসের ইসরায়েলি হামলায় বিপর্যস্ত গাজায় এবার এক ভিন্ন বাস্তবতায় শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান। মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনিরা ইফতারে বসেন, তবে তা আর উষ্ণ ঘরে পরিবারের সদস্যদের পরিবেষ্টিত নয়—ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কিংবা অস্থায়ী তাবুর নিচে।
যেখানে একসময় ঘরবাড়ি ছিল, সেখানে এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ। উত্তর গাজায় হাজারো মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন অস্থায়ী তাবুতে, যেখানে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার অভাব প্রকট। খাবার বলতে সামান্য শুকনো খাবার আর টিনজাত খাদ্য।
যেখানে আগে পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে ইফতার করতেন, সেখানে আজ খোলা আকাশ তাদের ছাদ, আর ধূলিমাখা ভূমিই তাদের আসন।
তবে, এই চরম দুর্দশার মধ্যেও ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভিটেমাটি ছাড়তে নারাজ। বিধ্বস্ত বাড়ির ধ্বংসাবশেষে বসেই অনেক পরিবার ইফতার আয়োজন করেছে, যেন তারা জানিয়ে দেয়—এই ভূমি তাদের, তারা এখানেই থাকবে।
খান ইউনিসেও চিত্র ভিন্ন নয়। সেখানে হাজারো শরণার্থী মানবেতর জীবনযাপন করছেন, খাবার ও পানীয়ের অভাবে প্রতিদিনই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবু ফিলিস্তিনিরা তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন—কেউ কেউ সামান্য আহার ভাগ করে নিচ্ছেন অন্যদের সঙ্গে, তরুণ স্বেচ্ছাসেবীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে উপবাসীদের জন্য খেজুর ও পানি বিতরণ করছেন।
রাফাহ ও শুজাইয়ায় ধ্বংসস্তূপের মাঝেই আয়োজন করা হয়েছে সম্মিলিত ইফতার। শত শত ফিলিস্তিনি একত্র হয়ে ইফতার করেন, যা তাদের ঐক্যের প্রতীক এবং প্রতিরোধের বার্তা বহন করে।
তবে এই রমজানে সবচেয়ে করুণ বাস্তবতা হলো প্রিয়জনদের অনুপস্থিতি। ইসরায়েলি হামলায় নিহত হাজারো ফিলিস্তিনির শূন্যতা ইফতারের সময় গভীরভাবে অনুভূত হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৩৮৮ জন ফিলিস্তিনি শহিদ হয়েছেন।
গত ২ ফেব্রুয়ারি গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস গাজাকে ‘সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করে।
গাজায় এবার রমজান আর আগের মতো নেই। যেখানে আগে পরিবার-পরিজনের মিলনমেলা ছিল, সেখানে আজ উদ্বাস্তু শিবিরের তাবু আর ধ্বংসস্তূপ।তবে ফিলিস্তিনিরা এখনো আশার আলো ধরে রেখেছেন। কেউ কেউ ধ্বংস হওয়া ঘরের অবশিষ্টাংশে রঙিন ফানুস ঝুলিয়ে রমজানের আমেজ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। কেউ আবার দেয়ালে রঙিন চিত্র এঁকে জানিয়ে দিচ্ছেন—ধ্বংসের মধ্যেও জীবন আছে।
গাজার পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠলেও মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। ২০০,০০০ তাবু এবং ৬০,০০০ মোবাইল হোম প্রবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে, যা গাজার উদ্বাস্তুদের জন্য আশ্রয়ের বিকল্প হতে পারত।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হলেও ইসরায়েলের এই অবরোধ মানবিক সংকটকে আরও তীব্র করে তুলছে বলে অভিযোগ করছে গাজার প্রশাসন।
তবে সব প্রতিকূলতার মধ্যেও ফিলিস্তিনিরা তাদের পরিচয় ধরে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসস্তূপের মাঝেও তারা জীবন ও প্রতিরোধের বার্তা দিচ্ছে—এই ভূমি তাদের, এবং তারা এখানেই থাকবে।
সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি