ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক এক তদন্তে স্বীকার করা হয়েছে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকার আশপাশের বসতিগুলোর ওপর হামলা প্রতিরোধে তারা ‘পুরোপুরি ব্যর্থ’ হয়েছে। এই তদন্তে হামলার নতুন কিছু তথ্য ও বিশ্লেষণও উঠে এসেছে।
ইসরায়েলের এক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা আজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘৭ অক্টোবরের হামলা আমাদের জন্য সম্পূর্ণ ব্যর্থতার উদাহরণ। আমরা ইসরায়েলি নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে পারিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক বেসামরিক নাগরিক সেদিন প্রাণ হারিয়েছেন, মৃত্যুর আগেও তারা হয়তো ভাবছিলেন— সেনাবাহিনী কোথায় ছিল?’
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছে, ‘আমরা নাগরিকদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি। যুদ্ধের প্রথম কয়েক ঘণ্টায় গাজার চারপাশের ইসরায়েলি বাহিনী পুরোপুরি চাপে পড়ে যায় এবং হামাসের যোদ্ধারা দ্রুত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।’
তদন্তে আরও উঠে এসেছে হামলার আগে ইসরায়েলি বাহিনী অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল এবং তারা হামাসের সামরিক সক্ষমতাকে পুরোপুরি ভুলভাবে মূল্যায়ন করেছিল।
কীভাবে হামলা চালিয়েছিল হামাস?
তদন্তে বলা হয়েছে, হামাস ৩টি ধাপে প্রায় ৫,০০০ যোদ্ধা নিয়ে হামলা চালিয়েছিল।
• প্রথম ধাপে: হামাসের এলিট ফোর্স বাহিনীর ১,০০০ যোদ্ধা প্রবেশ করে। তারা তীব্র গোলাবর্ষণের আড়ালে সীমান্ত অতিক্রম করেছিল।
• দ্বিতীয় ধাপে: আরও ২,০০০ যোদ্ধা যোগ দেয়।
• তৃতীয় ধাপে: কয়েকশো যোদ্ধার সঙ্গে হাজারো ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকও প্রবেশ করে।
তদন্তে উঠে আসা নতুন বিশ্লেষণ
তদন্তে জানানো হয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হামলার প্রথম কয়েক ঘণ্টাতেই কার্যত পরাস্ত হয়েছিল, এবং তারা দুপুরের পর থেকে ধীরে ধীরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে, ‘৭ অক্টোবর আমাদের জন্য এক ভয়াবহ দিন ছিল। হতাহতের সংখ্যা এতটাই বেশি ছিল যে তা আমাদের জন্য মেনে নেওয়া কঠিন।’
ইসরায়েলের দৈনিক পত্রিকা ‘ইদিয়োথ আহরোনোথ’ জানিয়েছে,
হামাস প্যারাগ্লাইডার ব্যবহার করে আকাশপথে যোদ্ধা নামিয়ে ইসরায়েলি বিমানবাহিনীকে চমকে দেয়।
ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর কাছে স্থলপথে হামলা ঠেকানোর কোনো জরুরি পরিকল্পনা ছিল না।
হামাস আসলে ২০২৩ সালের পাসওভার উৎসবে (ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসব) হামলার পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু হামাসের স্পেশাল এলিট ফোর্স বাহিনীকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করার জন্য তা পিছিয়ে দেয়।
তদন্তে আরও বলা হয়েছে, গভীর গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণেই এত বড় হামলা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি।
হিজবুল্লাহর ভূমিকা ও ইসরায়েলি উদ্বেগ
এক সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হিজবুল্লাহ শুরুতেই হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেয়নি, কারণ দুই পক্ষের মধ্যে যথেষ্ট সমন্বয় ছিল না।
অন্যদিকে, ‘জেরুজালেম পোস্ট’ জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর সূত্র মতে, ‘যদি হিজবুল্লাহ তখনই যুদ্ধ শুরু করত এবং আমরা প্রস্তুত না থাকতাম, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারত।’

ইরান নেতৃত্বাধীন জোট ও ইসরায়েলের ভুল হিসাব
‘টাইমস অব ইসরায়েল’ এক সামরিক তদন্তের বরাত দিয়ে জানিয়েছে যে, ইরান নেতৃত্বাধীন জোট ইসরায়েলকে ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছিল, এবং ইসরায়েলের শত্রুরা আসলে বহুমুখী যুদ্ধের জন্য যতটা প্রস্তুত ছিল, ইসরায়েলি গোয়েন্দারা তার সঠিক হিসাব করতে পারেনি।
পত্রিকাটি আরও জানায়, হামাস ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছিল বলে যে ধারণা ছিল, তা আসলে এক ধরণের ছলনা ছিল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী মনে করেছিল, সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া যেকোনো হুমকি ঠেকিয়ে দেবে, কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।
তদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭ অক্টোবর হামলার সময় ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর বেশিরভাগ সিনিয়র অফিসার ছুটিতে ছিলেন, ফলে তারা দক্ষিণে উপস্থিত ছিলেন না। যদিও হামলার পরপরই ইসরায়েলি বিমান বাহিনী ‘সেইফ ডেমোক্লিস’ নামে এক অভিযানে হামাসের একাধিক নেতা ও তাদের সদর দপ্তরকে টার্গেট করে হামলা চালায়।
তদন্ত শেষে বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করেছেন, ইসরায়েলকে এখন থেকে কেবল প্রতিরক্ষার ওপর নির্ভর না করে আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা কৌশল নিতে হবে। সেনাবাহিনীর জনবল ও সম্পদের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং সীমান্ত সুরক্ষার প্রস্তুতি আরও জোরদার করতে হবে। কারণ, ভবিষ্যতে এমন আকস্মিক ও বড় ধরনের হামলা আবার হতে পারে।
নিজেদের গুলিতে নিজেদের সেনা হতাহত
‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ এক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, হামাসের যোদ্ধারা ৭ অক্টোবরের হামলায় ইসরায়েলি বাহিনী ও শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের টার্গেট করেছিল এবং সেনাবাহিনীর যোগাযোগ ও কন্ট্রোল সিস্টেম কার্যত অচল করে দিয়েছিল।
তিনি জানান, ওই বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিজেদের সেনাদের ভুল করে নিজেদেরই গুলি করার (বন্ধুসুলভ আগুন) কিছু ঘটনা ঘটেছে, তবে তার সংখ্যা খুব বেশি ছিল না।
তদন্তে আরও জানা গেছে, ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তারা ধারণা করেছিলেন, হামাস হয়তো ৮টি সীমান্ত চৌকি থেকে হামলা চালাবে। কিন্তু বাস্তবে হামাস আক্রমণ করে ৬০টিরও বেশি স্থানে। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এই হামলার পরিকল্পনা আসলে ২০১৭ সাল থেকেই চলছিল।
তদন্ত নিয়ে প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক
তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর ইসরায়েলের সেনাপ্রধান হেরৎসি হালেভি স্বীকার করেছেন, ‘আমরা ৭ অক্টোবর বড় ভুল করেছি, এবং এর সম্পূর্ণ দায়ভার আমি নিচ্ছি।’
এরপরই সাবেক যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বেনি গান্টজ আনুষ্ঠানিক তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান এবং বলেন, ‘এখনই এই তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।’
বিরোধীদলীয় নেতা ইয়াইর লাপিদও প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ‘সেনাবাহিনী সাহস ও সততার সঙ্গে নিজেদের ভুল খুঁজে বের করছে। তারা কোনো কিছু গোপন করছে না, দায় এড়ানোর চেষ্টাও করছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের উচিত সেনাবাহিনীর কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া। সারাক্ষণ দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার বদলে তাদের উচিত এখনই আনুষ্ঠানিক তদন্ত কমিটি গঠন করা।’
সূত্র: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা