মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

ফাঁস হলো ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রাণহানির তথ্য, গাজা যুদ্ধে নিহত ৬ হাজারের বেশি সেনা

ফাঁস হলো ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রাণহানির তথ্য, গাজা যুদ্ধে নিহত ৬ হাজারের বেশি সেনা
ফাঁস হলো ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রাণহানির তথ্য, গাজা যুদ্ধে নিহত ৬ হাজারের বেশি সেনা। ছবি : আল জাজিরা

গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিপুল প্রাণহানির তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ইসরায়েলি সেনাপ্রধান রিজার্ভ মেজর জেনারেল ইয়াল জামির সম্প্রতি যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছেন, তা আগের যে কোনো হিসাবের চেয়ে ভিন্ন। তিনি জানিয়েছেন, ‘তুফানুল-আকসা’ অভিযানের শুরু থেকে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত ৫,৯৪২টি পরিবার ‘শোকাহত পরিবারের’ তালিকায় যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, এদের অন্তত একজন সদস্য যুদ্ধে নিহত হয়েছে।

ইসরায়েলের চ্যানেল ১২–এর প্রতিবেদনে জামিরের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, আহতদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আরও ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, তা পরিবারেও আঘাত হানে। আমাদের দায়িত্ব, নিহত ও আহত সেনাদের পরিবারগুলো যেন যথাযথ সহায়তা পায়।’

‘শোকাহত পরিবারের’ মানে কী?

ইসরায়েলি বিশ্লেষক আজ্জাম আবু আল-আদাস বলেন, ‘শোকাহত পরিবার’ শব্দগুচ্ছটি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রচলিত ভাষা, যা দিয়ে বোঝানো হয় সেইসব পরিবারকে, যাদের প্রিয়জন সেনাবাহিনীতে থাকাকালে যুদ্ধে নিহত হয়েছে। জামিরের বক্তব্যে যে ‘শোকাহত পরিবারের পরিধিতে যোগ’ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা শুধু সেনা নিহতদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বেসামরিক হতাহতের জন্য নয়। সেনা নিহতদের জন্য ইসরায়েলে আলাদা তালিকা রাখা হয়।

কেন হঠাৎ এমন তথ্য প্রকাশ?

এই তথ্য প্রকাশের পেছনে কারণ নিয়েও নানা গুঞ্জন রয়েছে। এর আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিহতের সংখ্যা প্রায় ১,৮০০ বলে জানিয়েছিল, যার মধ্যে প্রায় ৪০০ জন গাজায় স্থল অভিযানে মারা গিয়েছিলেন। নতুন করে এই সংখ্যা প্রকাশের পেছনে আসল কারণ কী?

আবু আল-আদাসের ধারণা, এই তথ্য ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল। তাই সেনাপ্রধান হয়তো সরাসরি তথ্য দিয়ে সেই ফাঁসের পথ বন্ধ করতে চেয়েছেন। ইসরায়েলের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে।

অন্যদিকে, ইসরায়েলি বিশ্লেষক ইমাদ আবু আওয়াদ বলছেন, যুদ্ধ শেষের পর ইসরায়েল সাধারণত বাস্তব ক্ষয়ক্ষতির হিসাব প্রকাশ করে। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের তথ্য জনসমক্ষে আসবেই। তাছাড়া, যুদ্ধ শেষ হলে বিভিন্ন তদন্ত কমিটিও তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে।’

আবু আওয়াদ আরও বলেন, ইসরায়েলের প্রতিটি যুদ্ধের পর তাদের ভেতরের নানা সংকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর আসল ক্ষতির মাত্রা প্রকাশ পাবে, আর তখনই শুরু হবে নতুন নতুন সংকট।

যুদ্ধের ময়দানে ঘটে যাওয়া অনেক কিছু হয়তো সামনে আসে না, তবে যুদ্ধ থেমে গেলে তার প্রতিধ্বনি কিন্তু সহজে থামে না—ইসরায়েলও সেই বাস্তবতার মুখোমুখি।

যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র: ইসরায়েলের হতাহতের চমকপ্রদ পরিসংখ্যান

যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যতই তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা করুক, কিছু তথ্য শেষ পর্যন্ত ফাঁস হয়েই যায়। সাম্প্রতিক কিছু ইসরায়েলি সোশ্যাল মিডিয়া সূত্রের দাবি অনুযায়ী, হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগ জানিয়েছে—গাজা, লেবানন এবং পশ্চিম তীরে চলমান যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজারে।

ইসরায়েলের দৈনিক পত্রিকা ইদিয়োথ আহরোনোথের সামরিক বিশ্লেষক ইয়োসি ইয়াহোশুয়া এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, গাজা যুদ্ধের কারণে গত বছর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী শত শত সেনা ও কর্মকর্তা হারিয়েছে। আহত ও পঙ্গু হয়েছে আরও প্রায় ১২ হাজার সেনা।

গত ২২ জানুয়ারি ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, সম্প্রতি গাজা থেকে প্রত্যাহার করা গিভআতি ব্রিগেডের ৮৬ জন সেনা ও কর্মকর্তা এই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

কিন্তু নতুন যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে, তা আগের সরকারি দাবির সঙ্গে পুরোপুরি বিরোধী। সেনাবাহিনী আগে বলেছিল, তাদের নিহতের সংখ্যা মাত্র ৯০০।

যুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হতাহত সেনাদের প্রকৃত সংখ্যা গোপন রাখার চেষ্টা করেছে। তবে যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতে হারেৎজ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ১২ হাজার আহত এবং পঙ্গু সেনাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই আহতদের অর্ধেকের বেশি—৫১ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে ৬৬ শতাংশই রিজার্ভ সেনা। প্রতি মাসে প্রায় এক হাজার নতুন আহত সেনা পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি হচ্ছে, পাশাপাশি পুরোনো আঘাতের জন্যও চিকিৎসার আবেদন করা হচ্ছে প্রায় ৫০০টি করে।

পুনর্বাসন বিভাগের হিসাবে, ২০৩০ সালের মধ্যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে প্রায় ১ লাখ পঙ্গু সেনা থাকবে, যাদের অর্ধেকই মানসিক রোগে ভুগবে।

গত ২৮ জানুয়ারি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও এক বিবৃতিতে স্বীকার করেছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তারা ১৫ হাজারের বেশি আহত সেনার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে।

সামরিক বিশ্লেষক আমোস হরেল হারেৎজ-এ এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি গাজায় যুদ্ধবিরতির চুক্তি করতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। বন্দি সেনাদের ফিরিয়ে আনার তাগিদও ছিল এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ।

বড় সেনাবাহিনীর পথে ইসরায়েল

সেনাবাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রকাশের পেছনে বিশেষ একটি উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নতুন চিফ অব স্টাফ হার্জি হালেভি বরাবরই একটি বড় সেনাবাহিনী গঠনের পক্ষে, যা আধুনিক প্রযুক্তি আর সীমিত আকারের বাহিনীর ওপর নির্ভর করবে না।

বিশ্লেষক আবু আওয়াদ বলেন, হালেভি মূলত ইসরায়েলের বিদ্যমান সামরিক কৌশলে পরিবর্তন আনতে চাইছেন। তিনি চান একটি শক্তিশালী, বড় আকারের সেনাবাহিনী, যা তার আগের চিফ অব স্টাফ আভিভ কোচাভির ছোট বাহিনীর ধারণার থেকে একেবারেই আলাদা।

ইসরায়েলের দৈনিক পত্রিকা মাআরিভ জানায়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এখন স্থলবাহিনী পুনর্গঠনের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে স্থলবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের আকার বাড়ানো হচ্ছে। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সাঁজোয়া ইউনিটকে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এখন দেশেই শত শত মারকাভা-৪ ট্যাংক উৎপাদনে ব্যস্ত। গাজার যুদ্ধে সাঁজোয়া যানগুলোর বিশাল ক্ষতির কারণে এবং ঘাটতি পূরণে নতুন ট্যাংক উৎপাদন করতে না পারায়, আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী মারকাভা-৩ ট্যাংক অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।

এ ছাড়া, যুদ্ধে ব্যাপক ব্যবহারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শত শত ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান দ্রুত মেরামতের জন্য দুটি পৃথক কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। আগের দিনে এই যানগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রপ্তানি করা হতো, কিন্তু এখন সেগুলো নিজেরাই দ্রুত মেরামত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখতে হচ্ছে।

যুদ্ধের অভিজ্ঞতা স্পষ্ট করে দিয়েছে—ইসরায়েল এখন আর শুধুমাত্র ‘স্মার্ট সেনাবাহিনী’ দিয়ে কাজ চালাতে পারবে না। তাদের দরকার একটি বড়, শক্তিশালী বাহিনী, যা যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করতে প্রস্তুত থাকবে সব সময়।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সক্ষমতা পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ

ইসরায়েলি বিষয়ক বিশ্লেষক ফিরাস ইয়াঘি মনে করেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল সামিরের সাম্প্রতিক মন্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—সেনাবাহিনী এখন তীব্র ঘাটতিতে রয়েছে অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত সৈন্যের। যেসব সৈন্য হারিয়েছে, সেই শূন্যতা পূরণ করতে হলে কেবল নতুন সেনা নিয়োগই যথেষ্ট নয়, তাদের হতে হবে পুরোপুরি প্রশিক্ষিত, দক্ষ এবং যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।

সামরিক বিশ্লেষকদের ধারণা, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে তার আগের শক্ত অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে অন্তত আট বছর সময় লাগবে। শুধু সেনা সংখ্যা বাড়ালেই হবে না; এর পাশাপাশি ব্যাটালিয়ন, ব্রিগেড এবং ডিভিশনের নেতৃত্বে থাকা অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদেরও নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। এ কারণেই জেনারেল সামির জোর দিয়ে বলেছেন, সেনাবাহিনীকে আরও বড়, আরও শক্তিশালী করতে হবে। তিনি বাধ্যতামূলক সেনাসেবার মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে এবং অতি-ধর্মানুরাগী ইহুদি সম্প্রদায় ‘হারিদিম’-দেরও সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলেছেন। তার মতে, এখন সময় এসেছে সেনাবাহিনীর ভেতরের বাস্তবতা নতুন করে মূল্যায়ন ও গুছিয়ে নেওয়ার।

এই পরিবর্তন বাস্তবায়ন সহজ নয়। সামিরের লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে সেনাবাহিনীর ভেতরেই বড় ধরনের সংস্কার দরকার। তিনি সবসময় একটি শক্তিশালী পদাতিক বাহিনীর পক্ষে ছিলেন। সাঁজোয়া ইউনিট থেকে আসা সামিরের বিশ্বাস, যেকোনো যুদ্ধে স্থলবাহিনীর উপস্থিতি অপরিহার্য। তাই তার পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে পদাতিক বাহিনীকে আরও কার্যকর ও প্রস্তুত রাখা।

হারিদিমদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির চাপ

ফিরাস ইয়াঘির বিশ্লেষণে আরেকটি বিষয়ও উঠে এসেছে—সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সামিরের প্রকাশ্য বক্তব্যের নেপথ্যে রয়েছে হারিদিমদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা। ইসরায়েলে এটি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ জনমত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইয়াঘি বলেন, ‘সামিরের পক্ষে এই ইস্যুটি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের ক্ষয়ক্ষতির প্রসঙ্গটি সামনে এনে ইসরায়েলের সামরিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন একটি জনমত গড়ে তুলতে চাইছেন, যা হারিদিমদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগের পক্ষে সহায়ক হবে।’

তবে এই প্রক্রিয়া কতটা সহজ হবে, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। ইয়াঘির ভাষায়, ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—আসলেই কি এটা কার্যকর করা সম্ভব? কারণ, সামিরকে চিফ অব স্টাফ হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যিনি নিজের সরকার টিকিয়ে রাখতে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন বজায় রাখার বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন।’

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা