সম্প্রতি কাসসাম ব্রিগেডের সামরিক প্রধান শহিদ মুহাম্মদ আদ দাইফের পরিবারের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছে আল জাজিরা। মধ্যপ্রাচ্যের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির অনুবাদ দেয়া হলো।
আল জাজিরা : উম্মে খালেদ ( দাইফের স্ত্রী ), কে ছিলেন মুহাম্মদ দাইফ? কিভাবে আপনারা তাঁর শহীদ হওয়ার খবরটি পেয়েছিলেন, এবং সেই মুহূর্তে আপনার অনুভূতি কি ছিল?
উম্মে খালেদ: আবু খালেদ দাইফ ছিলেন ফিলিস্তিনিদের সাহসের প্রতীক, প্রতিরোধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তাঁর পুরো নাম ছিল মুহাম্মদ দিয়াব ইব্রাহিম দাইফ। তিনি জন্মেছিলেন খান ইউনুসে এবং সেখানেই তিনি শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। আমাদের হৃদয়ে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি—শোকের গভীরতা আর গর্বের উজ্জ্বলতা পাশাপাশি বিরাজ করছে। আমাদের একমাত্র সান্ত্বনা হলো, আল্লাহ তাঁকে শাহাদাতের সম্মান দিয়েছেন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে ৫ অক্টোবরের ‘তুফানুল আকসা’ নামে পরিচিত ঐতিহাসিক অভিযানটি তাঁর পরিকল্পনায় বাস্তবায়িত হয়।
আল জাজিরা : খালেদ, আপনি শহীদ মোহাম্মদ দাইফের বড় ছেলে। শেষবার কবে বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
খালেদ দাইফ: শেষবার বাবাকে দেখি ৬ অক্টোবর, শুক্রবার। সেদিন তিনি আমাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। বাবা সবসময় আমাদের কুরআন হিফজ এবং তার তাফসির শেখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। পাশাপাশি জ্ঞান অর্জন এবং শিক্ষা গ্রহণের উপর বিশেষ জোর দিতেন। তাঁর শেষ উপদেশ এখনো কানে বাজে—‘যদি আমি শহীদ হই, তোমরা আমার পথ অনুসরণ করবে। যদি তোমরাও শহীদ হও, তবে তোমাদের সন্তানরাও এই পথকে ধরে রাখবে।’ এই কথাগুলো আমাদের জীবনের পাথেয় হয়ে আছে।
আল জাজিরা : হালিমা, আপনার বাবা আবু খালেদ দাইফের সঙ্গে কাটানো কোনো বিশেষ স্মৃতি মনে আছে, যা কখনো ভুলবেন না?
হালিমা দাইফ : বাবা আমাদের হৃদয়ে চির অমর। তাঁর অনুপস্থিতি শুধু শারীরিক, কিন্তু অনুভবে তিনি সবসময় আমাদের পাশে ছিলেন। আমি কখনও ভুলতে পারব না। যখন অসুস্থ হয়েছিলাম, বাবা ছিলেন সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তাঁর স্নেহ আর দায়িত্ববোধ আমাদের পরিবারে ছিল ছায়ার মতো। যদিও নিরাপত্তার কারণে আমরা তাঁকে সবসময় দেখতে পাইনি, তবু প্রতিদিন ফোনে আমাদের খবর নিতেন। দূরে থেকেও তিনি আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে জড়িয়ে ছিলেন।
আল জাজিরা : উম্মে ইব্রাহিম, আপনি পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য। নিশ্চয়ই মুহাম্মদ দাইফকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁর জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। আপনার চোখে তিনি কেমন মানুষ ছিলেন?
উম্মে ইব্রাহিম ( দাইফের শাশুড়ি) : আবু খালেদ ছিলেন এক অবিস্মরণীয় সংগ্রামী, সাহসী, এবং দৃঢ়চেতা নেতা। তাঁর মধ্যে ছিল সত্যের প্রতি অটল বিশ্বাস এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ জায়গায় স্থান দেন এবং শহীদদের মর্যাদায় ভূষিত করেন। তাঁর এই ত্যাগ আমাদের জন্য গর্বের, তবে তাঁর শূন্যতা আমাদের হৃদয়ে গভীর শোকের ছায়া ফেলেছে।
আল জাজিরা : উম্মে খালেদ, এই কঠিন সময়ে আপনারা যে আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন, এটি কি আবু খালেদের ইচ্ছা ছিল, নাকি যুদ্ধের বাস্তবতায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে?
উম্মে খালেদ: এইটাই আমাদের বাস্তবতা। যুদ্ধের আগে, যুদ্ধের মধ্যে, এবং যুদ্ধের পরে—এই জীবনযাপন আমাদের জন্য নতুন নয়। আমাদের জীবন সবসময়ই ছিল সংগ্রামের, কষ্টের, এবং বিনয়ী থাকার। এটাই আমাদের পরিচয়। আমরা যেখানেই থাকি, তা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্যই। আমাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি, কারণ এই ত্যাগই আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আল জাজিরা : আবু খালেদের শহীদ হওয়ার পর, তাঁর কোন বিষয়টি আপনাদের মনে সবচেয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছে?
উম্মে খালেদ: সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমাদের মনকে নাড়া দিয়েছে, তা হলো আমাদের কাঁধে অর্পিত দায়িত্বের বিশালতা। আমাদের সন্তানদের আল্লাহর পথে এবং দাইফের আদর্শে লালন-পালন করতে হবে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং জেরুজালেমের মুক্তিই আমাদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। আমরা জানি, এই পথ কঠিন, তবে এটাই আমাদের গর্বের পথ।
আল জাজিরা : আপনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা—খালেদ দাইফ, শহীদ মোহাম্মদ দাইফের পুত্র; উম্মে খালেদ, তাঁর স্ত্রী; হালিমা দাইফ, তাঁর কন্যা; এবং উম্মে ইব্রাহিম আসফুরা, তাঁর শাশুড়ি। আপনাদের এই ত্যাগ এবং অবিচলতার জন্য আমরা গভীর শ্রদ্ধা এবং সমবেদনা জানাই।
সূত্র : আল জাজিরা