তুফানুল আকসার ৪৬৭ দিনের মাথায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর হামাসের পলিটিকাল ব্যুরোর ডেপুটি চেয়ারম্যান শাইখ খলিল আল হাইয়ার দেয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তির বাঙলায়ন।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
كَتَبَ اللَّهُ لَأَغْلِبنَّ أَنَا وَرُسُلِي إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
‘আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়েছে, ‘আমি এবং আমার রাসূলগণ অবশ্যই বিজয়ী হবো।’ নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিশালী, পরাক্রমশালী।’ (সুরা মুজাদালাহ-২১)
সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি মুমিনদের অভিভাবক, তাঁর পথের সংগ্রামী মুজাহিদদের সাহায্যকারী, জালিম ও দাম্ভিকদের অপমানকারী এবং অহংকারী শাসকদের ধ্বংসকারী—যদিও তা কিছুটা সময় পরে ঘটে। সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি নিজের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন, নিজের বান্দাকে বিজয় দান করেছেন, নিজের সেনাবাহিনীকে সম্মানিত করেছেন এবং তার একক শক্তিতে সমস্ত দলের পরাজয় ঘটিয়েছেন। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের ক্বায়েদ (নেতা) ও ইমাম, সেই মহান ব্যক্তির প্রতি যিনি সর্বোত্তম-ভাবে লড়েছেন, সংগ্রাম করেছেন এবং আবারো প্রস্তুতি নিয়েছেন; আমাদের নবী, আমাদের উসওয়া (আদর্শ), প্রিয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর।
দরুদ ও সালামের পর, ইরশাদ হচ্ছে—
وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِينَ إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُورُونَ وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُونَ
‘আমার প্রেরিত বান্দাদের সম্পর্কে আমার এ কথা আগেই বলা আছে যে, তাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করা হবে। আর আমার সৈন্যরাই বিজয়ী হবে।’ (সুরা সাফফাত ১৭১-১৭৩)
প্রিয় ফিলিস্তিনি জনগণ, আরব ও মুসলিম উম্মাহ, এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামী পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষদের প্রতি—
ইতিহাস সৃষ্টিকরা আমাদের জাতির দীর্ঘদিনের জিহাদ ও সংগ্রামের সিলসিলার এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমরা আপনাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং গর্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষায় আমাদের বক্তব্য পেশ করছি।
হে আমাদের গর্বিত গাজার জনতা, হে ত্বাইফাতুল মানসুরা (বিজয়ী দল) এর সংগ্রামীরা, হে গাজার ইজ্জত ও আত্মমর্যাদা-শীল মানুষেরা, হে শহীদ, আহত, বন্দী ও নিখোঁজদের উত্তরাধিকারীগণ! আপনারা এমন ওয়াদা (প্রতিশ্রুতি) রক্ষা করেছেন, যা কেউ করেনি। এমন সবরের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা কেউ দেখেনি। এমন ত্যাগ স্বীকার করেছেন, যা ইতিহাসে অনন্য। আপনাদের এসবের মূল্য দেবে, কে আছে এমন! আপনারা সত্যিই আপনাদের দায়িত্ব উত্তমরূপে পালন করেছেন। আপনারা আত্মত্যাগের মুহূর্তে আত্মত্যাগ করেছেন, জিহাদের প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, এবং সবরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
আপনাদের এই মহান ত্যাগ ও সংগ্রামের জন্য আপনাদের প্রতি আমাদের অন্তর থেকে জানাই গভীর কৃতজ্ঞতা।
سَلَامٌ عَلَيْكُم بِمَا صَبَرْتُمْ ۚ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ
‘তোমাদের সবরের কারণে তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আর কতই না চমৎকার তোমাদের এ পরিণামের ঠিকানা ।’ (সূরা রা’দ: ২৪)
আমরা এই মূহুর্তে গভীরভাবে স্মরণ করছি এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করছি আমাদের মহান শহীদদের প্রতি। সেইসব শিশু, নারী, বৃদ্ধ, আলেম, মুজাহিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সিভিল ডিফেন্স কর্মী, নিরাপত্তা বাহিনী, সরকারী কর্মচারী, পুলিশ সদস্য এবং জনগণ ও পরিবারের নেতৃত্ব দানকারী মহান ব্যক্তিবর্গের প্রতি, যারা এই মুবারক জিহাদে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন; আল-কুদস ও আল-আকসার এ সংগ্রামে, তুফান আল-আকসা যুদ্ধে।
আরো অভিবাদন জানাচ্ছি সেই সকল মহান মুজাহিদদের প্রতি, যারা তাদের পর সংগ্রামের ঝাণ্ডাকে হাতে তুলে নিয়েছেন, জিহাদ জারি রেখেছেন এবং এর পূর্ণতায় পৌছাতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন।
وَكَأَيِّنْ مِنْ نَبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ
‘আর কত নবী যুদ্ধ করেছেন, তাদের সাথে বহু আল্লাহ-ওয়ালা ছিলেন। তবে আল্লাহর পথে তাদেরকে যা আক্রান্ত করেছে, তার জন্য তারা হতোদ্যম হননি। আর তারা দুর্বল হননি এবং তারা নত হননি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে ভালবাসেন’ (সূরা আলে ইমরান: ১৪৬)।
বিশেষ করে শ্রদ্ধা জানাই প্রতিরোধ যুদ্ধের সেই সকল মহান নেতা ও শহীদদের প্রতি, যারা এই যুদ্ধে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন; যাদের দেহাংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল জিহাদের ময়দানে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:
• শহীদ নেতা ইসমাইল হানিয়া (আবু আল-আবিদ)
• শহীদ নেতা ইয়াহইয়া সিনওয়ার (আবু ইবরাহিম)
• শহীদ নেতা শাইখ সালেহ আল-আরুবি (আবু মুহাম্মদ)
এবং গাজার ভেতরে ও বাইরে আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের সকল শহীদ নেতা, সেই-সঙ্গে প্রতিরোধ আন্দোলনের সকল সংগঠন ও তাদের সদস্যদের মধ্যে যারা এই পথে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমরা কাউকেই ভুলে যাইনি।
আমরা আমাদের জনগণদের আনন্দের সাথে জানাচ্ছি এবং মহান শহীদদের বলি:
‘আমাদের নেতা ও শহিদেরা সফল হয়েছেন, কসম আল্লাহর। আপনারা আল্লাহর সঙ্গে এমন এক বাণিজ্য করেছেন যা কখনও ব্যর্থ হবার নয়।’
আমরা দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছি যে, এই শহীদ নেতাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা আমাদের এ সংগ্রামের যাত্রা অব্যাহত রাখব। এই যাত্রার শেষ গন্তব্য হবে—হয় বিজয়, নয়তো শাহাদাত; ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় ফিলিস্তিনি জনগণ, আরব ও মুসলিম উম্মাহ, এবং বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামী মানুষেরা
‘তুফানুল আকসা’ যুদ্ধ আমাদের মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে এবং মহান ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিরোধের দাস্তানে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এই যুদ্ধের প্রভাব শেষ হয়ে যাবে না, বরং এর ধারা অব্যাহত থাকবে যুগ যুগান্তরে ইনশাআল্লাহ।
৭ই অক্টোবরের সেই দিন ছিল কাসসাম ব্রিগেডের এক অভূতপূর্ব বিস্ময়কর সামরিক কৃতিত্ব অর্জনের দিন। এটি আমাদের জনগণ ও প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য এমন এক গৌরবময় অধ্যায়, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্থানান্তরিত হবে। এই অর্জন দখলদার শত্রুর হৃদয়ে গভীর আঘাত হেনেছে এবং এটি আমাদের পূর্ণ অধিকার পুনঃ-প্রতিষ্ঠার পথে এক বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ইনশাআল্লাহ, শত্রুরা খুব শীঘ্রই আমাদের ভূমি, আমাদের আল কুদস (জেরুজালেম) এবং আমাদের পবিত্র মসজিদুল আকসা থেকে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে।
তবে, দখলদার শত্রু এবং তার দোসররা আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে যে নৃশংস গণহত্যা, নাৎসি যুদ্ধাপরাধ এবং ৪৬৭ দিনব্যাপী বর্বর দমন অভিযান পরিচালনা করেছে, তা ইতিহাসের এক ঘৃণ্য ও করুণ অধ্যায় হিসেবেও চিরকাল রয়ে যাবে। এই নির্যাতন, নৃশংসতা ও যন্ত্রণা—যা বিশ্ব মানবতার প্রতি কলঙ্ক এবং নীরব বিশ্বের জন্য লজ্জার কারণ—তা তাদের ললাট থেকে কখনোই মুছে যাবে না।
আমাদের জনগণের ওপর ফেলা প্রতিটি বোমা, ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রতিটি বাড়ি, নিহত প্রত্যেক শিশু ও নারী, আহত প্রতিটা মানুষ এবং এই সমস্ত ধ্বংসযজ্ঞ, গণহত্যা, নৃশংসতা আর অপরাধের জন্য দখলদার ও তাদের সহযোগীদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। আজ হোক বা কাল, কিংবা কিছুটা সময় পর—ইনসাফ কায়েম হবেই। আমাদের জনগণ কখনোই তাদের ভুলবে না, যারা এই গণহত্যায় কোন না কোনভাবে অংশ নিয়েছে, যারা রাজনৈতিক ও মিডিয়া সমর্থন দিয়েছে, অথবা যারা হাজারো টন বোমা ও বিস্ফোরক সরবরাহ করেছে, যেগুলি গাজা উপত্যকায় আমাদের পরিবার, সন্তান, কন্যা এবং শিশুদের মাথায় পড়েছে—তারা সব মনে রাখবে। আমরা নিশ্চিত যে, এই সব অপরাধীরা তাদের করা প্রতিটি কাজের জন্য তাদের প্রাপ্য শাস্তি পাবে, যদিও তা কিছুটা সময় পরে হয়।
যদিও আমাদের জনগণ অগণিত দুর্দশা এবং কষ্টের সম্মুখীন হয়েছে; স্বীকার হয়েছে এমন সব নৃশংসতার, যা দেখে শিশুরাও বৃদ্ধ হয়ে যেত, তবুও আমরা আমাদের এই সংগ্রাম নিয়ে গর্বিত, আমাদের বীর সেনানীদের এবং সংগ্রামীদের নিয়ে গর্বিত, এবং আমাদের ধৈর্যশীল জনগণদের নিয়ে গর্বিত। শত্রুর এ সমস্ত অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার পরও আমাদের জনগণ ধৈর্য, সাহস ও গৌরবের প্রতীক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের শত্রু কখনোই আমাদের মধ্যে দুর্বলতা বা ভাঙ্গন দেখতে পাবে না।
প্রতিটা এতিম শিশু, বিধবা নারী, ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ির মালিক, শহীদ, আহত ও শোকাত পরিবারগুলো, সংগ্রামী মুজাহিদ, প্রতি ফোটা রক্ত, প্রতিটা যন্ত্রণা, ব্যথা আর অভিমানী অশ্রুর পক্ষ থেকে আজ আমরা ঘোষণা দিচ্ছি—আমরা ভুলব না, আমরা ক্ষমা করব না। হ্যাঁ, আমরা ভুলব না এবং ক্ষমাও করব না। আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, কেউই নেই, যারা এই সমস্ত যন্ত্রণা এবং ত্যাগের হককে উপেক্ষা করবে কিংবা ভুলে যাবে।
প্রিয় ফিলিস্তিনি জনগণ, আরব ও মুসলিম উম্মাহ এবং বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামী মানুষদের প্রতি
দখলদার শক্তি তাদের আগ্রাসনের শুরু থেকেই বহু লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করেছে। কিছু লক্ষ্য তারা প্রকাশ করেছে, আর কিছু গোপন রেখেছে। তারা খোলাখুলি-ভাবে বলেছে যে, তাদের উদ্দেশ্য প্রতিরোধ আন্দোলনকে ধ্বংস করা, হামাসকে নির্মূল করা, সামরিক শক্তি ব্যবহার করে বন্দীদের মুক্ত করা এবং গোটা গাজা অঞ্চলের চেহারা বদলে দেওয়া। তবে বাস্তবিক অর্থে এর অন্তর্নিহিত ও প্রকৃত লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনি ইস্যুকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা, গাজা উপত্যকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা, এর জনগণের উপর প্রতিশোধ নেওয়া, তাদের বাস্তু-চ্যুত করা এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের ইচ্ছাশক্তিকে একেবারে চূর্ণ করে দেয়া। পাশাপাশি, ৭ই অক্টোবরের মহা-কাব্যিক ‘তুফানুল আকসা’ প্রতিরোধে পরাজয়ের চিহ্ন মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রও ছিল তাদের এক অশুভ উদ্দেশ্য।
কিন্তু দখলদার শত্রুরা আমাদের জনগণের পাহাড়-সম দৃঢ় প্রত্যয় ও মাটির প্রতি তাদের অলঙ্ঘনীয় অঙ্গীকারের সঙ্গে সংঘর্ষে পরাজিত হয়েছে। তারা তাদের ঘোষিত বা গোপন কোনো লক্ষ্যই অর্জন করতে পারেনি। আমাদের জনগণ তাদের ভূমি ছেড়ে যায়নি, মাইগ্রেশন করেনি; বরং তারা পুরোটা সময় এবং এখনো কাজ করেছে এবং করছে প্রতিরোধের এক অভেদ্য ঢাল হিসেবে।
কাসসাম ব্রিগেডের বীর মুজাহিদরা, তাদের সহকর্মী প্রতিরোধ বাহিনীর যোদ্ধাদের সঙ্গে, বিশ্বকে তাদের অসাধারণ সাহসিকতা এবং অভূতপূর্ব অভিযানের মাধ্যমে চমকে দিয়েছে। তারা অভিনব কৌশল, সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। যুদ্ধের প্রতিটি পর্যায়ে, ইক্বদামি (আগ বাড়িয়ে আক্রমণ) এবং দিফায়ি (প্রতিরক্ষা) উভয় ক্ষেত্রেই তারা সম্মান ও নৈতিকতার সঙ্গে লড়াই করেছে। প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণে তারা এমন উদাহরণ স্থাপন করেছে, যা বিশ্ব আগে কখনো দেখেনি। তাদের এই আত্মত্যাগ ছিল অতুলনীয়। তারা শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক স্থাপন করেছে, গোলাবারুদ ছুঁড়েছে, এম্বুশ পেতেছে এবং শূন্য দূরত্ব থেকে লড়াই করেছে। যুদ্ধে তারা শত্রুদের এমন তীব্রতর ভাবে ‘স্বাগত’ জানাচ্ছিল যে, দখলদার বাহিনীর যুদ্ধযানগুলো জ্বলন্ত কফিনে পরিণত হয়েছিল। জিহাদের ময়দানে তারা এবং তাদের সহযোগী প্রতিরোধ গোষ্ঠিগুলো এমনই বীরোচিত-ভাবে লড়াই চালিয়ে গিয়েছে।
এখানে আমরা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই প্রতিরোধ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ‘সারায়া আল-কুদস’-এর কথা। তারা কাসসাম ব্রিগেডের মুজাহিদদের মতোই বীরত্ব, আত্মত্যাগ এবং ঈমানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা তাদের প্রাণকে আল্লাহর পথে, তাদের মাতৃভূমি এবং জনগণের রক্ষার জন্য সস্তায় বিক্রি করে দিয়েছে।
আজ আমরা চিৎকার করে ঘোষণা দিচ্ছি যে, আল্লাহর ফজল ও তাওফিকে; দখলদার শক্তি আমাদের জনগণ ও প্রতিরোধ আন্দোলনকে পরাজিত করতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও কখনোই পারবে না—আর এটা দুনিয়ার সামনে প্রমাণও হয়ে গেছে। তারা শুধুমাত্র ধ্বংসযজ্ঞ, গণহত্যা এবং আমাদের জনগণের ওপর নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারেনি। তাদের বন্দীদের মুক্ত করার যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা কেবলমাত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ও আক্রমণ বন্ধের একটি সমঝোতার মাধ্যমে এবং একটি সম্মানজনক বন্দী বিনিময়ের চুক্তির ভিত্তিতেই হয়েছে।
তাই আমরা পুরো আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি যে, আমাদের জনগণের অবিচল দৃঢ়তা, তাদের অসীম আত্মত্যাগ, এবং প্রতিরোধ আন্দোলনের অভূতপূর্ব সাহসিকতা দখলদারদের ঘোষিত এবং গোপন সব লক্ষ্যকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।
আমাদের জনগণের ইচ্ছাশক্তি আজও স্বাধীন, অবিচল এবং অটুট। এটি কখনো কোনো দুর্বলতা বা বিশ্বাসঘাতকতার কালিমায় কলুষিত হয়নি। বরং আল্লাহর সাহায্যে ও ইমানদারদের সহযোগিতায় আমাদের জাতি আজও সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
هُوَ الَّذِي أَيَّدَكَ بِنَصْرِهِ وَبِالْمُؤْمِنِينَ
‘তিনিই তোমাকে শক্তি যুগিয়েছেন স্বীয় সাহায্য ও মুমিনদের মাধ্যমে।’ (সূরা আল-আনফাল: ৬২)
বিশ্বস্ত ও উদার-প্রাণ আমাদের প্রিয় জনগণ,
আজ আমরা যুদ্ধ ও আগ্রাসন বন্ধে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর ঘোষণা করছি। এই মহান মুহূর্তে, আমরা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি সেই সকল ব্যক্তি ও সংগঠনকে, যারা কঠিন-তম সময়ে আমাদের, আমাদের জনগণ এবং প্রতিরোধ আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
বিশেষভাবে আমরা স্মরণ করি আমাদের প্রিয় লেবাননের সহযোগীদের। তারা—বিশেষ করে হিজবুল্লাহর ভাইরা—পবিত্র কুদসের পথে শত শত প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সম্মানিত নেতা সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহ এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সাহসী যোদ্ধারা। একই সঙ্গে আমরা কৃতজ্ঞ লেবাননের ইসলামি গোষ্ঠী এবং সেখানকার জনগণের প্রতি, যারা প্রতিরোধের পথে অসামান্য ত্যাগ ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন এবং ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারা নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে বীরত্বের অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং দখলদারদের জীবনকে নরকে পরিণত করেছেন। একতা ও পারস্পরিক সমর্থনের এমন চিত্র তুলে ধরেছেন, যা ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও আরব ঐক্যের প্রকৃত মর্মের সেরা নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হবে। আমরা আন্তরিকভাবে আরো স্মরণ করছি ইয়েমেনের ‘আনসারুল্লাহ’ গোষ্ঠীকে, যারা ভৌগোলিক দূরত্বকে অতিক্রম করে সত্যিকারের ভ্রাতৃত্বের নজির স্থাপন করেছেন। তারা যুদ্ধ ও অঞ্চলের সমীকরণ বদলে দিয়েছেন, দখলদারদের হৃদয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আঘাত হেনেছেন এবং লোহিত সাগরে তাদের অবরুদ্ধ করেছেন। আমরা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি, ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কথা, যারা আমাদের প্রতিরোধ আন্দোলন ও জনগণকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছেন। তারা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন এবং ‘আল-ওয়াদুস-সাদেক’ নামে পরিচালিত অপারেশনের মাধ্যমে দখলদারদের কেন্দ্রে আঘাত হেনেছেন। ইরাকের প্রতিরোধ আন্দোলনকেও আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তারা সব বাধা অতিক্রম করে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আমাদের দখলকৃত ভূমিতে পৌঁছেছে।
আমরা স্মরণ করছি, আমাদের প্রিয় পশ্চিম তীরের বীর যোদ্ধা, তরুণ বিপ্লবী এবং মুজাহিদদের কথাও, বিশেষত জেনিন শিবিরের প্রতিরোধ ও বীর মুজাহিদদের, এবং সেই-সঙ্গে জেরুজালেম ও অভ্যন্তরীণ দখলকৃত অঞ্চলগুলির সংগ্রামী জনগণকেও। আমরা আমাদের প্রবাসী ও উদ্বাস্তু জনগণ এবং আমাদের আরব ও ইসলামি বিশ্বের জনগণকেও গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি; সকলের প্রতি জানাই, আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা।
এছাড়াও, আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই মধ্যস্থতাকারী কাতার ও মিসরের প্রতি। এই দুই রাষ্ট্রের ভাইয়েরা প্রথম দিন থেকেই নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং একাধিক দফা আলোচনার মাধ্যমে আজকের এই মুহূর্তে পৌঁছানোর পথ তৈরি করেছেন। তারা আমাদের জনগণের ওপর চলমান যুদ্ধ ও গণহত্যা বন্ধ করার জন্য সবরকম চেষ্টা করেছেন।
এবং আমরা স্মরণ করছি, সেই সকল দেশকে যারা বিশ্বের বিভিন্ন মঞ্চে আমাদের সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন, বিশেষভাবে তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, আলজেরিয়া, রাশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য সব দেশকে যারা ফিলিস্তিনের ন্যায়বিচারের পক্ষে এবং গাজার নিপীড়িত জনগণের প্রতি সাহসিকতার সাথে সমর্থন জানিয়েছেন।
আমরা পৃথিবীর সমস্ত মুক্তিকামী মানুষকে স্মরণ করছি এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি—যারা আমাদের সাথে তাদের কথা, কলম, কণ্ঠ, ছবি, প্রতিবাদ, মিছিল, বয়কট, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, আইনগত সহায়তার মাধ্যমে পাশে ছিলেন। এবং যারা এই আগ্রাসন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে অঞ্চল আর বিশ্বব্যাপী আওয়াজ তুলেছেন। সেই সকল মুক্তিকামী মানুষের প্রতি আমাদের অনন্ত কৃতজ্ঞতা যারা নীরব থাকার ক্রমবর্ধমান ষড়যন্ত্রকে ভঙ্গ করেছেন এবং গাজায় দখলদার বাহিনীর মানবতা বিরোধী অপরাধ বিশ্ববাসীর সামনে ফাঁস করেছেন। তারা এই অমানবিক দৃশ্যের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছেন এবং পৃথিবীকে একটি সত্য ও ন্যায়পরায়ণ দৃষ্টিকোণ উপস্থাপন করেছেন।
হে গাজার মহান মানুষেরা,
আমরা এখন নতুন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি, এটি আমাদের গর্বিত গাজা নগরের পুনর্নির্মাণ, সমবেদনা, এবং আক্রমণের ক্ষত মুছতে শুরু করা এক নতুন অধ্যায়। এটি আমাদের দৃঢ় সংকল্প এবং ঐক্যের সময়। আমরা বিশ্বের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিতে চাই—আমরা একটি মুক্ত জাতি, যারা ধ্বংস নয়, বরং নির্মাণে বিশ্বাসী। আমরা আমাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত ভূমি পুনর্নির্মাণ করব, এবং যুদ্ধের মধ্যে আপনারা যে অকল্পনীয় সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সেই সাহসিকতা নিয়েই ইনশাআল্লাহ আমরা পুনরায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াব।
আমরা এখন করুণা ও সহমর্মিতার এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অবস্থান করছি। আমাদের উপর দিয়ে বয়ে গেছে যে দুঃখ কষ্টের ভয়াল স্রোত, তা বিরাট বিশাল, তবে আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের জনগণের মহত্ত্ব তার চেয়েও অনেক বড় এবং নৈতিকতায় তারা আরো মহান। আমরা আল্লাহর সাহায্য এবং আমাদের ভাইবোন, বন্ধু, সহানুভূতিশীলদের সাহায্যে গাজাকে আবারও পুনর্নির্মাণ করব ইনশাআল্লাহ। আমাদের বুকের ভেতর গড়ে উঠেছিল যে যন্ত্রণা তা লাঘব করবো আমরাই, আমাদের ক্ষতগুলোকে সারিয়েও তুলব, মাথায় সোহাগ দিয়ে হাত বুলাব এতিমদের, শোকাতদের চোখের জল মুছে দেবো, এবং যুদ্ধ আমাদের ঠোট থেকে কেড়ে নিয়েছিল যে অনন্ত হাসি, আবারো আমরা ঠোটের কোনে ফুটিয়ে তুলবো সেই চির সবুজতা। এবং বন্দি থাকা আমাদের সংগ্রামী বীর মুজাহিদরা আল্লাহর দয়ায় শিগগিরই মুক্তির জ্বলমলে আলোয় গাজায় ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ।
আমরা আমাদের ফিলিস্তিনি ভাই ও সমস্ত প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সঙ্গে একত্র হয়ে জাতীয় ঐক্যকে শক্তিশালী ও সুসংহত করে আমাদের সংগ্রামকে অব্যাহত রাখবো। আমরা আবারো নির্মাণ করব এবং আমাদের জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের পথে যাত্রা অব্যাহত রাখব।
শেষ কথা হলো, এই সংগ্রাম শুরু হয়েছিল পবিত্র আল কুদসকে (জেরুজালেম) ঘিরে, কুদস এবং আল-আকসাই হলো আমাদের সংগ্রাম ও প্রতিরোধের মূল প্রতিপাদ্য এবং কেন্দ্রবিন্দু। এ সংগ্রাম চলবে, যতক্ষণ না আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হয় এবং আমাদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যার রাজধানী হবে কুদস (জেরুজালেম)—ইনশাআল্লাহ।
সালাম ও শ্রদ্ধার নিবেদন মহান শহীদদের প্রতি, যারা নিজেদের রক্তধারায় আমাদের মহান স্বাধীনতার পথে প্রদীপ জ্বালিয়েছেন। সালাম ও কৃতজ্ঞতা আমাদের সাহসী আহত বীরদের প্রতি, যারা অবিচল থেকেছেন জিহাদে, যাঁদের ত্যাগের আলোয় আমাদের সংগ্রাম আরো উজ্জ্বল হয়েছে। গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তাদের জন্য, যারা এ নিষ্ঠুর যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, শোক-বিহ্বল হয়েছেন, কিন্তু তবু সাহস হারাননি।
বিশেষ সালাম আমাদের দৃঢ় অটল বন্দিদের প্রতি, যারা দখলদার শক্তির কারাগারে অন্ধকারে দুঃখে কষ্টে থেকেও স্বাধীনতার আলো দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। সেই শুভ প্রভাত আসছে ইনশাআল্লাহ, খুব শীঘ্রই।
আর গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের প্রতি, যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, আমাদের জন্য রক্ত ঢেলেছেন, তাদের শক্ত অবস্থান দিয়ে, তাদের শব্দ আর সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের সমর্থন জানিয়েছেন।
পরিশেষে, আপনাদের সকলের প্রতি সালাম, এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক আপনাদের উপর।
আরবি থেকে অনুবাদ—নাসরুল্লাহ ইবনে ইলিয়াস