দক্ষিণ সিরিয়ায় ইসরায়েলের সামরিক উপস্থিতি এখন আর কেবল অস্থায়ী কোনো কৌশলগত পদক্ষেপ নয়; এটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থায়ী হতে যাচ্ছে—এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎস। গত ২৮ জানুয়ারি সিরিয়ার জাবাল আশ-শেইখ পর্বত পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, ইসরায়েলি সেনারা গোলান মালভূমি এবং উত্তর ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দক্ষিণ সিরিয়ায় তাদের অবস্থান আরো শক্তিশালী করবে।
এই ঘোষণার পর মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ শুধু সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেও নাড়া দেবে।
ইসরায়েলের এই ঘোষণার পরদিন, ২৯ জানুয়ারি, সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েল যদি সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে সরে আসে, তবে তারা সেই অঞ্চলগুলোর দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। তবে এই বিবৃতিই প্রমাণ করে, দামেস্ক সরকার ইসরায়েলের এই কর্মকাণ্ডে এখন কঠিন চাপে রয়েছে।
সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমাদ আশ-শারা সাম্প্রতিক এক ভাষণে বলেন, ‘দেশের অখণ্ডতা নিশ্চিত করা এবং একক সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই আমাদের অগ্রাধিকার।’ তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সিরিয়ার সামরিক ও কূটনৈতিক শক্তি সীমিত থাকায় কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা তাদের জন্য সহজ নয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. ফয়সাল আব্বাস মোহাম্মদ বলেন, ‘সিরিয়ার জন্য জাতিসংঘের কাছে অভিযোগ দায়ের করা একমাত্র বৈধ কূটনৈতিক পথ হতে পারে, তবে তা খুব একটা কার্যকর হবে না। কারণ জাতিসংঘে যেকোনো কড়া প্রস্তাবই মার্কিন ভেটোর মুখে পড়ে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যস্থতা একটি সম্ভাব্য পথ হতে পারে। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো দেশ, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ রক্ষা করছে। তবে এ ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ইসরায়েল তাদের সামরিক উপস্থিতিকে কেবল প্রতিরক্ষা নয়, বরং রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করছে। ড. ফয়সাল মোহাম্মদ মনে করেন, ইসরায়েল এই দখলকৃত অঞ্চলগুলোকে ভবিষ্যতে দামেস্কের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, বিশেষ করে যদি আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সিরিয়ার ওপর কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার চাপ তৈরি করে।
ড. মুহাম্মদ বলেন ‘ইসরায়েল সাধারণত বিনিময় ছাড়া কোনো দখলকৃত অঞ্চল ছাড়ে না, তারা এই ভূখণ্ডগুলোকে সৌদি আরব বা অন্য উপসাগরীয় দেশের সাথে সম্ভাব্য সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দরকষাকষির অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে।’
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাৎসও তার বক্তব্যে স্পষ্ট করেছেন, ‘গোলান মালভূমি এবং উত্তর ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসরায়েলি সেনারা অনির্দিষ্টকালের জন্য দক্ষিণ সিরিয়ায় অবস্থান করবে।’
ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলছে। ড. মোহাম্মদের মতে, এই দখলদারিত্বের ফলে দামেস্ক সরকার রাজনৈতিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন ‘যদি সিরিয়ায় কোনো শক্তিশালী, জনগণের সমর্থনপুষ্ট সরকার গড়ে ওঠে, সেটি ইসরায়েলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে,’ অন্যদিকে, যদি বর্তমান সরকার ইসরায়েলের প্রতি নমনীয় থাকে, তবে এটি জনগণের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেবে।’
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার ইসরায়েলের প্রতি আক্রমণাত্মক কোনো অবস্থান না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও ভবিষ্যতে যদি কোনো ‘জাতীয়তাবাদী এবং সাহসী’ সরকার ক্ষমতায় আসে, তবে গোলান মালভূমি পুনরুদ্ধার বা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন ইসরায়েলের দখলকৃত অঞ্চলগুলো রাজনৈতিক চাপের শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
বাশার আল-আসাদের শাসন পতনের পর থেকে ইসরায়েল দক্ষিণ সিরিয়ায় তাদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপন ও সম্প্রসারণ শুরু করে। বর্তমানে সিরিয়াতে ইসরায়েলের ছয়টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যার মধ্যে পাঁচটি ১৯৭৪ সালের অস্ত্রবিরতি চুক্তির আওতাধীন নিরপেক্ষ অঞ্চলে এবং একটি নিরপেক্ষ এলাকার বাইরে অবস্থিত।
নিরপেক্ষ অঞ্চলের ভেতরে অবস্থিত ঘাঁটিগুলো:
• হাদার অঞ্চলে দুটি ঘাঁটি: তালুল আল-আহমার এবং কারস আন-নাফাল
• হামিদিয়া ও হুরিয়া গ্রামের মধ্যবর্তী একটি ঘাঁটি
• সাদ আল-মুনতারা এলাকায় একটি ঘাঁটি
• জাবাতা আল-খাশব এলাকায় একটি ঘাঁটি
নিরপেক্ষ এলাকার বাইরে অবস্থিত ঘাঁটি:
• কুদনা অঞ্চলে অবস্থিত একটি সামরিক ঘাঁটি
এই সামরিক ঘাঁটিগুলো দক্ষিণ সিরিয়ায় ইসরায়েলের কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। এর ফলে সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব গুরুতর হুমকির মুখে পড়েছে।
ইসরায়েলের এই দখলদারিত্বের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে নীরব। বড় শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থ এবং জাতিসংঘের সীমিত ক্ষমতা এই সংকটের সমাধানকে আরও জটিল করে তুলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ এবং বড় শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে ইসরায়েলের এই দখলদারিত্ব অব্যাহত থাকতে পারে। এর ফলে ভবিষ্যতে সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব, এবং মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক স্থিতিশীলতার ওপর নতুন করে প্রশ্ন উঠবে।
ইসরায়েলের দক্ষিণ সিরিয়ায় স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি কেবল একটি সামরিক কৌশল নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক হিসাব। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা আগামী দিনে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
সূত্র: ইনাব বালাদি