মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

দামেশক আবু উবায়দা ও খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. এর আমানত : বিজয়ী ভাষণে আশ শারা

সিরিয়ার উপকূলীয় পরিস্থিতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট আহমাদ আশ-শারার ভাষণ
সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমদ আশ-শারা। ছবি : সংগৃহীত

বিদ্রোহী জোটের প্রধান আহমাদ আশ শারা ওরফে আবু মুহাম্মদ আল জাওলানিকে সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি গতকাল জাতির উদ্দেশে এক বিজয়ী ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি যুদ্ধ-পরবর্তী সিরিয়া পুনর্গঠনের রূপরেখা তুলে ধরেন এবং জনগণের প্রতি নতুন প্রত্যাশার কথা জানান।

ভাষণের শুরুতেই আহমাদ আশ শারা দামেস্কের বেদনার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘কয়েক মাস আগে, দামেস্ক আমাকে এক আত্মত্যাগী মায়ের মতো আহ্বান জানিয়েছিল—যেন সে তার সন্তানদের করুণ দৃষ্টিতে দেখছে, অভিমানী আর অসহায়। তার গায়ে ছিল জখমের চিহ্ন, তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত ছিল লাঞ্ছনা আর অপমানে। সে রক্তাক্ত ছিল, যন্ত্রণা সহ্য করছিল, কিন্তু টিকে থাকার চেষ্টা করছিল। সে যেন আমাদের বলছিল, ‘আমার জাতিকে রক্ষা করো, রক্ষা করো, যেন তোমাদের লজ্জায় না পড়তে হয়!’

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, দামেস্ক একসময় গৌরবের প্রতীক ছিল, সিরিয়া ছিল সভ্যতা ও ইতিহাসের দেশ। তিনি বলেন, ‘দামেস্ক—যে আমাদের পূর্বের গৌরবের উত্তরাধিকার দিয়েছে, যে আমাদের সম্মানের প্রতীক। শাম—যে মহান আল্লাহর পছন্দের ভূমি। সিরিয়া—যে ইতিহাস ও সভ্যতার স্বাক্ষর বহন করে। এ ভূমি যে আমানত ছিল আবু উবাইদা বিন জাররাহ ও খালিদ বিন ওয়ালিদের হাতে। কিন্তু গত শাসনকালে সিরিয়া এক দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে গেছে।’

‘হে দামেস্ক! তোমার কান্নার আর্তনাদ আমাদের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করেছিল। এর চেয়ে বড় লাঞ্ছনা আর কী হতে পারে যে, এক দানবীয় শাসকের অধীনে তুমি কষ্ট পেয়েছো? তারা তোমার ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে, তোমার সন্তানদের উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে, তাদের কারাগারে বন্দি করে নির্যাতন চালিয়েছে। তারা তোমাদের শরীরে গরম লোহা চাপিয়ে দিয়েছিল, এমনকি এসিড দিয়ে তোমাদের মৃতদেহ পুড়িয়ে দিয়েছিল!’

সংকল্প ও বিজয় অর্জনের গল্প

আহমাদ আশ শারা বলেন, ‘আমরা তোমাকে হৃদয়ের গভীর থেকে ডেকেছিলাম— ও দামেস্ক, দাঁড়াও! উঠে দাঁড়াও! ধৈর্য ধরো!’

‘আমরা সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলাম, আমাদের সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করেছিলাম, আমাদের লক্ষ্য স্থির করেছিলাম। এরপর আমরা আমাদের শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছিলাম—আল্লাহর অনুগ্রহে অবশেষে দামেস্ককে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছি।’

‘আমরা শৃঙ্খল ভেঙেছি, নির্যাতিতদের মুক্ত করেছি, দামেস্কের লাঞ্ছনা ও অপমান মুছে দিয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ আজ সিরিয়ার আকাশে নতুন সূর্য উদিত হয়েছে!’

তিনি আরও বলেন, যখন বিজয়ের ঘোষণা আসে, তখন মানুষ উল্লাসে তাকবির দেয়, আল্লাহর প্রশংসা করে। সত্যের জয় হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জুলুম বিলীন হয়েছে।

বিজয়ের চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ পুনর্গঠন

আহমদ আশ শারা বলেন, যুদ্ধ শেষ হলেও কাজ এখনও বাকি। সাধারণত যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, রক্তপাত ও অরাজকতা। কিন্তু সিরিয়ার বিজয় এসেছে ন্যায়বিচার, দয়া ও মহানুভবতার মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি মনে করে যে যুদ্ধ মানেই নৈতিকতার পরিসমাপ্তি, তবে সে ভুল করে। বরং ক্ষমতা, সম্পদ ও অস্ত্র—এসব যদি নৈতিকতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে তা এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্ম দেয়।’

তিনি বলেন, বিজয়ের পরপরই যদি বিজয়ীরা অহংকারে আক্রান্ত হয় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ভুলে যায়, তবে তারা ধ্বংসের পথে চলে যায়।

‘এখন কেউ যদি মনে করে যে কষ্টের সময় পেরিয়ে গেছে এবং এখন আরাম-আয়েশের সময়, তবে সে ভুল করছে। সিরিয়ার আজ আগের চেয়েও বেশি কিছু প্রয়োজন। ঠিক যেমন আমরা এক সময় সংকল্প করেছিলাম দেশকে মুক্ত করার, তেমনি এখন আমাদের সংকল্প করতে হবে দেশকে পুনর্গঠনের।’

আজ সিরিয়ার অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত?

সর্বপ্রথম, রাষ্ট্রীয় শূন্যতা পূরণ করতে হবে বৈধ ও আইনসম্মত প্রক্রিয়ায়।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক শান্তি রক্ষা করতে হবে। প্রতিশোধের পথ বন্ধ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করতে হবে। নিরাপত্তা, সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন করা জরুরি, কারণ জনগণের নিরাপত্তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

চতুর্থত, অর্থনৈতিক ভিত্তি পুনর্গঠন করতে হবে। কৃষি, শিল্প, জনসম্পদ উন্নয়ন এবং সেবা খাতকে পুনরায় গড়ে তুলতে হবে।

পঞ্চমত, সিরিয়া তার আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার করবে। বিদেশি সম্পর্ক গড়ে তুলবে ভ্রাতৃত্ব, সম্মান, সার্বভৌমত্ব এবং পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে।

‘আমরা অতীতের গৌরব ফিরিয়ে আনব’

আহমদ আশ শারা বলেন, মানুষ বারবার অতীতের গৌরবের কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত। কিন্তু আজকের এই মহান বিজয়ে, সিরিয়া তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করেছে।

তিনি ঘোষণা দেন, ‘আজ আমরা গর্ব করে বলতে পারি—আমরা ছিলাম, আমরা করেছি, এবং আমরা আবারও করব ইনশাআল্লাহ!’

‘ওহে ইতিহাস! ফিরে এসো! আবারও তোমার পৃষ্ঠাগুলো স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হোক!’

সব শেষে তিনি বলেন, এই বিজয় শুধু সিরিয়ার নয়, বরং তাদেরও, যারা এই যুদ্ধে সিরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে। ‘এই বিজয় আমাদের, তোমাদের, সমগ্র সিরিয়ার, এবং যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের সবার! আলহামদুলিল্লাহ!’

সিরিয়া এখন এক নতুন ভোরের দ্বারপ্রান্তে। তবে এই বিজয় ধরে রাখা এবং দেশকে সত্যিকার অর্থে গড়ে তোলা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আহমদ আশ শারার ভাষণে সেই বার্তাই প্রতিফলিত হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা