মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

বিদ্রোহীদের সম্পর্কে আসাদের গোয়েন্দা বাহিনী কী আগ থেকেই জানত?

বিদ্রোহীদের সম্পর্কে আসাদের গোয়েন্দা বাহিনী কী জানত?
বিদ্রোহীদের সম্পর্কে আসাদের গোয়েন্দা বাহিনী কী জানত?। ছবি : আল জাজিরা

সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের বিশাল গোয়েন্দা সংস্থা বিদ্রোহীদের দ্রুত অগ্রযাত্রা ঠেকাতে কেন ব্যর্থ হয়েছিল, তার একটি স্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি সম্প্রতি কিছু গোপন নথি পর্যালোচনা করেছে, যেগুলো আসাদ সরকারের পতনের সময় তড়িঘড়ি করে লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল।

এই নথিগুলো বিশ্লেষণ করে উঠে এসেছে, কীভাবে আসাদের প্রশাসন ও তার গোয়েন্দা বাহিনী দেশের পরিস্থিতি অনুধাবন করতে এবং নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সংগ্রাম করছিল। সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়া, গোয়েন্দা সংস্থার বিভ্রান্তি, বিদ্রোহীদের সুসংগঠিত পরিকল্পনা এবং বিদেশি শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা—এসবের কারণেই একসময়ের কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকা শাসন ব্যবস্থা কয়েক মাসের ব্যবধানে ধসে পড়ে।

আলেপ্পোর পতন ও সেনাবাহিনীর পিছু হটা

প্রতিবেদন অনুসারে, সিরিয়ার সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরে পাঁচ পৃষ্ঠার একটি গোপন বার্তা পৌঁছায়, যা আলেপ্পোতে আসাদ বাহিনীর পরাজয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই পাঠানো হয়েছিল। সেখানে উল্লেখ করা হয়, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটি রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল, কিন্তু তারা বিদ্রোহীদের সামনে টিকতে পারেনি।

বার্তায় আরও বলা হয়, ‘একটি উন্মত্ত ও অপ্রত্যাশিত’ পিছু হটার মধ্য দিয়ে আসাদ বাহিনী শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আতঙ্কগ্রস্ত সেনারা অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক যানবাহন ফেলে রেখে দিকবিদিক ছুটতে থাকে।

এই নথিগুলোই স্পষ্ট করে দেয়, বিদ্রোহীদের অগ্রগতি কতটা সুসংগঠিত ছিল এবং আসাদ বাহিনীর মনোবল কীভাবে ভেঙে পড়েছিল।

গোপন নথি কী বলছে?

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিকরা এক পরিত্যক্ত ভবন থেকে হাজারো গোপন গোয়েন্দা নথি উদ্ধার করেন। এই নথিগুলোতে উঠে আসে, কীভাবে একসময়ের শক্তিশালী একনায়কতান্ত্রিক সরকার কয়েক মাসের ব্যবধানে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অবশেষে সম্পূর্ণ পতনের মুখে পড়ে।

বিদ্রোহীদের ছদ্মবেশ কৌশল ও গোয়েন্দা বার্তা

প্রকাশিত নথিপত্র অনুযায়ী, সিরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা বিদ্রোহীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলের ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্ক করেছিল।

তাদের তথ্য ছিল, বিদ্রোহীরা সরকারি বাহিনীর মতো ছদ্মবেশ নেবে—সরকারপন্থী পতাকা বহন করবে, এমনকি আসাদের ছবি ধারণ করেও নিজেদের সরকারি সেনা বলে পরিচয় দেবে।

এছাড়া, বিদেশি হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার ভেতরে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, আসাদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ার কারণে সিরিয়ায় বাইরের শক্তিগুলোর ভূমিকা নিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী বেশ চিন্তিত ছিল।

বিদ্রোহীদের অগ্রযাত্রা ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিক্রিয়া

৩০ নভেম্বর ২০২৪ সালের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি নজরে এসেছে। বিশেষ করে, উত্তর সিরিয়ার বিদ্রোহীরা দক্ষিণাঞ্চলের ‘স্লিপার সেল’ বা ঘুমন্ত বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কঠোর করার সুপারিশ করা হয়।

একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘সিরিয়ার সেনাবাহিনী যদি আকস্মিকভাবে হায়াত তাহরির আশ-শামের ঘাঁটিতে হামলা চালায়, তাহলে বিদ্রোহীদের কৌশলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।

বিদ্রোহীরা যখন দামেস্কের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তখন গোয়েন্দা সংস্থা রাজধানীর নিরাপত্তার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে।

বিদ্রোহীদের গোপন নেটওয়ার্ক

গোয়েন্দা সংস্থার একটি শাখা জানায়, উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে বহু মানুষ দামেস্কের এক উপশহরে বসতি গড়েছে। তাদের সন্দেহ ছিল, এরা বিদ্রোহী বাহিনীর গুপ্তচর বা ‘স্লিপার সেল’ তৈরি করতে পারে।

একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হায়াত তাহরির আশ-শাম দামেস্ক অঞ্চলে তাদের এজেন্টদের সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

৫ ডিসেম্বর ২০২৪ সালের এক গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত বিদ্রোহীদের একজন তথ্যদাতা সিরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাকে জানায়, তাদের পূর্ব দারা এবং ঐতিহাসিক পালমিরা (তদমর) শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকটে বিদেশি শক্তির কিছুটা ভূমিকা ছিল।

সেনাবাহিনীর মনোবল তখন এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে, দামেস্কের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর বিদ্রোহীদের কাছ থেকে আরও বেশি গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস হতে থাকে।

একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০ জন বিদ্রোহী যোদ্ধা এবং দুটি ট্যাংক দামেস্কের উপকণ্ঠে একটি মুরগির খামারে অবস্থান নিয়েছে।’

অন্য এক নথিতে বলা হয়, বিদ্রোহীরা ইদলিব অঞ্চলের এক গুহাকে তাদের অপারেশন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছিল।

সরকার পতনের একদিন আগে: চূড়ান্ত পূর্বাভাস

আসাদের পতনের ঠিক একদিন আগে, সিরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বাভাস দেয়। নথিতে উল্লেখ করা হয়

দুই দিনের মধ্যে বিদ্রোহীরা দামেস্কে প্রবেশ করবে এবং সিদানায়া কারাগার দখল করবে।’

যদিও সময়ের হিসাবে এই পূর্বাভাস পুরোপুরি সঠিক ছিল না, বাস্তবে তা ঘটেই গিয়েছিল। বিদ্রোহীরা কারাগারে প্রবেশ করে এবং বহু বন্দিকে মুক্ত করে।

এর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই প্রেসিডেন্ট আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

প্রতিবেদনের শেষ অংশে বলা হয়েছে, আসাদের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার প্রতি আনুগত ছিলেন এবং সরকারের পতন ঠেকানোর জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন।

তাদের লেখা শেষ নথিতে ছিল মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত বার্তা—

‘পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।’

এই লাইনটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, চূড়ান্ত ধ্বংসের মুহূর্তেও গোয়েন্দা বাহিনী কিছু একটা করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এই প্রতিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল। এতে উঠে এসেছে, কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে লৌহকঠিন শাসন বজায় রাখা এক স্বৈরশাসক মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গেল।

সিরীয় সেনাবাহিনীর ভেতরের বিশৃঙ্খলা, গোয়েন্দা সংস্থার চরম হতাশা ও বিভ্রান্তি এবং বিদ্রোহীদের সুসংগঠিত অগ্রযাত্রা—এই বিশ্লেষণ আগামী দিনে ইতিহাসবিদদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে থাকবে।

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা