মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

‘কারনাদা কারাগার’, লিবিয়ান সিদনায়া

'কারনাদা কারাগার', লিবিয়ান সিদনায়া
'কারনাদা কারাগার', লিবিয়ান সিদনায়া। ছবি: সংগৃহীত

কারনাদা লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের একটি গ্রাম, যা বেনগাজি থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এটি দেশের একটি কুখ্যাত কারাগারের জন্য পরিচিত, যা মূলত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা পরিচালিত হয়।

যুদ্ধাপরাধী খলিফা হাফতার এবং তার ছেলেদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকা এই কারাগারে, হাফতারের সামরিক ও রাজনৈতিক শত শত বিরোধীদের কোন ধরনের বিচার ছাড়াই দিনের পর দিন শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

কারনাদা কারাগারে সময় যেন থমকে থাকে। একটি দিন মাসের মতো, আর একটি মাস যেন বছরের মতো। এটি যেন পৃথিবীর নরক, এমনটাই বলেছেন ফিরে আসা বন্দিরা।

সম্প্রতি বেনগাজির কুখ্যাত কারনাদা কারাগারের কিছু ভিডিওচিত্র ফাঁস হয়, যা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।

ভিডিওগুলোতে বন্দিদের উপর নির্মম নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের দৃশ্য উঠে এসেছে, যার কারণে রাশিয়া টুডের প্রতিবেদনে এই কারাগারটিকে সিরিয়ার কুখ্যাত সিদনায়া কারাগারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা ভিডিও ক্লিপগুলো ব্যাপকভাবে শেয়ার করছেন, যেখানে দেখা গেছে বন্দিদের লাঠি ও চাবুক দিয়ে নির্মমভাবে আঘাত করা হচ্ছে এবং বিভৎসভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে। ক্লিপগুলোতে বন্দিদের রক্তক্ষরণ ও হাড় ভাঙার মতো গুরুতর আঘাতের দৃশ্য উঠে এসেছে। সাবেক বন্দিরা জানিয়েছেন, সেখানে বিদ্যুতের শক দেওয়া হতো, পাশাপাশি ঘুম ও পর্যাপ্ত খাবার থেকে দিনের পর দিন বঞ্চিত রাখা হতো।

লিবিয়া ক্রাইমস ওয়াচ (LCW) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়া কিছু ভিডিও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে, যেখানে কারনাদা কারাগার কমপ্লেক্সের সামরিক কারাগারে বন্দিদের নির্যাতনের দৃশ্য দেখা গেছে। লিবিয়ান আরব আর্মড ফোর্সেস (LAAF)-এর তত্ত্বাবধানে এই ঘটনা ঘটে। নির্যাতনের ঘটনাস্থল শনাক্ত করা হয়েছে কারাগারের গ্রাউন্ড ফ্লোরে, যা সাধারণত “কারাগারের প্রশাসনিক শাখা” নামে পরিচিত।

ভিডিওতে দেখা তিনজন ভুক্তভোগীর পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের একজন লিবিয়ান, একজন মিশরীয় এবং একজন সিরীয়। একইসঙ্গে নির্যাতনে জড়িত চারজনের পরিচয়ও জানা গেছে, যারা সামরিক পুলিশ ও কারাগারের প্রশাসনের সাথে যুক্ত।

কারনাদা কারাগারের একজন সাবেক বন্দি LCW-কে জানান: ‘ভিডিওতে যা দেখানো হয়েছে তা ছিল দৈনিক শাস্তি; প্রকৃত নির্যাতন ছিল এর চেয়েও ভয়াবহ।’

এর আগে কয়েকমাস পূর্বে লিবিয়া অবজারভার-এর এক প্রতিবেদনে একজন মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দির সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি তার উপর চালানো নির্মম অত্যাচার এবং কিভাবে তাকে বছরের পর বছর কোন ধরনের বিচার ছাড়া কারাগারে রাখা হয়েছিল তা বর্ণনা করেছেন। তদন্তকারীরা তার বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য’ হওয়ার অভিযোগ আনে, যা সাধারণত হাফতার নিজের বিরোধীদের দমন করতে ব্যবহার করে। যদিও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবুও তদন্তকারীরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জারি রেখেছিল এবং তাকে আইনজীবী রাখার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করে।

ঐ বন্দি নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে লিবিয়া অবজারভার-এর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছিলেন। তাই তাদের প্রতিবেদনে তাকে “মুহাম্মাদ” ছদ্মনামে উল্লেখ করা হয়েছিল।

কারানাদা কারাগারে নির্যাতনের ভয়াবহতার মাত্রা বুঝাতে মুহাম্মাদের সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হলো:

কারনাদা কারাগারে নতুন আগত বন্দিদের‌ একটি বিশেষ “অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান”এর মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়।

মুহাম্মাদ বলেন, “যখন আমি পৌঁছালাম, তারা আমাকে দুটি লাইনে দাঁড়ানো প্রহরীদের মধ্য দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করল, যারা আমাকে ক্রমাগত লাঠি, চাবুক এবং পিপিআর পাইপ দিয়ে প্রহার করতে থাকে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলল এই নির্যাতন। এরপর তারা আমাকে দেয়ালের পাশে দাঁড়াতে বলল এবং আমার কাপড় খুলে আমাকে তল্লাশি করতে শুরু করল। তারপর আমাকে একটি ছোট সেলে নিয়ে যাওয়া হয়, যার আয়তন ছিল মাত্র ২ মিটার। সেখানে আমি আরও তিনজন বন্দিকে দেখলাম, যাদেরকে প্রায় এক বছর ধরে কোনো অভিযোগ বা তদন্ত ছাড়াই বন্দি রাখা হয়েছে।

সেখানে থাকা তিনজন বন্দির মধ্যে একজন আমাকে সতর্ক করে বলে, ‘তারা শুধু আমাদের নির্যাতন করতে এখানে আসে।’

পরদিন সকালে, বশির নামে এক আফ্রিকান কর্মী সেলে আসে। মুহাম্মাদ জানান, কারাগারের বন্দিদের নির্যাতন ও নজরদারির কাজে আফ্রিকান কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হতো। বশির, যে কিনা ভাঙা আরবি ভাষায় কথা বলতো, আমাদের কক্ষে এসে আমাদের বাথরুমে নিয়ে গেল। কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি বন্দির দিনে একবার বাথরুম ব্যবহারের অনুমতি আছে এবং শুধুমাত্র ১০ সেকেন্ডের জন্য একাকী থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর বশির দরজা খুলে বন্দিদের জোর করে টেনে বের করে নিয়ে আসে, তারা যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন।

মুহাম্মাদ বলেন, কারাগারে মুখ ধোয়ারও অনুমতি নেই। যদি ১০ সেকেন্ড পর প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে হয়, তবে ন্যাপকিন ব্যবহার করে পরিষ্কার করতে হয়! সকালের নাশতায় এক টুকরো রুটি এবং পনিরের ছোট একটি টুকরো দেয়া হতো।

মুহাম্মাদ বলেন, দুপুরের পর বন্দিদের আর্তনাদ শুনতে পেলাম। তারপর একজন প্রহরী এসে আমাদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল, ‘নতুন বন্দি কোথায়?’ আমাকে পালাক্রমে বার বার পেটানো হয়েছিল। কারণ, নতুন বন্দিদের পেটানো তাদের নিয়ম ছিল। আমাকে পেটানোর সময়, প্রহরীরা গর্বিতভাবে বলত, ‘আমরা তোমাকে তোমার অধিকার দিতে চাই। আমরা চাই তুমি আমাদের সঙ্গে অভ্যস্ত হও।’

এক সপ্তাহ পর মুহাম্মাদ এর পরিবার জানতে পারে যে তিনি কারনাদা কারাগারে আছেন, এবং বেশ কয়েকজন মধ্যস্থতাকারীর প্রচেষ্টার ফলে, একজন প্রহরী এসে তাকে তার কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যায় এবং তাকে একটি ৫ মিটার আয়তনের কক্ষে রাখা হয়। সেখানে ৩০ জন বন্দি ছিল, যাদের বেশিরভাগই দারনা এবং বেনগাজি থেকে এসেছিল। কক্ষটির পরিবেশ ছিল অস্বাস্থ্যকর। সেখানে একটি বাথরুম ছিল, যার কোন ছাদ ছিল না এবং সেখানে পানি সরবরাহ ছিল অনিয়মিত।

কক্ষে বন্দিদের সকাল ৮টায় ঘুম থেকে উঠতে হতো এবং দুপুর পর্যন্ত তাদেরকে সামরিক ভঙ্গিতে বসে থাকতে বাধ্য করা হতো। এরপর দুপুরের খাবারের পর, আবার তাদের একই ভঙ্গিতে বসিয়ে রাখা হতো সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত।

প্রহরীরা বন্দিদের এরূপ অবস্থা দেখে মজা পেত; তাদের কোন কাজ ছিল না, শুধু বন্দিদের প্রতি মনোযোগ সহকারে নজর রাখত, যাতে কেউ তার বসার অবস্থান পরিবর্তন না করে বা অন্য বন্দিদের সাথে কথা না বলে। কেউ বসার অবস্থান পরিবর্তন করলে কিংবা অন্য বন্দিদের সাথে কথা বললে, তাকে প্রহার করা হতো। এটি ছিল প্রতিদিনের কঠোর নিয়ম।

২০১৮ সালে যুদ্ধাপরাধী হাফতারের সশস্ত্র বাহিনী মিশরের সহায়তায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের অজুহাতে দারনা আক্রমণ করে। কয়েক সপ্তাহ যাবৎ সংঘর্ষ চলতে থাকে। পাশের শহরের উপজাতি নেতারা আশ্বাস দিয়েছিল, যারা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করবে তাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না। এই প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করে শত শত স্থানীয় বাসিন্দা হাফতারের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ছিল মিথ্যা এবং দারনার মানুষদের হাফতারের বাহিনী কারনাদা কারাগারে নিয়ে যায়, তাদের ভয়ঙ্কর পরিণতির মুখোমুখি করার জন্য।

মুহাম্মাদ বলেন, দারনায় আক্রমণ চলাকালে কারাগারের প্রহরীরা বন্দিদের প্রহার করার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিত। প্রতিদিন কারাগারে দারনা থেকে নতুন বন্দিদের আনা হতো; তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন ছিল, যারা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছিল।

মুহাম্মাদ আরও বলেন, যারা আত্মসমর্পণ করেছিল তাদের মতে, হাফতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তাদের ভালোভাবে রাখা হবে এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে সে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

কারাগার যখন বন্দিদের ভিড়ে উপচে পড়ছিল তখন নতুন কক্ষ এবং ঘর নির্মাণ করা হয়। এসব নির্মাণকাজে বন্দিদের কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হয়।

নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর কিছু বন্দিকে নতুন তৈরিকৃত কক্ষগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়, প্রতিটি কক্ষে ৭৩ জন বন্দিকে রাখা হয়। প্রহরীরা যখন কক্ষগুলো টহল দিত, তখন পুরো জায়গায় এক ভয়ঙ্কর নীরবতা বিরাজ করত। কোনো আওয়াজ বা ফিসফাস শোনা গেলেই শুরু হতো নির্যাতন।

মুহাম্মাদ জানান, প্রতিটি প্রহরী দলের আলাদা আলাদা নির্যাতন পদ্ধতি ছিল। এর একটি পদ্ধতি হলো বন্দির কাপড় খুলে তাকে প্লাস্টিকের পিপিআর পাইপ এবং তামার তার দিয়ে প্রহার করা, যার ফলে শরীরে গুরুতর আঘাত সৃষ্টি হতো।

আরেকটি পদ্ধতি ছিল বন্দিকে উল্টো করে শুইয়ে তার মাথার ওপর সামরিক জুতা দিয়ে চাপ দেওয়া, যতক্ষণ পর্যন্ত না রক্তক্ষরণ শুরু হয়।

বন্দিদের অপমানিত করার জন্য, এক কারাগার কমান্ডার একটি ভয়াবহ এবং লজ্জাজনক কৌশল আবিষ্কার করে। সে কয়েকজন বন্দিকে একত্র করে তাদের কুকুরের নামে ডাকতে শুরু করে। সে আদেশ দেয়, যখনই তাদের ‘কুকুরের নাম’ ধরে ডাকা হবে, তখন প্রতিটি বন্দিকে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করতে হবে।

‘লিজা’ এবং ‘ম্যাক্স’ ছিল বন্দিদেরকে দেওয়া এমন কিছু কুকুরের নাম। একবার সে ‘লিজা’ এবং ‘ম্যাক্স’ নাম ধরে দুজন বন্দিকে ডেকে তাদের আদেশ দেয় কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করতে এবং একে অপরের সঙ্গে লড়াই করতে। অন্য বন্দিদের বাধ্য করা হতো মেঝেতে তার ফেলা থুথু চাটতে।

আরেক বন্দিকে জ্বলন্ত একটি চামচ ধরে থাকতে বাধ্য করা হয়, যতক্ষণ না সেটি তার হাতে আটকে যায় এবং সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে থাকে।

মুহাম্মাদ জানান, কারাগারের কিছু প্রহরী ছিল আফ্রিকান অভিবাসী, যাদেরকে বন্দিদের নির্যাতনের জন্য নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাদের একজনকে “দ্য গ্রিম রিপার” নামে ডাকা হতো, যে প্রায়ই কক্ষগুলোতে ঢুকে শিকার খুঁজত।

মুহাম্মাদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ডিসেম্বরে এক শীতের রাতে একজন প্রহরী কক্ষে এসে বন্দিদের বাইরে যেতে আদেশ দিল। আমাদের সমস্ত পোশাক খুলে ফেলা হলো এবং বৃষ্টির নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে বাধ্য করা হলো।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে কারনাদা কারাগারে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। ‘ভিকটিমস অর্গানাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটস’-এর তথ্য অনুযায়ী, কিছু বন্দিকে ধর্ষণ করা হয়েছে, আর অন্যদের দেহ কারাগারের বাইরে একটি এলাকায় পাওয়া গেছে, যেখানে নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট ছিল।

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা