সুদানে যুদ্ধ ও সংঘাত নতুন কিছু নয়। গোলাগুলির শব্দ, মর্টার বিস্ফোরণ কিংবা নির্বিচার গুলির ঘটনা দেশটির সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত চিত্র। তবে এবার পরিস্থিতির ভিন্নতা হলো, এই সংঘাত এবার রাজধানী খার্তুমে এসে পৌঁছেছে। ফলে সরকার ও সামরিক নেতৃত্বকে বিকল্প রাজধানী হিসেবে পোর্ট সুদানকে বেছে নিতে হয়েছে। যা লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত এবং আগের রাজধানী খার্তুম থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে।
সুদানের আগের যেসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সেগুলো মূলত রাষ্ট্রবিরোধী বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে প্রকৃতপক্ষে, এই সংঘাতের মূলে ছিল ‘কেন্দ্র’ ও ‘প্রান্তিক অঞ্চল’-এর মধ্যে বৈষম্য। কেন্দ্র সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত, আর প্রান্তিক অঞ্চল পড়ে থাকতো বিবিধ বঞ্চনায়। এসব বিদ্রোহকে অনেকেই অধিকারের জন্য লড়াই হিসেবে দেখেছেন।
তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের নেতৃত্বে ইসলামপন্থী শাসনামলে এসব যুদ্ধ দাবির সংঘাত থেকে রূপান্তরিত হয়েছিল ধর্মীয় যুদ্ধে। তখন উত্তরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে দক্ষিণের খ্রিস্টান কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ জনগণের সংঘাত তীব্র হয়। এর পরিণতিতে দক্ষিণ সুদান আলাদা হয়ে যায় এবং নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সুদানকে বারবার ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা এই যুদ্ধ ও সংঘাতের উৎস কোথায়?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সুদানের এসব সংঘাতের মূলে রয়েছে একটি ‘জাতীয় ঐক্যের প্রকল্প’-এর অভাব। দেশটির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে সৃষ্টি হয়েছে অসমতা ও বৈষম্যের সংস্কৃতি।
বর্তমান সংঘাতটি দুইটি নিয়মিত বাহিনীর মধ্যে হলেও এর শিকড় রয়েছে অতীতের সেই বৈষম্য ও বৈচিত্র্যের প্রতি অস্বীকৃতির মধ্যে। ১৯৫৫ সালে স্বাধীনতার আগেই ‘আনানিয়া ১’ নামে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, যা দেশটির প্রথম সংঘাতের সূচনা করে। আনানিয়া ১ নামটি স্থানীয় ভাষায় একটি বিষধর সাপের নাম থেকে নেওয়া।
সুদানে চলমান এই সংঘাত শুধু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার বহিঃপ্রকাশ, যা সমাধান করতে না পারলে দেশটির সংকট আরও গভীর হতে পারে।
‘নাইফাশা চুক্তি’: শান্তির পথে বিচ্ছেদ
সুদানের প্রথম যুদ্ধ ১৯৭২ সালে আদ্দিস আবাবা চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। তবে এক দশক পর ১৯৮৩ সালে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাফর নিমেইরির ইসলামি আইন প্রয়োগের ঘোষণার পর দক্ষিণ সুদানের নেতা জন গারাং ডি মাবিওরের নেতৃত্বে ‘সুদানের মুক্তি আন্দোলন’ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শুরুর দিকে এই যুদ্ধ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে বিবেচিত হলেও পরে তা রূপ নেয় ধর্মীয় যুদ্ধে। মুসলিম শাসকগোষ্ঠী ধর্মীয় আবেগ উসকে দিয়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেয়। এই দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়।
তবে সেনাবাহিনী ও তাদের মুজাহিদ বাহিনী কোনো নির্ণায়ক বিজয় অর্জন করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০০৫ সালে কেনিয়ার নাইফাশায় একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়—যা ‘নাইফাশা চুক্তি’ নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ সুদানকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পাঁচ বছরের একটি অন্তর্বর্তীকালীন সময় নির্ধারণ করা হয়, যাতে দক্ষিণ সুদান একটি একীভূত সুদানের অংশ হয়ে থাকবে নাকি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিচ্ছিন্ন হবে তা ঠিক করা হয়।
এই সময়ে জন গারাং ডি মাবিওর সুদানের প্রথম সহ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই একটি রহস্যজনক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন। তার মৃত্যুর পর সালভা কির মিয়ারডিট দক্ষিণ সুদানের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
২০১০ সালে দক্ষিণ সুদানের জনগণ স্বাধীনতার জন্য গণভোটে অংশগ্রহণ করে। এর ফলে স্বাধীনতার পক্ষে সিদ্ধান্ত আসে এবং জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র—দক্ষিণ সুদান। এই বিভাজনের কারণে সুদান তার ভৌগোলিক এলাকার এক-তৃতীয়াংশ, জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ এবং ৭৫ শতাংশ প্রাকৃতিক সম্পদ হারায়।
এদিকে, দক্ষিণ সুদানের বিভাজনের পর পশ্চিম সুদানের দারফুর অঞ্চলে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়। ২০০৩ সালে ‘সুদান মুক্তি আন্দোলন’ নামে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী দারফুর অঞ্চলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামে। তারা সরকারকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের অভিযোগে অভিযুক্ত করে।
এই সংঘাত পরিণত হয় জাতিগত সহিংসতায়। বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে সরকার আরব বংশোদ্ভূত ‘জনজাওয়িদ’ নামে পরিচিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিযুক্ত করে। এই গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা ছিলেন মোহাম্মদ হামদান দাগালো—যিনি পরবর্তীতে ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’-এর নেতৃত্বে আসেন।
দারফুর সংঘাতে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। সরকার বিশেষত প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির জাতিগত নির্মূল, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ওমর আল-বশির এবং তার তিন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে, যা এখনো বহাল রয়েছে।
বিভিন্ন রাজধানীতে শান্তি চুক্তির প্রচেষ্টা
২০০৬ সালের মে মাসে সুদানের ইসলামি সরকার দারফুর অঞ্চলের ‘সুদান মুক্তি আন্দোলন’-এর সঙ্গে নাইজেরিয়ার আবুজায় একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে এই চুক্তির পর আন্দোলনটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অংশটির নেতৃত্ব দেন বর্তমানে দারফুর অঞ্চলের গভর্নর মিনি আর্কো মানাউই।
অন্যদিকে আবদুল ওয়াহেদ মোহাম্মদ নূরের নেতৃত্বাধীন অংশটি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে এবং দারফুরের কেন্দ্রস্থল জাবাল মারে এলাকায় অবস্থান নেয়। তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে, যা এখনো অব্যাহত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মানাউই প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের সহকারী নিযুক্ত হন। তবে তিনি অভিযোগ করেন, তাকে প্রকৃতপক্ষে একটি সামান্য ভূমিকা দেওয়া হয়েছে, যা তাকে আবার বিদ্রোহে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
শান্তি আলোচনা বিভিন্ন রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালের জুলাইয়ে কাতারে ‘দোহার শান্তি দলিল’ স্বাক্ষরিত হয়—যেখানে ক্ষমতা ও সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থামেনি। পরবর্তীতে ২০২০ সালের অক্টোবরে দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবায় শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে মিনি আর্কো মানাউইয়ের ‘সুদান মুক্তি আন্দোলন’ এবং জিবরিল ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন ‘ন্যায়বিচার ও সমতা আন্দোলন’-সহ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী অংশগ্রহণ করে। এই চুক্তির মাধ্যমে সম্পদ ও ক্ষমতা ভাগাভাগি নির্ধারণ করা হয়। এর ফলে জিবরিল ইব্রাহিম অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান এবং মানাউই দারফুর অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত হন।
নতুন সংকট, যুদ্ধ
দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার পর দক্ষিণ কর্ডোফান এবং নীল নদের দক্ষিণাঞ্চলে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়। এই অঞ্চলগুলোকে ‘নাইফাশা চুক্তি’ অনুযায়ী জনগণের পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। তবে ‘সুদান মুক্তি আন্দোলন-উত্তর’ নামে নতুন একটি গোষ্ঠী বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে।
এই আন্দোলন দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এর একাংশ বর্তমান সার্বভৌম পরিষদের উপ-সভাপতি মালিক আকারের নেতৃত্বে জুবা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। অন্য অংশটি আবদুল আজিজ আল-হেলুর নেতৃত্বে কাওদা এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং এটিকে ‘মুক্ত এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই গোষ্ঠী এখনো বিচ্ছিন্নভাবে সুদানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে।
পূর্বাঞ্চলের সংঘাত
পূর্ব সুদানও যুদ্ধের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। ১৯৯০-এর দশকে এটি ছিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের কেন্দ্র। এখানে ‘বেজা কনফারেন্স’ এবং ‘ফ্রি লাইন্স’ নামে দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী খার্তুমের কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। ২০০৬ সালে ইরিত্রিয়ার রাজধানী আসমারায় ‘পূর্ব সুদানের শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এতে এই গোষ্ঠীগুলোও ক্ষমতা ও সম্পদের ভাগ পায়।
ইসলামি শাসনের পতন, সামরিক উত্তেজনা
২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল। মাসব্যাপী গণআন্দোলনের মুখে ওমর আল-বশিরের নেতৃত্বাধীন ইসলামি শাসনের পতন ঘটে। জনগণের বিক্ষোভের চাপে সামরিক নেতৃত্ব বশিরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।
তবে বিক্ষোভ ও ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। সামরিক পরিষদ—যার নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’র নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালো— বিক্ষোভ দমনে জোরপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এতে শতাধিক বিক্ষোভকারী নিহত হয়।
পরবর্তীতে নাগরিকদের চাপের মুখে ২০১৯ সালের আগস্টে একটি ‘সংবিধানিক দলিল’ স্বাক্ষরিত হয়। এর ভিত্তিতে সামরিক ও বেসামরিক অংশীদারিত্বে একটি শাসন ব্যবস্থা নির্ধারণ করা হয়। এর মাধ্যমে আবদুল্লাহ হামদক প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং বুরহান ও হেমেতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সার্বভৌম পরিষদ গঠিত হয়।
সুদানের চলমান সংঘাত
২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর সুদানের সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লাহ হামদকের নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করেন। তবে অভ্যুত্থানের পর শান্তিপূর্ণ জনমতের চাপে তিনি বেসামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এই চুক্তি অনুযায়ী সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার পাশাপাশি ইসলামপন্থী শাসন প্রতিষ্ঠার যেকোনো পরিকল্পনা বন্ধ করতে বলা হয়।
কিন্তু আগের সরকারের সমর্থকরা চুক্তির কার্যকারিতা ব্যাহত করতে সফল হয়। তারা সেনাবাহিনী এবং ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’ নামে একটি আধাসামরিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ উসকে দেয়। এর ফলে দেশজুড়ে নতুন সংঘাতের সূত্রপাত হয়।
২০২৩ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি এক শনিবার সকালে রাজধানী খার্তুমের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকায় বন্দুকযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নতুন সংঘাত শুরু হয়। ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’ সেনাবাহিনীর ওপর হঠাৎ হামলার অভিযোগ তোলে। তাদের দাবি, সেনাবাহিনী মেরোই বিমানবন্দর ঘিরে ফেলে ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে আরেকটি তত্ত্ব অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে থাকা ইসলামি কোন গোষ্ঠী এই সংঘাত শুরু করে এবং ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বাহিনী’কে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে বাধ্য করে।
যুদ্ধটি অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর শক্তিশালী অস্ত্রাগার এবং রসদের তুলনায় ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’ ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল। তবে বাস্তবতা ভিন্ন হয়ে দাঁড়ায়। বাহিনীটি শহুরে যুদ্ধ-কৌশলে পারদর্শী হওয়ায় তারা সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট দখল করে এবং রাজধানী খার্তুমের প্রধান সরকারি ভবনগুলো; এমনকি রাষ্ট্রপতি ভবন এবং মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয়।
সরকার বাধ্য হয়ে পোর্ট সুদান শহরে রাজধানী স্থানান্তর করে। তিন মাস ধরে খার্তুমে অবরুদ্ধ থাকার পর সেনাপ্রধান বুরহান অবশেষে পোর্ট সুদানে পৌঁছান এবং এটিকে কার্যকর রাজধানী ঘোষণা করেন।
‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’ দারফুরসহ দেশের পশ্চিমাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। উত্তর দারফুরের রাজধানী এল ফাশার এবং পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি শহর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে মধ্যাঞ্চলীয় জাজিরা রাজ্য এবং আরও কয়েকটি এলাকা বাহিনীটির দখলে চলে যায়।
দুই বছরের লড়াইয়ের পর সেনাবাহিনী কিছু অঞ্চলে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। খার্তুম, উম্মে দরমান এবং খার্তুম বাহরি এলাকায় সেনাবাহিনী অগ্রগতি অর্জন করে। তবে ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’ এখনো দেশের বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত এখনো চলমান, যা দেশটির স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে।
মানবিক বিপর্যয়
সুদানে চলমান যুদ্ধের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। জাতিসংঘের মতে, এটি ইতিহাসের অন্যতম ‘সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়’। যুদ্ধে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। এ ছাড়া প্রায় ৩০ লাখ মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যা ৪ কোটি ৫০ লাখ হলেও এর মধ্যে ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষই এখন চরম খাদ্য সংকটের মুখে পড়েছে।
অন্যদিকে, যুদ্ধরত পক্ষগুলো আলোচনায় ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। এর আগে ‘জেদ্দা মানবিক ঘোষণা’ চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে ফের আলোচনার চেষ্টা করা হলেও তাতে কোনো সাফল্য আসেনি। সেনাবাহিনী এবং তাদের সমর্থকদের অনমনীয় মনোভাব এর প্রধান কারণ।
সংকটের মূলে
সুদানের সংকটের মূল কারণ খুঁজতে সাবেক সার্বভৌম কাউন্সিল সদস্য ও গণতান্ত্রিক জোট ‘তাকাদ্দুম’-এর উপ-সভাপতি আল-হাদি ইদ্রিস মনে করেন, স্বাধীনতার পর থেকেই সুদানে একটি কার্যকর জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। তার মতে, সুষম উন্নয়ন না হওয়া, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা, শাস্তি থেকে অব্যাহতির সংস্কৃতি এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক, জাতীয় পরিচয় ও একক সেনাবাহিনী গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সমাধান করতে না পারাই সংকটের মূল কারণ।
ইদ্রিস বলেন, ‘এই সংকট সমাধানে আমাদের শিকড়ে ফিরে যেতে হবে এবং সেখান থেকে সমস্যার সমাধান করতে হবে। যেকোনো ভবিষ্যৎ চুক্তিতে যুদ্ধের কারণ ও শিকড়গুলো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’
অন্যদিকে, ‘ফেডারেল জোট’-এর নেতা মোহাম্মদ আবদুল হাকিম মনে করেন, সুষম উন্নয়ন ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অভাব সুদানের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রধান কারণ। তার মতে, ‘তুলনামূলকভাবে উন্নয়নের অভাব, জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থতা এবং একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করতে না পারাই সুদানের সংঘাতের মূল শিকড়।’
সমাধানের পথ
সুদানের দীর্ঘস্থায়ী সংকট নিরসনে একটি পেশাদার, জাতীয় এবং ঐক্যবদ্ধ সেনাবাহিনী গঠন করা অপরিহার্য। মোহাম্মদ আবদুল হাকিম বলেন, সেনাবাহিনীর জন্য একটি নির্দিষ্ট আদর্শিক ভিত্তি থাকা উচিত, যা সংবিধান ও বেসামরিক শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা করবে। এই সেনাবাহিনী আইনপ্রণেতা ও নির্বাহী কর্তৃপক্ষের অধীনে কাজ করবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকবে। এ ছাড়া জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারও জরুরি বলে তিনি মত দেন।
আশ শারকুল আওসাতের একটি আর্টিকেল অবলম্বনে লেখা