ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গতকাল রোববার গাজা উপত্যকায় ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। উপত্যকার বিভিন্ন এলাকায় চালানো হয়েছে তথাকথিত ‘ফায়ার বেল্ট’। যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার ৯ দিন পর এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় লঙ্ঘন। দৃশ্যটা গাজাবাসীর মনে করিয়ে দিয়েছে গণহত্যার শুরুর দিনগুলোর কথা।
ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানিয়েছে, সেনাবাহিনী গাজার সব প্রবেশপথ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে পরে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
চিকিৎসা সূত্রের তথ্যে জানা গেছে, শরণার্থীদের তাঁবু, বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় নেওয়া একটি স্কুল এবং সাংবাদিকদের ব্যবহৃত একটি ভবনে হামলা চালায় দখলদার বাহিনী। এসব হামলায় অন্তত ৪০ জন নিহত ও বহু মানুষ আহত হয়েছেন।
গ্রিনিচ মান সময় সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ঘোষণা দেয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশে তারা আবারও যুদ্ধবিরতি কার্যকর করছে।

এই সহিংসতা শুরু হয় সকালে, যখন ইসরায়েল দাবি করে, রাফাহ সীমান্তে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা তাদের সেনা ও প্রকৌশলযান লক্ষ্য করে গুলি ও অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক রকেট নিক্ষেপ করেছে। তবে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠনগুলো এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, যুদ্ধবিরতি ভাঙার জন্য ইসরায়েল অজুহাত তৈরি করছে।
উত্তেজনা কতটা বেড়েছে?
ইসরায়েলের বিমান ও গোলাবর্ষণে গাজা উপত্যকার উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা কেঁপে উঠেছে। মধ্য গাজার জাওয়াইদা ও নুসাইরাত শরণার্থীশিবিরে, উত্তরাঞ্চলের কামাল আদওয়ান হাসপাতালের আশপাশে এবং দক্ষিণে খান ইউনুসের মাওয়াসি এলাকায় বহু ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু খান ইউনুসের পূর্বাঞ্চলেই ইসরায়েল অন্তত ২০টির বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে।
সন্ধ্যার দিকে ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানায়, দিনভর গাজা উপত্যকায় প্রায় ১২০টি হামলা চালিয়েছে বিমানবাহিনী। মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে ড্রোন ব্যবহার করে চালানো হয়েছে ‘নির্দিষ্ট টার্গেটে হত্যাকাণ্ড’।
একই সময়ে ইসরায়েলের চ্যানেল-12 জানায়, সেনাবাহিনীর সুপারিশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গাজায় ত্রাণসামগ্রী প্রবেশ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সব সীমান্তপথও বন্ধ করা হয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের চাপে ইসরায়েল সিদ্ধান্তটি থেকে সরে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সোমবার সকালে সীমান্তপথগুলো আবার খুলে দেওয়া হবে এবং ত্রাণ কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে।
হামাসের অবস্থান কী?
ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস দখলদার বাহিনীকে শারম আশ শাইখ চুক্তির যেকোনো অবনতি বা ভাঙনের জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেছে এবং মধ্যস্থতাকারী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই আগ্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে জরুরি হস্তক্ষেপ এবং চুক্তি বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে আহ্বান জানিয়েছে। যাতে ফিলিস্তিনি জনগণের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়।
হামাস একটি বিস্তারিত বিবৃতি প্রকাশ করে জানায়, চুক্তি কার্যকর হওয়ার প্রথম দিন থেকেই দখলদার বাহিনী একাধিকবার চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। ১০ অক্টোবর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন শহীদ হয়েছেন এবং আরও বহু মানুষ আহত হয়েছেন। শহীদ ও আহতদের অর্ধেকই শিশু, নারী ও বৃদ্ধ। শহীদদের মধ্যে রয়েছে আবু শাবান পরিবার, যারা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
হামাস জানিয়েছে, দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী এখনো অস্থায়ী প্রত্যাহার রেখা অর্থাৎ ‘হলুদ রেখা’ বরাবর দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তর গাজা উপত্যকার সীমান্তে প্রায় ৬০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মিটার পর্যন্ত এলাকায় আগ্রাসী উপস্থিতি বজায় রেখেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ এখনো তাদের বাসস্থানে ফিরে যেতে পারছেন না।
অন্যদিকে, হামাসের সামরিক শাখা ইয্যুদ্দিন আল কাসসাম ব্রিগেড এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা চুক্তির সব শর্ত পূরণে সম্পূর্ণভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। সংগঠনটি জানায়, সর্বাগ্রে যে বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে, তা হলো গাজা উপত্যকার সব এলাকায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা।
কাসসাম বলেছে, রাফাহ এলাকায় কোনো সংঘর্ষ সম্পর্কে আমাদের কোনো তথ্য নেই। এই অঞ্চলগুলো ‘লাল এলাকা’ হিসেবে দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, এবং মার্চ মাসে যুদ্ধ পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানে থাকা আমাদের যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমরা জানি না তারা শহীদ হয়েছেন কিনা, নাকি এখনো জীবিত আছেন। তাই ঐসব এলাকায় ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি কেউ জীবিত থাকেন, তাহলেও আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না।
প্রতিরোধ কিভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে?
ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক পাতায় প্রতিরোধ বাহিনীর নিরাপত্তা বিভাগ থেকে একটি নির্দেশনা ছড়িয়ে পড়েছে। এতে ‘মাঠ পর্যায়ের সকল ইউনিটকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে, চলাচল ও যোগাযোগে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে প্রযুক্তিগত ও মাঠ পর্যায়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার তাগিদ।’
বোমা হামলার তীব্রতা বাড়ার আগেই প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নিরাপত্তা বিভাগ সতর্ক করে দিয়েছে যে, ‘দখলদার বাহিনী আগামী কয়েক ঘণ্টা বা দিনের মধ্যেই হঠাৎ ও বিশ্বাসঘাতক হামলা চালাতে পারে। এর মূল উদ্দেশ্য হবে মাঠের ব্যর্থতার পর নিজেদের নিরাপত্তা ও মনোবল পুনরুদ্ধার করা।’
ইসরায়েলের দাবি
রাফায় রোববার সকালে যা ঘটেছে, তার পুরো চিত্র এখনো স্পষ্ট নয়। ফিলিস্তিনিরা যেটিকে বলছেন ‘রাফার প্রতারণা’, সেটি নিয়ে নানা তথ্য আসছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানায়, সেনাবাহিনীর প্রাথমিক বিবৃতি প্রকাশের পর দেশটির সামরিক সেন্সর ঘটনাটি নিয়ে সংবাদ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, রাফা এলাকায় ‘সামরিক অবকাঠামো ধ্বংসে’ কাজ করা সেনা প্রকৌশল যানের ওপর সশস্ত্র যোদ্ধারা গুলি ও অ্যান্টি-ট্যাংক রকেট নিক্ষেপ করে। জবাবে সেনারা পাল্টা গুলি চালায়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, হামলার পরপরই ইসরায়েলি বাহিনী বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ চালায়, যাতে ‘সশস্ত্রদের কার্যক্রম শনাক্ত হওয়া টানেলের মুখ ও ভবন ধ্বংস হয়’—এমনটাই ইসরায়েলের দাবি।
এদিকে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ঘটনাটি শুরু হয়েছিল রাফায় এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে, যা সেনাবাহিনীর প্রকৌশলযান ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই ঘটে।
প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলি স্যাটেলারদের ঘনিষ্ঠ কিছু ওয়েবসাইট ও সামাজিক মাধ্যম পেজে জানানো হয়, রাফার ঘটনায় কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা নিহত ও আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একজন কোম্পানি কমান্ডারও আছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন–ও এক সূত্রের বরাতে জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলের ভাষ্য অনুযায়ী, ঘটনাটি ঘটেছে ‘হলুদ রেখার’ পেছনে।
পরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, রাফার লড়াইয়ে তাদের এক কর্মকর্তা ও এক সেনা নিহত এবং আরেক সেনা আহত হয়েছেন। তাঁরা নাহাল ব্রিগেডের ৯৩২ নম্বর ব্যাটালিয়নের সদস্য ছিলেন।
কী ঘটছে?
ঘটনাটিকে ঘিরে রহস্য ক্রমেই বাড়ছে। ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রাফার এই ঘটনার সময় গাজা উপত্যকায় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী একটি বিশেষ অভিযান চালাচ্ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ইয়াসির আবু শাবাবের নেতৃত্বাধীন, ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতাকারী এক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আটক করা।
ইসরায়েলের চ্যানেল 12–এর খবরে দাবি করা হয়, রাফায় ইসরায়েলি বিমান হামলা চালানো হয়েছিল আবু শাবাবের নেতৃত্বাধীন সেই গোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছিল, গাজায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধগোষ্ঠীগুলো শিগগিরই কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীর ওপর ‘আসন্ন হামলা’ চালাতে পারে, কিংবা ‘যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন’ ঘটাতে পারে—এমন তথ্য তাদের হাতে এসেছে।
তবে হামাস এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, ‘এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ ইসরায়েলের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে দখলদার বাহিনীর ধারাবাহিক অপরাধ ও আগ্রাসনকেই আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
সূত্র: আল জাজিরা





