মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

ইসরায়েলের টিকটক দখল ও ন্যারেটিভ ওয়ারের নতুন দুনিয়া 

নেতানিয়াহু জানে, প্রভাব বিস্তারের যুদ্ধ এখন আর সিএনএন বা ফক্স নিউজের মতো বিখ্যাত টিভি চ্যানেলের নিউজরুমে অথবা জনপ্রিয় স্যাটেলাইট চ্যানেলে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা বিশ্বের ৩০০ কোটিরও বেশি মানুষের হাতে থাকা ছোট স্মার্টফোনে ছড়িয়ে পড়েছে।
thumbs_b_c_377036792fbb6310abfafba2f330c17f

গাযায় ইসরায়েলি যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আমেরিকান জনসংযোগ সংস্থাগুলোকে (Public Relations Firms) তার দপ্তরে ডেকে পাঠান। তাদের সঙ্গে কয়েক মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেন, যার উদ্দেশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ‘টিকটক’ ও ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার)-এ একটি ‘আক্রমণাত্মক কৌশল’ তৈরি করা এবং পশ্চিমা জনমতকে নিজেদের পক্ষে এনে ইসরায়েলের নৈতিক বৈধতা পুনরুদ্ধার করা।

এই প্রচারণার মূল লক্ষ্য হলো, দখলদার ইসরায়েলি শাসনের কলঙ্কিত ভাবমূর্তি ঘোচানো। যেই শাসনব্যবস্থা আজ নৃশংসতায় নাৎসিবাদকেও ছাড়িয়ে গেছে, নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতায় ফ্যাসিবাদকেও হার মানিয়েছে, আর গণহত্যা ও বর্ণবাদের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখিয়েছে বিশ্বকে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ তাদের সরকারের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে গত দুই বছর ধরে এই বর্বর গণহত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। নেতানিয়াহু গাজাকে এমন এক গণকবরে পরিণত করেছে, যা জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞকেও ছাড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের ইহুদি ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর চালানো ‘হলোকাস্ট’-ও এই নৃশংসতার সামনে ম্লান হয়ে গেছে।

নোংরা বয়ান: ইসরায়েলের প্রচারণার গল্প

ইসরায়েলি সংবাদপত্রগুলো জানিয়েছে, নেতানিয়াহু এই প্রচারণার জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করেছে। এর প্রধান লক্ষ্য টিকটকের প্রভাবশালী কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের দলে টানা, যাতে তারা ‘যুদ্ধের ন্যারেটিভ’ নতুন করে সাজাতে পারে এবং বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিপরীত একটি নোংরা গল্প ভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। বিশ্বজুড়ে মানুষ যখন সরাসরি গাজার নারকীয় দৃশ্য দেখছিল, তখন নেতানিয়াহু বুঝতে পারছিল যে, ইসরায়েলের পক্ষে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে বানানো ভিডিওগুলোর মিথস্ক্রিয়া (engagement), কোনো খরচ ছাড়াই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া গাজাপন্থী কন্টেন্টের ১০ শতাংশেরও কম সাড়া পাচ্ছে। মূলত, গাজার নিরীহ মানুষের ওপর চালানো গণহত্যার জীবন্ত দৃশ্যই বিশ্বজুড়ে মানুষকে নাড়া দিয়েছে।

ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম এবং শর্টসের মতোই টিকটক এখন নতুন প্রজন্মের কাছে সরাসরি ঘটনাপ্রবাহ দেখার প্রধান জানালা হয়ে উঠেছে। ফলে ইহুদিবাদীদের নিয়ন্ত্রিত ও ভিন্নমতকে দমনকারী গতানুগতিক পশ্চিমা মিডিয়ার একক আধিপত্য ভেঙে পড়েছে। ২০২৪ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে ৬৮%  আমেরিকান তরুণ জানিয়েছে, তারা গাজায় যা ঘটছে তাকে গণহত্যা বলে মনে করে। ১৯৭০ এর দশকে ভিয়েতনামের যুদ্ধের পর থেকে আমেরিকার তরুণদের কাছে কোনো বিদেশি ইস্যু এতটা গুরুত্ব পায়নি।

২০২৩ সাল থেকে ইউরোপীয় জনমতও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, বিশেষ করে গাযায় সংঘটিত গণহত্যার প্রামাণ্য দলিলগুলো সামনে আসার পর। বেশিরভাগ শহরে ইসরায়েলকে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিকভাবে বয়কট, নেতানিয়াহু ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ, তাদের পণ্য বর্জন এবং রাষ্ট্রদূতদের বহিষ্কারের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ড ইসরায়েলের সেই ‘অজেয় সেনাবাহিনী’র ভাবমূর্তিকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে, যা তারা কয়েক দশক ধরে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল। এখন তাদের পরিচয় হয়ে উঠেছে বিনা উসকানিতে সহিংসতা চালানো এবং পাশবিকভাবে নারী ও শিশু হত্যাকারী এক শক্তি হিশেবে।

ন্যারেটিভের যুদ্ধ

ইসরায়েল এখন এক আন্তর্জাতিক পরিচয়-সংকটের মুখোমুখি। বিশ্ববাসীর চোখে তারা আর ‘মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ নয়, বরং একটি দখলদার শক্তি, যারা এমন এক গণহত্যা পরিচালনা করছে, যা অডিও-ভিডিও দ্বারা নথিভুক্ত। ফলে ইসরায়েল একই সাথে তিনটি সমান্তরাল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে: গাজায় সামরিক যুদ্ধ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য যুদ্ধ এবং দেশের ভেতরে ও বাইরে রাজনৈতিক যুদ্ধ। 

এই পদক্ষেপের মাধ্যমে নেতানিয়াহু বুঝতে পেরেছে যে, যুদ্ধবিরতি হলেই তার লড়াই শেষ হবে না; বরং সামাজিক মাধ্যম এবং মানুষের মনস্তত্ত্বে এই লড়াই চলতেই থাকবে। তাই এর দ্বারা প্রভাবিত জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে উগ্র ইহুদিবাদী শাসনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মন ও চেতনাকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করেছে নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহু জানে, প্রভাব বিস্তারের যুদ্ধ এখন আর সিএনএন বা ফক্স নিউজের মতো বিখ্যাত টিভি চ্যানেলের নিউজরুমে অথবা জনপ্রিয় স্যাটেলাইট চ্যানেলে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা বিশ্বের ৩০০ কোটিরও বেশি মানুষের হাতে থাকা ছোট স্মার্টফোনে ছড়িয়ে পড়েছে।

টিকটক এখন আর শুধু বিনোদনের প্ল্যাটফর্ম নয়, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে পরিণত হয়েছে। এবার সেই লড়াইয়ে ইসরায়েলও যোগ দিয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে, গাজায় আগ্রাসনের ন্যারেটিভ যুদ্ধে জয়ী হতে হলে বন্দুকের চেয়ে প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক বেশি জরুরি। নেতানিয়াহু তার উপদেষ্টাদের স্পষ্টভাবে বলেছে: ‘আমরা পশ্চিমা তরুণদের চেতনার জগতে যুদ্ধে হেরে যাচ্ছি। তাই যে প্ল্যাটফর্ম প্রতিদিন আমাদের আক্রমণ করছে, তা আমাদের পুনরুদ্ধার করতে হবে।’

জায়োনিস্ট ত্রিমূর্তি

গত মাত্র পাঁচ বছরে টিকটক আমেরিকান তরুণদের কাছে সংবাদ পাওয়ার অন্যতম প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। মার্কিন গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের (Pew Research Center) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী আমেরিকানদের মধ্যে যারা টিকটক থেকে খবর পায়, তাদের হার ২০২০ সালের ৯% থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ৪৩% হয়েছে। অন্যদিকে, ৩০ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের এক চতুর্থাংশ নিয়মিত খবরের জন্য টিকটকের ওপর নির্ভর করে।

এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনের কারণে প্ল্যাটফর্মটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন ১৭০ মিলিয়ন আমেরিকান এবং আরব বিশ্বের ১৫০ মিলিয়ন মানুষ প্রবেশ করে, যাদের বেশিরভাগই ৩০ বছরের কম বয়সী। তারাই ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো গণহত্যার বয়ান হাজার হাজার ভিডিওর মাধ্যমে নথিভুক্ত করছে ও প্রচার করছে। বিমান, বোমা, ট্যাংক ও ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে চালানো নৃশংস হামলা এবং বারবার বাস্তুচ্যুত হওয়া গাজার মানুষের দৈনন্দিন দুর্ভোগের চিত্র তারাই তুলে ধরছে, যেখানে প্রায় ৬৭ হাজার মানুষ শহিদ হয়েছে।

তবে, নেতানিয়াহু আমেরিকান সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক করার পর থেকেই টিকটকে ইসরায়েলপন্থী অ্যাকাউন্টের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোও জায়োনিস্ট ন্যারেটিভের দিকে স্পষ্টভাবে ঝুঁকে পড়েছে। একইসাথে গাজা ও পশ্চিম তীরে দখলদার বাহিনীর অপরাধ নথিভুক্ত করা ভিডিওর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এই পরিবর্তন এমন এক সময়ে ঘটছে যখন দখলদার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক এবং বিশ্বের বৃহত্তম ডেটা প্ল্যাটফর্ম ‘ওরাকল’ (Oracle)-এর মালিক, ধনকুবের ল্যারি এলিসন টিকটকের চীনা মালিকানাধীন বাইটড্যান্স (ByteDance) কোম্পানির ৮০% শেয়ার কেনার প্রস্তাব দিয়েছে।

ল্যারি এলিসন ইসরায়েল ও ইহুদিবাদের প্রতি চরম অনুগত এবং ‘থার্ড টেম্পল’ নির্মাণ ও ’মাসিহ-দাজ্জাল’-এর আগমনকে ত্বরান্বিত করার জন্য জেরুজালেম দখল করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কট্টর সমর্থক। ল্যারি এলিসন সেই ব্যক্তি, যে তার সংস্থা ‘ওরাকল’-এর মাধ্যমে আমাদের এবং সমগ্র বিশ্বের ডেটা সংরক্ষণ করে এবং চাইলেই তা ইসরায়েলের হাতে তুলে দিতে পারে। এলিসন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-নির্ভর নজরদারিতে বিশেষজ্ঞ ইসরায়েলি সংস্থা ‘প্যালান্টিয়ার’ (Palantir)-এর সঙ্গেও গভীর অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছে, যার পরিচালক হলো জায়োনিস্ট অ্যালেক্স কার্প।

এই চক্রে যদি আমরা তৃতীয় অংশীদার হিশেবে পিটার থিয়েলকে যুক্ত করি, যে পিটার থিয়েল প্যালান্টিয়ারের সহ-মালিক এবং সম্প্রতি একটি দীর্ঘ ডকুমেন্টারি তৈরিতে অর্থায়ন করেছেন, যার মূল বার্তা হলো, ‘যদি আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে আমরা মাসিহ তথা দাজ্জালের আগমনকে ত্বরান্বিত করতে পারব।’

তখন আমরা বুঝতে পারব যে, আমরা কতটা ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি।

বাস্তবতা ও ডিজিটাল বিভাজন

এই বিপজ্জনক জোট শুধুমাত্র ইসরায়েলের পক্ষে নয়, বরং আমাদের মাইন্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, বৈশ্বিক চেতনাকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য এক বিশাল যুদ্ধ পরিচালনা করছে। প্ল্যাটফর্মগুলোর অ্যালগরিদম নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবহারকারীদের অজান্তেই তাদের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বয়ানের দিকে চালিত করা হবে। ব্যবহারকারীরা বুঝতেই পারবে না যে, কেউ তাদের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং টিকটকসহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে থাকা তাদের ডেটা নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং ইসরায়েলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে কাজে লাগানো হচ্ছে।

খুব শীঘ্রই টিকটকের মালিকানা চীন থেকে এই আমেরিকান চক্রের হাতে চলে যাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রথম বৈঠকের পর চীন তাদের নিজস্ব সংস্করণ ‘গ্লোবাল কোর’ চালু করে, যা সম্পূর্ণ চীনা অ্যালগরিদমের ওপর নির্ভরশীল, এবং আমেরিকান বাজারে চীনের প্রভাব বজায় রাখার কৌশল হিশেবে কাজ করছে। এটি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে একটি ডিজিটাল বিভাজনের সূচনা করবে, যেখানে চীন তার স্থানীয় অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেবে, আর ওয়াশিংটন ওরাকল, মেটা এবং গুগলের মতো কর্পোরেট শক্তিগুলোর জোটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করবে। এই সংস্থাগুলোর স্বার্থ জায়োনিস্ট এজেন্ডার সাথে জড়িত, এবং তারা ‘উসকানি’ বা ‘ভুয়া খবর’-এর অজুহাতে আরবি ও ফিলিস্তিনি কন্টেন্টকে কোণঠাসা করার জন্য কাজ করে।

টিকটক যখন ইসরায়েলপন্থী একটি প্রযুক্তি-জোটের হাতে চলে যাচ্ছে, তখন প্রশ্ন উঠছে, আগামী দিনের ন্যারেটিভ কে তৈরি করবে? ভবিষ্যত প্রজন্ম কী দেখবে, কী বিশ্বাস করবে? এবং এমন এক প্রজন্মের চাক্ষুষ স্মৃতি নিয়ন্ত্রণের অধিকার কার হাতে থাকবে, যারা বিশ্বকে কেবল পর্দার মাধ্যমেই দেখে? এমন এক পর্দা বা প্ল্যাটফর্মে, যেখানে আরবদের কোনো অংশীদারত্ব বা প্রভাব নেই।

আল জাজিরা থেকে নাহিন শিকদারের অনুবাদ