মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

বোমার নিচে আশার আলো

Sada-600x600a-1759751205


সব হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব। কেবল একটি আশাই এখনো টিকে আছে— হয়তো একদিন বোমাবর্ষণ থামবে।

আমার শেষ স্মৃতি ছিল বিয়ের আংটিটি। ক্ষুধায় কাতর মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিতে সেটিও বিক্রি করতে হয়েছে। এখন আমার আর কিচ্ছু করার নেই— কেবল দোয়া, অপেক্ষা আর আশা।

শুক্রবার গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয় প্রতিরোধ বাহিনী। এই খবরে কিছু মানুষ রাস্তায় নেমে উল্লাস প্রকাশ করে।

গাজায় যখনই যুদ্ধবিরতির কোনো প্রস্তাব আসে, মনে হয় দূরে কোথাও আশার আলো ঝিলিক দিচ্ছে। কিন্তু অনেকেরই এখন আর সেই আশাটুকুও নেই। কারণ আমরা এতবার আশায় বুক বেঁধেছি, অপেক্ষা করেছি, আবার নির্মম বাস্তবতায় ছিন্নভিন্ন হয়েছি যে, এখন ক্লান্ত। এ যেন তীরে এসে তরী ডোবার মতোই এক যন্ত্রণাদায়ক চক্র।

তবুও আমি আশায় আছি— হয়তো এবারটা ভিন্ন হবে, হয়তো তারা সত্যিই এই রক্তপাত বন্ধে উদ্যোগী হবে।

আমার পরিবারে আশাই এখন একমাত্র অবশিষ্ট সম্পদ। আমরা হারিয়েছি ঘরবাড়ি, জীবিকা, স্বপ্ন আর নিরাপত্তা। আমার স্বামী চাকরি হারিয়েছেন, আমি হারিয়েছি নিজের আকাঙ্ক্ষা। সবচেয়ে নির্মম হলো— আমার ছেলে তার শৈশব হারিয়েছে। তার সেই ছোট্ট দুনিয়া, যেখানে সে নিরাপদ ও আনন্দে ছিল, আজ ভেঙে-চুরে মিসমার।

আমাদের আর টিকে থাকার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই। গত মাসে শেষ সম্বল— আমার বিয়ের আংটি— বিক্রি করতে হয়েছে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য।

টানা কয়েক মাসের দুর্ভিক্ষের পর আগস্টে এসে গাজার বাজারগুলো কিছুটা প্রাণ ফিরে পায়। দেখা যায় চিজ, তেল আর ফলমূল— যেগুলোর অস্তিত্ব পর্যন্ত আমরা অনেক মাস ধরেই ভুলে ছিলাম। কিন্তু পুণরায় সেসব পণ্যের দেখা পাওয়া যেন এক নির্মম অভিজ্ঞতা— কারণ সেগুলোর দাম আমাদের নাগালের বহু বাইরে। অনেক আগেই ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছে অধিকাংশ লোক।

আমি ছেলেকে বাজার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতাম, যেন তার চোখে চিজ না পড়ে। কিন্তু পারলাম না। একদিন সে আমার ও তার বাবার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চিজের দোকানের সামনে থেমে গেল। চিজ খাওয়ার আবদার করল। উপায় না দেখে আমি তাকে ফালাফেল স্যান্ডউইচ কিনতে এক শেকেল দিলাম। ভাবলাম, অন্তত তার ক্ষুধাটা মিটবে। কিন্তু সে মলিন মুখে বলল, ‘আমি ফালাফেল চাই না, এতে পেট ব্যথা করে। আমি মজার চিজটাই চাই।’

ওর কথাগুলো শুনে আমার হৃদয়টা যেন টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

সেদিন আমি মনে মনে বলেছিলাম— আহা, এই ফল আর চিজ যদি গাজা স্ট্রিপে কখনোই না আসত! গত কয়েক মাস ধরে আমরা জীবন বাঁচাতে অতি উচ্চমূল্যে নিম্নমানের খাবার কিনে আমাদের সঞ্চয় শেষ করেছি।

সন্ধ্যায় আমার স্বামী মলিন বদনে বাড়ি ফিরলেন। বাজারের অস্বাভাবিক মূল্য নিয়ে তিক্ত স্বরে বললেন, ‘এই দামে কিছুই কেনা যায় না।’ আমি তাকে জানালাম, আংটিটা বিক্রি করার কথা ভাবছি। তিনি তীব্র আপত্তি জানালেন। তখন তিনি যেতে চাইলেন ত্রাণ বিতরণের স্থানে— যেটাকে তিনি ‘মৃত্যুফাঁদ’ বলতেন।

আমি হাতজোড় করে তাকে যেতে নিষেধ করলাম। কারণ সত্যিই তা ছিল মৃত্যুফাঁদ। জানতাম, অনেকেই সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। তিনি আমার দিকে দুঃখভরা চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাদের ছেলে কতদিন ধরে কিছু খায়নি। আমি কীভাবে না গিয়ে থাকি?’

এই তো দুই সপ্তাহ আগের কথা। তার ভাই পাঁচ সদস্যের পরিবারের জন্য আটা আনতে গিয়ে দখলদার বাহিনীর গুলিতে শহিদ হয়েছেন।

পরদিন সকালে আমি গেলাম স্বর্ণকারের দোকানে। একেবারে পানির দামে আংটিটি বিক্রি করতে হয়েছে। যুদ্ধ-পূর্ব সময়ের চেয়ে দাম এখন একেবারে তলানিতে। কিন্তু আমার আর কোনো উপায়ই ছিল না।

পাঁচ কেজি আটা, এক লিটার অলিভ ওয়েল, আধা কেজি থাইম (এক ধরণের পুদিনা), এক কেজি তাহিনি (তিল থেকে তৈরী), দুই ক্যান চিজ, এক কেজি চিনি আর এক ক্যান টমেটো সস— আংটি বেচে মাত্র একয়টা জিনিস কেনারই টাকা উঠল।

বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরতেই মনে হলো, ঈদ এসে গেছে। আমরা সবাই একসঙ্গে বসলাম— টেবিলে ছিল চিজ, মিষ্টি চা, তাজা রুটি আর থাইম। মাসের পর মাস এই খাবারগুলো ছিল স্বপ্নেরও অতীত। দুঃখের সাগরে সেই মুহূর্তে এক ফোঁটা আনন্দ খুঁজে পেলাম।

হাতের দিকে তাকাতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল— আংটিটি আর নেই। কিন্তু সন্তানের মুখে “চিজের হাসিটুকু” দেখে হৃদয়টা প্রশান্ত হলো।

বাজারটা টিকল মাত্র এক সপ্তাহ। তারপর ক্ষুধা আবারও তার হিংস্র থাবা নিয়ে ফিরে এল। আমরা দিনে মাত্র একবেলা খেতে শুরু করলাম— এক টুকরো রুটি, চা আর থাইম।

গত দুই বছর ধরে আমরা একে একে বিক্রি করেছি আমাদের স্বপ্নগুলো— শুধু স্বর্ণ নয়, স্মৃতিগুলোও। গাজা শহরের শাইখ রেদওয়ান এলাকায় আমাদের বাড়িটি বহুবার ছেড়ে যেতে হয়েছে। এই মাসের শুরুতেও শেষবারের মতো ঘর ছাড়তে হলো। এখন আমরা আছি খান ইউনুসের একটি তাঁবুতে। প্রিয় সবকিছু ও সবাইকে ছেড়ে আসতে আসতে আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত।
এখন আমার একটাই আশা— এই যুদ্ধ যেন শেষ হয়।

এক সকালে ঘুম ভেঙে যেন জানতে পারি— আমার সন্তান নিরাপদ, তার ভবিষ্যৎ আর অন্ধকার নয়। আমি স্বপ্ন দেখি, তাকে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে পারছি— যেমনটা যুদ্ধের আগে দিতাম। কোনো খাদ্যসংকট নেই, চড়া মূল্যের ভয় নেই, নেই টাকার চিন্তা।

আমি স্বপ্ন দেখি— ফিরে যাচ্ছি আমাদের বাড়িতে, যেখানে ছিল নিশ্চিন্ত এক জীবন। স্কুলগুলো আবার খুলছে, আমি আর আমার স্বামী ফিরে যাচ্ছি শিক্ষকতার সেই নির্মল জীবনে। আর যেদিন যুদ্ধ সত্যিই থামবে, সেদিন আমি প্রথমেই আমার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে বলব— ‘আর কোনো ভয় নেই, বাবা আমার।’ তারপর ফিরব আমাদের ঘরে— সেখানে ঘর বলতে যতটুকুই অবশিষ্ট থাকুক না কেন।

মূল: সাঈদা হামদুনা
গাজার একজন লেখিকা
তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন