মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

ইউরোপের সামরিক বিপ্লবে উসমানি কামানের অবদান 

সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ  নিজেও কামান প্রযুক্তিতে গভীর জ্ঞান রাখতেন। কন্সটান্টিনোপল অবরোধে বাইজেন্টাইন নৌবাহিনীতে আঘাত হানতে তিনি তৈরি করেন উচ্চ কোণের কামান—যার ডিজাইন ছিল আজকের ‘মর্টার’-এর মতো।
ইউরোপের সামরিক বিপ্লবে উসমানি কামানের অবদান । ছবি :সোরা
ইউরোপের সামরিক বিপ্লবে উসমানি কামানের অবদান । ছবি :সোরা

১৮০৭ সাল, রমজান মাসের শেষভাগ। উসমানি সাম্রাজ্যের সাথে বড় ধরনের এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ব্রিটেন। যু্দ্ধের কারণ ছিল নিজ মিত্রের স্বার্থ রক্ষা। সে সময়কার বৈশ্বিক জোটসমূহের প্রেক্ষাপটে একদিকে উসমানিদের মিত্র ছিল ফরাসি বিপ্লবের নায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্টের নেতৃত্বাধীন ফ্রান্স। অন্যদিকে  রাশিয়ার মিত্র ছিল গ্রেট ব্রিটেন।

যেহেতু এধরণের জোট পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তাই উসমানিদের মিত্র ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত কাউন্ট সেবাস্তিয়ানি দারদেনেলিস প্রণালীতে রাশিয়াকে দেওয়া বিশেষ সুবিধাগুলো বাতিল করতে প্রস্তাব দেন এবং শুধুমাত্র ফরাসি নৌবাহিনীর জন্য দারদানেলস প্রণালী খুলে দেওয়ার দাবি জানান।

বিনিময়ে ফ্রান্স সার্বিয়ায় বিদ্রোহ দমন এবং বলকানে হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে উসমানিদের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন।স্বাভাবিকভাবেই এতে রাশিয়া-বৃটেনে জোটের স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছিল। ফলে, ব্রিটিশরা সামরিক ও নৌ অভিযানের মাধ্যমে উসমানিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। শুরুতে যদিও এই অভিযানে ব্রিটিশদের বেশ কিছু ব্যর্থতা দেখা দেয়—উদাহরণস্বরূপ, তাদের একটি বড় জাহাজে আগুন ধরে যাওয়া। তা সত্ত্বেও প্রাথমিকভাবে উসমানিদের পক্ষ থেকে কোন বাঁধা না পেয়ে ব্রিটিশদের মনে হচ্ছিল যুদ্ধে তারাই এগিয়ে রয়েছে। এই আত্মবিশ্বাসের জোরে ব্রিটেন উসমানি সুলতান তৃতীয় সেলিমকে ফরাসি রাষ্ট্রদূত সেবাস্তিয়ানিকে বহিষ্কার, এবং দারদানেলসের কৌশলগত স্থান থেকে উসমানি নৌবাহিনীকে গুটিয়ে তা রাশিয়ার হাতে তুলে দিতে বলে। কিন্তু সুলতান বৃটেনের এসব অযৌক্তিক দাবি প্রত্যাখ্যান করলে ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল জন থমাস ডাকওর্থ দারদানেলেস প্রণালীতে প্রবেশ করে কিছু উসমানি নৌঘাঁটি ধ্বংস করেন। কিন্তু তিনি ইস্তানবুল দখলে ব্যর্থ হন। কেননা সেখানে তখন ফরাসিদের সহায়তায় প্রস্তুত ছিল দুর্বোধ্য প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আর উসমানিদের বিখ্যাত কামান । 

দারদানেল কামান

১৮০৭ সালের সেই যুদ্ধের এক অনন্য ইতিহাস তৈরি করেছিল উসমানিদের ‘দারদানেল কামান’। ১৪৬৪ সালে, সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ-র শাসনামলে এই কামানটি তৈরি হয় । তিন শতকেরও বেশি পুরনো এই কামানের আঘাতে ব্রিটিশ বাহিনীর ৪২ জন নিহত, ২৩৫ জন আহত ও ৪ জন নিখোঁজ হয়। ফলে ১৮০৭ সালের মার্চ মাসে এ্যাডমিরাল জন থমাস ডাকওর্থ পিছু হটতে বাধ্য হন।

প্রিয় পাঠক! এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য জানতে হবে কিছু অজানা অতীত। 

কামানের বিবর্তন ও উসমানি আবিষ্কার

সর্বপ্রথম ১২শ শতকে চীনে কামান আবিষ্কৃত হয়। তবে সেটি মূলত এক ধরনের ‘আগ্নেয় বর্শা’ ছিল। ১৩শ শতকের শেষ দিকে কামান যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে এবং পরবর্তী শতকে এটি ছড়িয়ে পড়ে ইউরেশিয়া, মিশর, লেভান্ট বা বৃহত্তর শাম অঞ্চল ও মরক্কোতে। ১৩২০-৩০ এর দশকে ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রেও কামান ব্যবহৃত হয়।

তবে উসমানিরা কামান ও বারুদ প্রযুক্তির উন্নয়নে তৎকালীন সময়ে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে প্রথম কবে উসমানিরা এর ব্যবহার শুরু করেছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। ইতিহাসবিদরা ১৩৫৪, ১৩৬৪, ১৩৮৬ ও ১৩৮৯ সালে উসমানিদের কামান ব্যবহার শুরু করার তথ্য দিলেও এসব তথ্যের লেখকরা বহু পরের ছিলেন। তবে হাঙ্গেরিয়ান গবেষক গ্যাবর আগোস্টনের মতে, সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের ( প্রথম শাসনকাল : ২৬ মে ১৪২১–আগস্ট ১৪৪৪খ্রি:, দ্বিতীয়বার: সেপ্টেম্বর ১৪৪৬–৩ ফেব্রুয়ারি ১৪৫১খ্রি: ) সময়কার একটি সামরিক জায়গীরের (যাকে উসমানি ইতিহাসে তিমার বলা হয়) দপ্তরী নথিপত্রে সুলতান প্রথম বায়জিদ (১৩৮৯খ্রি:–১৪০২খ্রি:) আমলের ‘তুপচি উমর’ নামে একজন কামান বিশেষজ্ঞের উল্লেখ পাওয়া যায়। যার মানে দাড়ায় সুলতান প্রথম বায়জিদের (১৩৮৯খ্রি:–১৪০২খ্রি:) সময়েই উসমানিরা কামান ব্যবহারকে একটি সংগঠিত সেনা বিভাগে রূপ দেয়। 

শুরুতে যদিও এসব কামান দুর্গদখলে ব্যবহৃত হত, কিন্তু পরবর্তিতে মুখোমুখি লড়াইয়েও এর ব্যবহার শুরু হয়। ধীরে ধীরে কামান আরও হালকা, দ্রুতগামী ও নিখুঁত হয়।

বিশেষত কামানের ভেতর খাঁজকাটা সর্পিল নকশা বা রাইফেলিং (rifling) প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় কামানের লক্ষ্যভেদমাত্রা এবং বিধ্বংসী ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। দুটি বিশ্বযুদ্ধে কামান ছিল প্রধান মারণাস্ত্র। আর বর্তমানের আধুনিক স্বয়ংক্রিয় কামানগুলোতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত কামানের প্রযুক্তির উন্নত রূপায়ন। কুয়েশ্চনস অফ হিস্টোরি (Questions of History) নামক এনসাইক্লোপেডিয়ার গবেষকরা বলেন—যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের গুরুত্ব খুব ভালভাবেই অনুধাবন করেছিল উসমানিরা। কারণ তারা আগে থেকেই এগুলোর সাফল্য দেখেছে। ফলে উসমানিরা তাদের আমলে নির্মাণ করেছিল ইতিহাস বিখ্যাত সব কামান। এসব ঐতিহাসিক কামানের একটি ছিল দারদানেল কামান। 

দারদানেল কামান

এই কামানটির ডিজাইনার ছিলেন ‘আস্তা মুনির আলি’ নামে এক উসমানি মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার। যিনি ১৪৬৪ সালে বিখ্যাত হাঙ্গেরিয়ান কামান ডিজাইনার ‘আরবান’-এর নকশা অনুসরণ করে এই কামান নির্মাণ করেন। আরবান এই ধরণের কামান প্রথম ব্যবহার করেন ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল অবরোধে। 

প্রায় ১.১ মিটার ব্যাসের নল এবং ৫.২ মিটার লম্বা এই কামানের ওজন ছিল ১৬.৮ টন। এই কামান দিয়ে এক মাইলেরও বেশি দূরে গোলা ছোড়া যেত। আরবানের ডিজাইন করা কামানের মত এটির ব্যারেলের মধ্যভাগেও স্ক্রুর প্যাচের মত দুটি বিভাজ্য অংশ ছিল। 

গবেষক জে. এইচ. লেফরয় জানান, এই কামানের ভিতরের অংশে যেভাবে  গলিত টিন ও ব্রোঞ্জ ঢালা হতো, তাতে তাপমাত্রা অসমানভাবে ছড়াত এবং ব্যারেলের অভ্যন্তর মসৃণ হয়ে যেত। তবে স্ক্রুর মত সংযুক্ত অংশগুলো তুলনামূলক বেশি মজবুত হতো।

১৮০৭ সালে এই কামানের আক্রমণেই ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি দারদানেলস প্রণালী পার হতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তিতে ১৮৬৮ সালে উসমানি সুলতান আবদুল আজিজ এটি ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়াকে উপহার হিসেবে পাঠান

১৮০৭ সালে এই কামানের আক্রমণেই ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি দারদানেলস প্রণালী পার হতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তিতে ১৮৬৮ সালে উসমানি সুলতান আবদুল আজিজ এটি ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়াকে উপহার হিসেবে পাঠান

বর্তমানে এটি ব্রিটেনের রয়্যাল আর্মারিজ মিউজিয়ামে (Royal Armouries Museum)-এ সংরক্ষিত আছে। ১৮৬৮ সালে সুলতান আবদুল আজিজ এটি উপহার হিসেবে দেন।  

আরবান ও ব্যাসিলিকা

কনস্টান্টিনোপল অবরোধের আগে উসমানিরা নিজ রাজ্যসীমায় বাইরের আক্রমণ ঠেকাতে নানা চুক্তি করে। সেইসাথে কন্সটান্টিনোপল অবরোধকে কেন্দ্র করে উসমানিদের অস্ত্র কারখানায় শুরু হয় নতুন কামান তৈরির কাজ। খোজ শুরু হয় দক্ষ কামান নির্মাতার। উসমানিরা যখন কনস্টান্টিনোপলের দুর্ভেদ্য দেয়াল বিধ্বংসী শক্তিশালী আর্টিলারি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ব্যস্ত ঠিক তখন বাইজেন্টাইন সম্রাটের কাছে বিখ্যাত হাঙ্গেরিয়ান কামান নির্মাতা আরবান নিয়ে আসে এক অবিশ্বাস্য শক্তিশালী কামান নির্মাণের প্রস্তাব। কিন্তু পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক ও কাঁচামালের অভাবে বাইজেন্টাইনরা সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।  আরবান তখন উসমানি সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহর কাছে যান। তিনি বলেন,

‘আমি এমন কামান তৈরি করতে পারি যা কনস্টান্টিনোপলের দেয়ালতো বটেই, গুড়িয়ে দিবে ইতিহাস বিখ্যাত ব্যাবিলনের দেয়ালও!’

বুদ্ধিমান সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ  লুফে নেন আরবানের সেই প্রস্তাব। আরবান তখন তৎকালীন উসমানি রাজধানী এডির্নের অস্ত্র কারখানায় একটি বিশাল ছাঁচে ব্রোঞ্জ ঢেলে তৈরি করেন ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ কামান ‘ব্যাসিলিকা’। যার দৈর্ঘ্য ছিল ৮.২ মিটার। ওজন ছিল প্রায় ১৫ টন। ৭৬ সেন্টিমিটারের বিশাল নলের অধিকারী এই দানবকে টেনে নিতে দরকার হতো ৬০টি ষাঁড়ের। একইসাথে এর অন্যান্য সরঞ্জাম পরিবহনে ব্যবহার হত ৪০০ জন সৈনিক। তবে কামানটি দিয়ে দিনে মাত্র ৩-৭ বার গোলা ছোড়া যেত এবং প্রতিবার গোলা বর্ষণের পরে এর ব্যারেল ঠান্ডা করতে প্রচুর জলপাই তেল ঢালতে হত। এছাড়াও আরবান ‘ব্যাসিলিকা’ ছাড়া নির্মাণ করেছিলেন আরও কিছু কামান। যেসব কামানের আক্রমণে ধসে পড়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের এক হাজার বছরের দুর্গপ্রাচীর।

কামানপ্রেমী সুলতান  

সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ  নিজেও কামান প্রযুক্তিতে গভীর জ্ঞান রাখতেন। কন্সটান্টিনোপল অবরোধে বাইজেন্টাইন নৌবাহিনীতে আঘাত হানতে তিনি তৈরি করেন উচ্চ কোণের কামান—যার ডিজাইন ছিল আজকের ‘মর্টার’-এর মতো। এই ধরনের কামান সফলভাবে ব্যবহৃত হয় এবং বহু জাহাজ ডুবিয়ে দেয়।

ইউরোপীয় সামরিক শিল্পে উসমানিদের অবদান

এই বিশাল উসমানি কামানগুলো কেবল বাইজেন্টাইনের পতনই ঘটায়নি , বরং ইউরোপীয় শিল্প ও প্রযুক্তি ইতিহাসে সূচনা করে এক নতুন বিপ্লবেরও। যেমন বিখ্যাত ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী ও প্রকৌশলী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা কামানের নকশা অনেকটাই উসমানি কামানের মতো। ধারণা করা হয়, তিনি হয়ত উসমানি কামান দেখেই অনুপ্রাণিত হন। এমনকি লিওনার্দো ভিঞ্চি সুলতান বায়াজিদ দ্বিতীয়কে (১৪৮১খ্রিঃ–১৫১২খ্রিঃ) গোল্ডেন হর্ন (Golden Horn) উপসাগরের উপর একটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দেন, যা প্রমাণ করে লিওনার্দো ভিঞ্চি উসমানিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী ছিলেন।

সূত্র: আল-জাজিরা, বিভিন্ন ইতিহাসভিত্তিক ওয়েবসাইট