অনেক দিন ধরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার তালেবানের কাছে বাগরাম বিমানঘাঁটি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। সেই সঙ্গে হুমকি দিয়েছেন, দাবি না মানলে শক্তি প্রয়োগ করে ঘাঁটি পুনর্দখলের পথেও যেতে পারে ওয়াশিংটন। নানা ইস্যুতে যেমনটা দেখা গেছে, ট্রাম্প সাধারণত শুরুতে কঠোর ও উত্তেজনাকর ভাষায় অবস্থান নেন, তারপর ধীরে ধীরে তুলনামূলক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে যান।
ট্রাম্পের তালেবানসংক্রান্ত সর্বশেষ প্রস্তাবের পেছনেও একই ধরনের হিসাবি কৌশল রয়েছে। বাহ্যিক অবস্থান যতই আগ্রাসী দেখাক, আড়ালে তিনি আবারও প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি তালেবানের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যস্থতায় এমন এক চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন, যাতে অন্তর্ভুক্ত আছে আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ ও মধ্য এশিয়ায় মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য সুবিধাজনক লজিস্টিক ব্যবস্থার পথ তৈরি। পাশাপাশি তিনি আফগান-মার্কিনি কূটনীতিক জালমে খলিলজাদকে নিখোঁজ মার্কিন নাগরিকদের সন্ধান ও সংশ্লিষ্ট আলোচনার জন্য একাধিক মিশনে আফগানিস্তান পাঠিয়েছেন।
মার্কিন রক্ত-অর্থের বিনিময়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া ও চীন
ট্রাম্পের দলে এমন বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা আছেন, যারা আফগান যুদ্ধ সরাসরি দেখেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী পিট হেগসেথ, জাতিসংঘে তাঁর রাষ্ট্রদূত মাইকেল ওয়াল্টজ, গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ড। রয়েছেন কাশ প্যাটেল ও সেবাস্টিয়ান গরকার মতো ব্যক্তিরাও, যারা আফগানিস্তানে বেসামরিক মিশনে কাজ করেছেন।
এই সব কর্মকর্তার ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে রক্ত ও অর্থ দু’দিক থেকেই ভয়াবহ মূল্য পরিশোধ করেছে। হাজার হাজার মার্কিনি সৈন্য নিহত হয়েছেন, এবং যুদ্ধ-হস্তক্ষেপের ব্যয় করদাতাদের প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। তাঁদের মতে, এত বড় মূল্য যুক্তরাষ্ট্র এই জন্য দেয়নি যে রাশিয়া বা চীন এসে তার সুফল ভোগ করবে। চাই তা এক ট্রিলিয়ন ডলারের বিরল খনিজসম্পদ দখল হোক, কিংবা বাগরাম বিমানঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ।
সম্প্রতি রাশিয়া প্রথম দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানের বৈধ সরকার হিসেবে তালেবানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও তালেবান এখনো পশ্চিমা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং অধিকাংশ প্রতিবেশী দেশ ও ইউরোপীয় মিশনগুলো কাবুলে তাদের কূটনৈতিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে, তবু প্রকাশ্য স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে একমাত্র মস্কো।
একই সময়ে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার মিত্র দেশগুলো, যেমন তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তানও কাবুলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়িয়েছে। এসব দেশ আফগানিস্তানের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি সই করেছে এবং নতুন লজিস্টিক করিডোর চালু করেছে। আর রাশিয়ার অন্যতম প্রধান প্রতিরক্ষা মিত্র ও সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা ভারত তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই আফগান ইস্যুতে একটি ঐতিহাসিক খেলোয়াড়। সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই এই আফগানিস্তান নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। যা ‘দ্য গ্রেট গেম’ নামে পরিচিত, লেখক পিটার হপকির্ক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে যার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তখন আফগানিস্তান ছিল ব্রিটিশ ও রাশিয়ান সাম্রাজ্যের প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু। কারণ আফগানিস্তানের অবস্থান মধ্য এশিয়াকে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা বিস্তৃত স্থলভাগের ঠিক মাঝখানে।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রভাবশালী তাত্ত্বিক জবিগনিউ ব্রেজিনস্কি মনে করতেন, ইউরেশীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারই বিশ্ব-প্রভাবের চাবিকাঠি। হেনরি কিসিঞ্জারও একই নীতি অনুসরণ করতেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি বহুবার পাকিস্তান সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের আফগান নীতি গঠন করতে।
বর্তমানে চীন আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। তারা ওয়াখান করিডোর হয়ে সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করেছে এবং দেশের উত্তরের অঞ্চল থেকে খনিজ ও গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে। বেইজিং এখন আফগানিস্তানকে কেবল কূটনীতির চোখে দেখছে না; দেশটি তাদের জন্য সরাসরি নিরাপত্তা ঝুঁকিও। কারণ নব্বইয়ের দশকে তালেবানের প্রথম শাসনামলে চীনবিরোধী উয়ঘুর যোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন দিয়েছিল কাবুল। সেই অভিজ্ঞতা আর ফিরে না আসুক, এটাই এখন চীনের মূল লক্ষ্য।
এই কারণেই গত কয়েক বছর ধরে তালেবানকে আপন করে নেওয়ার কৌশল নিয়েছে বেইজিং। আফগানিস্তানে তারা বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছে। বিনিময়ে এক ধরনের সমঝোতাও হয়েছে, কাবুল কোনোভাবেই যেন চীনবিরোধী তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টকে আশ্রয় বা সমর্থন না দেয়।
আজ কাবুলের চায়না টাউন দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে, সেখানে চীনা পণ্যে ভরপুর একটি পূর্ণাঙ্গ বাজার গড়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক উপস্থিতির পাশাপাশি চীন দেশটির কয়েকটি স্থানীয় গণমাধ্যমকেও অর্থায়ন করছে। পাশাপাশি বেইজিং প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আফগানিস্তানের সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ককে ইরান ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করবে। এতে স্পষ্ট, এশিয়ার এই হৃদয়ভূমিতে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান আরও শক্ত করে গড়তে চায় চীন।
কাবুল ও আবুধাবিতে তাঁর শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের পাঠানো ট্রাম্পের বড় ধরনের কৌশলের অংশ। লক্ষ্য হলো, মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত স্থল ও আকাশপথে লজিস্টিক চুক্তি নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে এই পদক্ষেপের মাধ্যমে আফগানিস্তানে চীনের দ্রুত বিস্তার ঠেকানো, যা পাকিস্তান ও ইরানে বেইজিংয়ের প্রভাব আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। গত সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র একটি খনিজসম্পদ-সংক্রান্ত চুক্তি সই করে, যার আলোচনা সরাসরি জেনারেল আসিম মুনির ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
আফগানিস্তানে যুদ্ধ করা মার্কিনি সাবেক সেনাদের চাপেই ট্রাম্প এখন তালেবানের ওপর একই ধরনের একটি চুক্তির জন্য চাপ বাড়াচ্ছেন। তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে বাগরাম বিমানঘাঁটিকে একটি কেন্দ্রীয় ভূরাজনৈতিক ঘাঁটিতে রূপান্তর করা হতে পারে। বিশেষত ঘাঁটিটির চীনা সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য যেকোনো সংঘাতের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রাম্পের একটি পরিচিত কৌশল হলো তালেবানের সঙ্গে ‘লাভ-লাঠি’ বা ‘প্রণোদনা-ভীতি’ (carrot and stick) নীতি ব্যবহার করা। এবারও তিনি একই পথ নিয়েছেন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। উদ্দেশ্য, কান্দাহারের তালেবান ‘শুরা পরিষদ’ ও পূর্বাঞ্চলে শক্তিশালী হাক্কানি নেটওয়ার্কের মধ্যে ফাটল তৈরি করা। ট্রাম্প আশা করছেন, তালেবানের অন্তত একটি শক্তিশালী অংশকে নিজের দিকে টেনে এনে খনিজসম্পদ সম্পর্কিত একটি চুক্তি করানো যাবে, পাশাপাশি ‘দায়েশ খোরাসান’ মোকাবিলায় একটি অভিন্ন ফ্রন্ট গঠন করা সম্ভব হবে।
এর পাশাপাশি, মধ্য এশিয়ায় এখনো সূক্ষ্ম এক ভারসাম্যের খেলা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই অঞ্চলে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি রয়েছে তাজিকিস্তানে, আর কাছাকাছিই তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্থান—যে দুটি দেশ খনিজ ও জ্বালানিসম্পদে সমৃদ্ধ। ওয়াশিংটনের লক্ষ্য, এই দুই দেশে রাশিয়া ও চীনের প্রভাব কমাতে নিজেদের উপস্থিতি আরও জোরদার করা।
এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র নীরবে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন অনুমোদন করেছে, যার মাধ্যমে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) এবং যুদ্ধ বিভাগকে আফগান প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অগ্রাধিকার পাচ্ছে আহমদ শাহ মাসউদের নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’। তবে শর্ত হলো, এ গোষ্ঠীতে সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের থাকতে হবে, যাদের একসময় ওয়াশিংটনই সমর্থন দিয়েছে।
এই পদক্ষেপই ইঙ্গিত দেয়, যদি তালেবান সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকে, তবে যুক্তরাষ্ট্র আহমদ মাসউদ ও তার মিত্র কমান্ডো ইউনিটগুলোকে সমর্থন দেওয়ার পথে এগোতে পারে।
তিন শতাব্দী ধরে খুব বেশি কিছু বদলায়নি। আফগানিস্তান সব সময়ই ছিল পরাশক্তিদের প্রতিযোগিতার কেন্দ্র, ব্রিটিশ ও রাশিয়ানদের থেকে শুরু করে আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পর্যন্ত। হয়তো তা আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানের জন্য অথবা তার খনিজ সম্পদের জন্য।
তালেবানের দখলে এখন যে বিপুল খনিজসম্পদ রয়েছে, তার বাজারমূল্য আনুমানিক এক ট্রিলিয়ন ডলার। এই বাস্তবতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে, এখন ভূরাজনীতি আর স্বর্ণলোভ, দুটোই সমান শক্তিতে টান দিচ্ছে। আর সেই খনিজসম্পদের অংশ রাশিয়া ও চীনের হাত থেকে নিজের করতে ট্রাম্প প্রশাসন জোর তদবির চালাচ্ছে।
সূত্র: মাজাল্লা











