সামনে নভেম্বর মাসে ইরাকের রাজনীতিতে আসছে নতুন সংসদীয় নির্বাচন। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনের পটভূমি মোটেও সহজ নয়। ইরাক এখন জটিল রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—নিরাপত্তা সংকট, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা দেশের ভবিষ্যতকে কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছে। যদিও আঞ্চলিক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ইরানের প্রভাব কিছুটা কমেছে, তবুও দেশে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি ক্রমবর্ধমান। তাছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিরাপত্তা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তৎপরতাও দেখা যায়নি। এই কারণে আসন্ন সংসদ নির্বাচন, সরকারের বৈধতা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
নিরাপত্তা পরিস্থিতি
ইরাকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও অস্থিতিশীল। সেখানে সন্ত্রাসী গােষ্ঠী আইএস এখনও সক্রিয়। নিনেভা, আনবার ও সালাহউদ্দিন প্রদেশে ছোট ছোট সেলে তারা সক্রিয় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আংশিক সেনা প্রত্যাহার এবং ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের ছায়া দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও জটিল করেছে। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, মার্কিন বাহিনীর বড় অংশ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রত্যাহার সম্পন্ন করেছে। এ অবস্থায় হাশদ আশ-শাবি (ইরাকের একটি রাষ্ট্র-সমর্থিত সামরিক জোট)–এর রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ইরাকে এখন নিরাপত্তা মানে শুধু সেনা নয়, এটি জোট ও প্রভাবের লড়াই। বাস্তবিক অর্থে ইরাকের নিরাপত্তা এখন শুধুমাত্র সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতার বিষয় নয়; বরং অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতা: ‘মানি পলিটিক্স’
রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় এখন ‘মানি পলিটিক্স’। ২০১৫ সালের দলীয় অর্থনীতি আইন ‘ব্যয়ের সীমারেখা’ নির্ধারণ করলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। নির্বাচনী তহবিলের স্বচ্ছতা এখনো দুর্বল; ফলে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো অর্থের জোরে নির্বাচনী মাঠ নিয়ন্ত্রণ করছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২৫ সালের সূচকে ইরাক ১৮০ দেশের মধ্যে ১৪০তম স্থানে রয়েছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৭২ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, রাজনীতি মানেই দুর্নীতি। জনমনে হতাশা বাড়লেও অর্থ ও প্রভাবের রাজনীতি দিনদিন আরও গভীর হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছেন, প্রতি ভোটের পেছনে এখন এক ডলার নয়, বরং তার পেছনে রয়েছে এক ডজন স্বার্থ। অর্থ ও প্রভাবের রাজনীতির এই প্রবণতা নির্বাচনকে শুধুমাত্র একটি প্রক্রিয়া নয়, বরং ক্ষমতা ও সম্পদের লড়াইয়ে রূপান্তরিত করছে।
২০১৯ সালের অক্টোবরের আন্দোলন লক্ষ লক্ষ মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছিল। তারা স্বজনপ্রীতি, কোটা ব্যবস্থা, দুর্নীতি এবং ইরানি প্রভাবের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়েছিল। যদিও পরে আন্দোলন দমন করা হয়, তবুও সেই আন্দোলনের চেতনা আজও অনেকের মধ্যে জাগরূক রয়েছে। আন্দোলনে আহতদের জন্য কাজ করা সংস্থা ‘সাফা’-র সহসভাপতি মুজতবা আহমদ বলেন, আমরা এমন একটি নির্বাচন চাই, যেখানে অস্ত্র ও কালো টাকার প্রভাব থাকবে না। ইরাককে নিজের কণ্ঠে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে।
ইরানি প্রভাব: পর্দার আড়ালের খেলোয়াড়
ইরানি প্রভাব ইরাকের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা পেয়েছে। সিরিয়া যুদ্ধের পরিবর্তিত বাস্তবতায় তেহরান সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বদলে স্থানীয় রাজনৈতিক মিত্রদের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করছে। হিজবুল্লাহর দুর্বলতা, মার্কিন সক্রিয়তা এবং আরব ব্লকের কূটনৈতিক পুনর্জাগরণ ইরানকে পর্দার আড়ালের খেলোয়াড় হিসেবে ভূমিকা নিতে বাধ্য করেছে।
বর্তমানে ইরান অর্থনৈতিক ফান্ডিংয়ের পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক জোটের মাধ্যমে ইরাকে তার প্রভাব বিস্তার করছে। এই প্রভাব সরাসরি রাজনীতির ময়দানে হলেও তা প্রকাশ্যে নয়; বরং আঞ্চলিক ও স্থানীয় জোটের মাধ্যমে প্রসারিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরান তার শক্তি প্রদর্শন করতে চায়, কিন্তু সরাসরি হস্তক্ষেপের ঝুঁকি এড়িয়ে চলছে। বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনমার সারা বলেন, যদিও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব কিছুটা কমেছে, ইরাকের অভ্যন্তরে তা তেমনটা কমবে না। বরং কিছু গোষ্ঠীর শক্তি এত বেশি যে, ইরানও তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
‘আইন ৩৬’ এবং ইরানি প্রভাব রোধের প্রচেষ্টা
২০১৯ সালে ইরাকের সংসদে পাস হওয়া ‘৩৬ নম্বর আইন’ অনুযায়ী কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী রাজনীতিতে অংশ নিতে পারবে না। তবে এখন পর্যন্ত এই আইন কার্যকর হয়নি। নির্বাচনের আগে এই আইন বাস্তবায়নের দাবি নতুন করে জোরালো হয়েছে। নাগরিক সমাজের নেত্রী ইউসরা জায়নাব বলেন, ইরান ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোর আত্মবিশ্বাস কিছুটা কমেছে। এটি নাগরিক ও প্রগতিশীল শক্তির জন্য সুবর্ণ সুযোগ। বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনমার সারা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব কমলেও ইরাকের অভ্যন্তরে ইরান ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলো এখনও শক্তিশালী। এই গোষ্ঠীগুলো ইরাকের রাজনীতির মূল সমস্যা।
রাজনৈতিক জোট ও সম্ভাব্য ভারসাম্য
ইরাকের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন তিন ভাগে বিভক্ত—শিয়া, সুন্নি ও কুর্দি জোটে। শিয়াদের মধ্যে ‘ইত্তিহাদ আল-তানসিকি’ ফ্রেমওয়ার্ক এখনো প্রভাবশালী, যদিও অভ্যন্তরীণ বিভাজন তাদের ক্ষমতা হ্রাস করছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী সুদানির নেতৃত্বে ‘আল-ইমার ও আত-তানমিয়া’ জোট নতুন ভারসাম্য স্থাপনের চেষ্টা করছে। সুন্নি ফ্রন্টের ‘তাকাদ্দুম’ ও ‘আজম’ দলগুলো নেতৃত্বসংকটে ভুগছে। আরেদিকে কুর্দি রাজনীতিতে KDP ও PUK ধীরে ধীরে জাতীয় ঐক্যের পথে এগোচ্ছে।
নির্বাচনের ফলাফল ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
ইরাকের অতীত এবং বাস্তবতার নিরিখে আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য চিত্র এখনো অনিশ্চিত। একদিকে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো আগের মতোই প্রভাব বজায় রাখার সম্ভাবনা, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্ম ও নতুন নেতৃত্বের উত্থানও উপেক্ষা করার মতো নয়। তবে নিরাপত্তাজনিত অস্থিরতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা নির্বাচনী ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে। এ বিষয়ে বাগদাদের এক বিশ্লেষক বলেন, গণতন্ত্র তখনই টিকে, যখন অর্থ, বন্দুক আর বিদেশি প্রভাব তার নিয়তি নির্ধারণ করে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াসিক লুফতা মন্তব্য করেন, নতুন দলগুলোর কাছে অর্থ, অস্ত্র বা রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। তবুও দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের আশা তাদের মাধ্যমেই সম্ভব।
২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইরাকে ছয়বার নির্বাচনী আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০২০ সালে শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠভিত্তিক ও বহুমানদণ্ডভিত্তিক পদ্ধতি চালু করা হয়, যাতে ৭০ জন স্বাধীন প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারে। তবে ২০২৩ সালে পুরনো দলগুলো আবার ক্ষমতার ভারসাম্য নিজেদের দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াসিক লুফতা মন্তব্য করেন, নতুন রাজনৈতিক দলগুলো অর্থ, অস্ত্র বা ক্ষমতার অভাব থাকা সত্ত্বেও, দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের আশা আমাদের এদের মধ্যেই দেখতে হবে।
সবমিলিয়ে, ইরাকের ২০২৫ সালের নির্বাচন কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়। এটি দেশের সার্বভৌমত্ব, জনগণের আস্থা এবং আঞ্চলিক ভারসাম্যের পরীক্ষা। নিরাপত্তা সংকট, দুর্নীতির প্রভাব এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের মধ্যে গণতন্ত্র কতটুকু স্থির থাকবে, তা নির্ভর করছে সরকারের সক্ষমতা, আইনের প্রয়োগ এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয়তার উপর। বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৫ সালের নির্বাচন ইরাককে একটি নতুন রাজনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিতে পারে। ৩৬ নম্বর আইনের বাস্তবায়ন, ইরানি প্রভাবমুক্ত নির্বাচন এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা মিলিয়ে এবারের নির্বাচন হতে পারে ইতিহাসের এক মোড় পরিবর্তনকারী। তবুও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এই পরিবর্তন কি বাস্তব হবে? নাকি সবকিছু আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে যাবে?
আরবি নিউজ পোর্টাল থেকে অনূদিত











