মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

গাজাই আমার শেষ ঠিকানা

২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী আমার এলাকায় ঢুকে পড়েছিল। পরিবারের সঙ্গে গোলাবর্ষণের মধ্যেই পালাতে হয়েছিল। সেবারই প্রথম আমি ট্যাঙ্ক ও দখলদার সৈন্যদের সামনাসামনি দেখলাম। কয়েক মাস পর, ২০২৪ সালের শুরুতে, আবারও অবরুদ্ধ হলাম।
গাজাই আমার শেষ ঠিকানা


মুহুর্মুহু বোমার গর্জন আর অবরোধের ভয়াবহতা আমি জানি। তবু আমি জন্মভূমি ত্যাগ করবো না। বাস্তুচ্যুতির অনিঃশেষ যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে চাই না।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী গাজার মানুষকে জোরপূর্বক শহর ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে। তারা টাওয়ার ধ্বংস করছে, পাড়া-মহল্লায় নির্বিচারে বোমাবর্ষণ চালাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ দক্ষিণে পালিয়েছে, কিন্তু সেখানেও তারা আশ্রয় পায়নি।

এই তো গতকাল। আমার বাবার চাচাতো ভাই ইউসুফের পরিবারের তিন সদস্য নিহত হয়েছেন। দক্ষিণ গাজার একটি ভবনে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন। গাজা ছাড়ার কয়েক দিনের মাথায় সেই ভবনেই দখলদাররা বোমা ফেলে। ঘটনাস্থলেই মারা যান ইউসুফ আংকেলের স্ত্রী নিদাহ এবং তাদের দুই সন্তান—রূহ (১৯) ও হামুদ (১১)। আমরা তাদের মৃত্যুশোকে স্তব্ধ। হৃদয় আমাদের ভারাক্রান্ত।


গাজার দক্ষিণ জোনও নিরাপদ নয়। যদিও দখলদাররা ওটাই সেফ জোন দাবি করে। অথচ বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর তাবুতে ক্রমাগত আক্রমণ চালানো হচ্ছে। এখন গাজার মানুষের সামনে কেবল দুটি পথই খোলা: হয় শহরে থেকে মৃত্যু, বা শহর ত্যাগ করে মৃত্যু। তবে মৃত্যু যেন অবধারিত।

আমি গাজা শহরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হ্যাঁ, এখানে থাকা বিপজ্জনক। কিন্তু ছেড়ে যাওয়া মানে আমার বাড়ি, প্রতিবেশ, শেকড় ও পরিচয় হারানো। এখানেই আমি বড় হয়েছি। শৈশব-কৈশোরের প্রতিটি স্মৃতি এই শহরের মাটিতে প্রোথিত। এখানেই প্রথম নিঃশ্বাস, প্রথম হাঁটা, পরিবারের সব আনন্দ-বেদনার গল্প। এখানেই আমি জন্মেছি, আর এখানেই বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর স্বপ্ন দেখেছি। এই শহর ত্যাগ করা মানে নিজেকেই হারানো।

বন্ধুরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, ‘দখলদার বাহিনী তোমার এলাকায় ঢুকে পড়লে কোথায় যাবে?’ এই প্রশ্ন আমাকে থমকে দেয়। একটি ভালো উত্তর হাতড়ে বেড়াই। তারপর বলি, ‘পূর্ব গাজা শহরেরই কোনো এক কোণে যাবো হয়ত।’ কিন্তু শহর ছেড়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। শহর ত্যাগের কথা কখনোই ভাবিনি।

ওরা জোর দিয়ে বলত: ‘দখলদারদের স্থলবাহিনী শহরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। দানব ট্যাঙ্কগুলো গড়গড় করে তোমার এলাকার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। তাই হুদা, দয়া করে তুমিও দক্ষিণ গাজায় তোমার পরিবারের কাছে পালিয়ে যাও।’ আমি প্রতিবারই একই উত্তর দিতাম: মাই অনলি ডেস্টিনিশন ইস গাজা সিটি–আমার একমাত্র গন্তব্য গাজা সিটি।। দক্ষিণ গাজার কাউকেই আমি চিনি না। আর না সেখানে আমার আছে থাকার মতন কোনো তাঁবু বা স্থান।

সপ্তাহখানেক আগে দুটি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম। বলা তো যায় না, কী ঘটে। হয়ত এই বিল্ডিংয়ে (যেখানে আমি বাস করছি) আক্রমণ হবে। অথবা আমাকে পূর্বদিকে যেতে বাধ্য করবে। ব্যাগ গোছাতে গিয়ে ভাবছিলাম, এত সব কিছু কীভাবে নেব! শেষমেশ গরম ও ঠাণ্ডা মৌসুমের দুটি করে জামা নিলাম। সেইসাথে নিলাম কিছু বইপত্র, নোটবুক, একটি ছবির এ্যালবাম, কিছু টুকিটাকি জিনিস, আমার প্রিয় পারফিউম, হ্যাডফোন আর ফোনের চার্জার।
পালানোর জন্য নয়—প্রস্তুত থাকার জন্যই গোছগাছ করছিলাম। কারণ এটিই তো প্রথমবার নয়।

২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী আমার এলাকায় ঢুকে পড়েছিল। পরিবারের সঙ্গে গোলাবর্ষণের মধ্যেই পালাতে হয়েছিল। সেবারই প্রথম আমি ট্যাঙ্ক ও দখলদার সৈন্যদের সামনাসামনি দেখলাম। কয়েক মাস পর, ২০২৪ সালের শুরুতে, আবারও অবরুদ্ধ হলাম। সেবার টানা ৯ দিন অবরোধ ছিল। কোথাও যেতে পারিনি। রাতদিন অবিরাম বোমাবর্ষণ চলেছিল। খাবার ও পানির সংকট দেখা দিল অল্প সময় পরই।

এক পর্যায়ে নরশুরা আমাদের বাড়িতে হামলা চালায় ও তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। তারপর আমাদের রাস্তায় খোঁড়া একটা গর্তে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়। গর্তের চারপাশেছিল দানব ট্যাঙ্ক ও সশস্ত্র সৈন্য। পুরুষদের জামা-কাপড় খুলে নিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে রাখল টানা সাত ঘণ্টা, এই হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যেই। তারপর ওরা আমাদের গাজার দক্ষিণ দিকে ঠেলে দিল। সাথে কিছুই নিতে দিল না। এ বছরের জানুয়ারিতে আমি ও আমার পরিবারই কেবল গাজা শহরে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।
এই স্মৃতিগুলো আজও আমার মনে জীবন্ত—দগদগে ও রক্তাক্ত ক্ষতের মতন তা যেন শরীরে লেপ্টে আছে। ভয় হয়, আবারও হয়তো সবকিছুর পুনরাবৃত্তি হবে।

আমি এসব স্মৃতি ভুলে থাকতে চাই। তাই ফাইনাল পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা শুরু করি। এসাইনমেন্ট প্রস্তুতে ব্যস্ত হবার চেষ্টা করি। কিন্তু আসলে পারি না। কোনোমতেই মন বসে না। বোমার বিভৎস গর্জনে আমার দিশেহারা লাগে। আমি শুধু প্রহর গুণি–এই বুঝি আকাশ কাঁপিয়ে আবারও ছুটে আসছে ভারী বোমা। প্রতি রাতে মনে হয়, আজ রাতেই বুঝি দখলদাররা ঢুকে পড়বে এবং বোমার ঝড় বইয়ে দিবে। ভয়ই এখন আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ভয়টা বুকের ওপর ভারী পাথরের মতন চেপে বসে থাকে।

প্রতিটি সকাল আমার কাছে কেমন মিরাক্যাল মনে হয়। বেঁচে আছি–এটিই যেন এক বিস্ময়। পরিবারের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার উষ্ণতা টের পাই। এখন ‘বেঁচে থাকা’ই হয়ে গেছে সবচেয়ে কঠিন কাজ।

দুর্ভিক্ষ আমাদের জেঁকে ধরেছে। মাসের পর মাস ফল-সবজি, ডিম বা মাংসের দেখা নেই। বাজারে শুধু চিপস, নুডুলস, নিউটেলা আর বিস্কুট– আর কিছু পাওয়া যায় না। প্যাকেটজাত খাবার কেনার সামর্থ নেই। সামান্য চাল, ডাল, আটা পেলেও দাম আকাশছোঁয়া। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জিনিস—বিশেষ করে টিস্যু বা স্যানিটারি প্যাড—মেলে না। ওষুধও প্রায় দুষ্প্রাপ্য। অসুস্থ ও বয়স্করা বিপাকে পড়ে আছেন। পানি আনতেও বহুদূর হেঁটে যেতে হয়। আর গাজার বুকে হাঁটা মানে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। লাকড়িও এখন বিলাসিতা। মাত্র এক কেজি লাকড়ির দাম দুই ডলার বা প্রায় আড়াইশত টাকা। যা দিয়ে কেবল চায়ের পানি গরম করা যায়।

মৃত্যু চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে গাজাকে। ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে এই শহর, সাথে ভেঙে যাচ্ছে আমার ভেতরটাও। জানি না, এইবার বাঁচবো কি না– সত্যিই জানি না। এই দুঃসময়ে কি টিকে যেতে পারবো—এই প্রশ্নের উত্তর নেই। তবে আমি নিশ্চিত, আমি থাকবো এই শহরেই— একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, শেষটা যা-ই হোক না কেন! বাস্তুচ্যুতি হয়তো বেঁচে থাকার সামান্য সম্ভাবনা দেবে। কিন্তু সেটা আমার আত্মাকে মেরে ফেলবে। তা মুছে দেবে আমার স্মৃতি, পরিচয় ও শেকড়।

আমি জানি, গাজায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আত্মহত্যার শামিল। আমি এমন এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, যা আমাদের কাছ থেকে কেউ আশা করে না। দখলদার ইসরায়েল চায় গাজা সিটি ফাঁকা হয়ে যাক। এই শহর নীরব ও জনশূন্য হোক এবং মুছে যাক মানচিত্র থেকে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত অন্তত একটি পরিবারও এই শহর আকড়ে থাকবে। ততদিন বেঁচে থাকবে আমার শহর গাজা।

হুদা স্কাইক

  • গাজা সিটিভিত্তিক ফিলিস্তিনি লেখক
  • হুদা স্কাইক গাজা সিটিতে বসবাসরত একজন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকতাধর্মী লেখক। দ্য ইন্টারসেপ্ট এবং দ্য নিউ অ্যারাব–এ তাঁর লেখালেখি প্রকাশিত হয়েছে ।