মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

সুদানে যেভাবে গৃহযুদ্ধ উসকে দিচ্ছে ইসরায়েল

সুদানের যুদ্ধে ইসরায়েলের ভূমিকা সঠিকভাবে বুঝতে না পারা এবং সে অনুযায়ী কার্যকর পরিকল্পনা নিতে না পারাটাই বড় একটি ভুল।
সুদানে যেভাবে গৃহযুদ্ধ উসকে দিচ্ছে ইসরায়েল । ছবি : মধ্যপ্রাচ্য
সুদানে যেভাবে গৃহযুদ্ধ উসকে দিচ্ছে ইসরায়েল । ছবি : মধ্যপ্রাচ্য

রাজধানী কম্পালায় ইসরায়েলি দূতাবাস থেকে এক বার্তা পাঠানো হয়েছিল তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী লেভি ইশকোলের উদ্দেশ্যে। বার্তায় ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী ইশকোল, তাঁর সরকার ও পুরো ইহুদি জাতিকে  শুভেচ্ছা জানানো হয়। ইহুদীদের সম্বোধন করা হয় ‘ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি’ হিসেবে। তথ্যটি নেয়া হয়েছে দক্ষিণ সুদানের বিদ্রোহী আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জোসেফ লাগোর স্মৃতিকথা থেকে।

রাষ্ট্র পরিচালনায় একজন নেতার দরকার দূরদর্শী ও কৌশলগত চিন্তাভাবনা। দেশ কোন সংকটে আছে, সামনে কী চ্যালেঞ্জ—সেগুলো পরিষ্কারভাবে বোঝার ক্ষমতা থাকতে হয় তাঁর। একই সঙ্গে দেশের ভেতরের পরিস্থিতি ও বৈশ্বিক পরিবেশ বিবেচনায় রেখে গড়ে তুলতে হয় নেতৃত্বের পরিকল্পনা।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে জার্মান দার্শনিক আর্নস্ট হেগেলের একটি মন্তব্য উল্লেখযোগ্য—‘রাজনীতি হচ্ছে প্রয়োগিক জীববিজ্ঞান’। জীববিজ্ঞান যেমন জীব ও পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করে, তেমনি রাজনৈতিক পরিবেশকে বাস্তবিক ভাবে বুঝতে পারলে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তা বাস্তববাদী ও যুক্তিসংগত চিন্তার পথ উন্মুক্ত করে। 

রাজনীতিতে এমন অনেক প্রবণতা আছে, যা দীর্ঘ সময় ধরে আরব মানসজগতে প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী একটি হলো ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’। এই ধারণায় ধরে নেওয়া হয়, সবসময়ই কোনো অদৃশ্য শক্তি আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে যাচ্ছে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে বড় বিপদ হলো—এটি নিজেদের ব্যর্থতা ও দুর্বলতার দায় স্বীকার না করে সবকিছু বাইরের কারও ওপর চাপিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে পরিস্থিতিকে যুক্তির চোখে বিশ্লেষণের বদলে আবেগ, অনুমান আর সন্দেহই প্রধান হয়ে ওঠে।

এভাবে চিন্তার জগতে ‘অতিরঞ্জন বা অবমূল্যায়ন’-এর প্রবণতা তৈরি হয়। বাস্তবতা বোঝার ক্ষমতা হ্রাস পায়। যেমনটা ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ মুখতার আশ শানকিতি।

সুদানে চলমান যুদ্ধ কেন থামছে না—এই প্রতিবেদনে আমরা সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি। বহুদিন ধরে চলতে থাকা এই সংঘাত বিশ্লেষকদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। এখানে আমরা যুদ্ধের পেছনের মূল কারণগুলো তুলে ধরেছি, পাশাপাশি আলাদা করে নজর দিয়েছি সেই অদৃশ্য শক্তিগুলোর দিকে, যারা নীরবে এই সংঘাতকে প্রভাবিত করে আসছে।

তবে আমরা এমন ব্যাখ্যা এড়িয়ে চলব, যা শুধু গুজব বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে সহজ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে বাস্তবতা বুঝে দেখার চেষ্টা করা, যুদ্ধ থামার পথে আসলে কী কী বাধা রয়েছে।

সুদানে সংঘাত শুরু হয়েছে ১৯৫৫ সালে, অর্থাৎ দেশটির স্বাধীনতা ঘোষণার আগের বছর থেকেই। কয়েক দশক ধরে চলা এই সহিংসতার পেছনে বিভিন্ন বিদেশি শক্তির ভূমিকা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে ইসরায়েল। পেছন থেকে নানা ঘটনা উসকে দেওয়া এবং উত্তেজনা ছড়ানোর পেছনে ইসরায়েলের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।

তবে শুধু বাইরের হস্তক্ষেপই দায়ী নয়, সুদানের রাজনৈতিক নেতারাও বড় বড় ভুল করেছেন। মতাদর্শগত বিভাজন ও দলীয় স্বার্থের কারণে দেশের সংকট আরও জটিল হয়েছে।

সুদানের যুদ্ধে ইসরায়েলের ভূমিকা সঠিকভাবে বুঝতে না পারা এবং সে অনুযায়ী কার্যকর পরিকল্পনা নিতে না পারাটাই বড় একটি ভুল। ইসরায়েল শুরু থেকেই সুদানের পরিস্থিতি ও জটিলতা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করেছে এবং তার ওপর ভিত্তি করে একটি কৌশল তৈরি করেছে। এ কৌশলের পেছনে রয়েছে নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ এবং কিছু পুরনো ধর্মীয় বিশ্বাস।

 ইসরায়েলের বিশ্বাস, মুসা আ.-এর পবিত্র তাবুত ইথিওপিয়ার অ্যাকসুম শহরের একটি গির্জায় রয়েছে। পাশাপাশি তারা মনে করে, সুদানে শাসন করা ইথিওপীয় রাজাদের রক্তে সুলায়মান আ.-এর বংশধারার ইহুদি রক্ত প্রবাহিত। আবার, ইসরায়েলের এক হারানো গোত্র আফ্রিকার হ্রদ অঞ্চল ও দক্ষিণ সুদানে বাস করত, যাদের খুঁজে বের করাও জরুরি।

সুদান নিয়ে ইসরায়েলের নীতিমালা সবচেয়ে ভালোভাবে তুলে ধরে ডেভিড বেন গুরিয়নের একটি প্রসিদ্ধ উক্তি, যা আজও তাদের কূটনৈতিক নীতির মূল ভিত্তি।

‘আমরা একটি ছোট জাতি, আমাদের সামর্থ্যও সীমিত। তাই এই সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেই আমাদের আরব দেশগুলোর দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করতে হবে। বিশেষ করে, যেসব দেশে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে টানাপোড়েন আছে, সেসব জায়গায় সেই বিভাজনকে এমনভাবে উস্কে দিতে হবে, যাতে তা একসময় বড় সংকটে রূপ নেয় এবং সমাধান অসম্ভব হয়ে পড়ে।’

এই বক্তব্যই ইসরায়েলের আরব দেশবিষয়ক নীতির মূল ভিত্তি।এখান থেকেই গড়ে ওঠে তাদের একটি নীতি—যার লক্ষ্য হলো আরব দেশগুলোকে ভেতর থেকে দুর্বল করে ফেলা। এই নীতিতে ইসরায়েল চেষ্টা করে, এসব দেশের ভেতরে জাতিগত বিভাজন, গোত্রীয় বিরোধ কিংবা সীমান্তসংক্রান্ত বিরোধকে উসকে দিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে, যাতে দেশগুলো নিজেরাই নিজেদের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে।

আরব দেশগুলো যাতে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকট নিয়েই ব্যস্ত থাকে, এবং তাদের সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যেন ফিলিস্তিনসহ প্রতিরোধকামী অন্য কোনো গোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়াতে না পারে—সেটাই ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য। দক্ষিণ সুদানের সংকট এই নীতির একটি বাস্তব উদাহরণ।

 ইসরায়েলের এই পরিকল্পনা নতুন নয়, বরং বহু পুরনো। ১৯৫৯ সালে মোসাদের তৎকালীন প্রধান মাইর আমিতের একটি বক্তব্যেই তা স্পষ্ট। নতুন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন,

‘আরব জাতীয়তাবাদ তখন আমাদের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছিল। এই হুমকি ঠেকাতে আমাদের লক্ষ্য ছিল—আরব দেশগুলোর ভেতরে থাকা অনারবদের মনে অসন্তোষ আর বিভাজনের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া। বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন আর সুদানে।’

এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, আরব দেশগুলোর ভেতরে জাতিগত বিভেদ বাড়িয়ে তাদের দুর্বল করে রাখা ছিল ইসরায়েলের পুরোনো কৌশল।

 সুদানে অদৃশ্য শক্তিগুলোর ভূমিকা কতটা বিস্তৃত, তা বোঝার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এর মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৮৩ সালে ইসরায়েলের তৎকালীন নেতা অ্যারিয়েল শ্যারনের একটি উপস্থাপনা। ন্যাটো মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে তিনি ‘কিভোনিম’ নামের একটি গোপন নথি উপস্থাপন করেন। ওই নথিতে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে একটি সুপরিকল্পিত রূপরেখা তুলে ধরা হয়।

সুদান নিয়ে সেখানে বলা হয়, ‘আরব ও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বিভক্ত রাষ্ট্র সুদান। এটি চারটি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত, যাদের একে অপরের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বা সামাজিক মিল নেই। একটি সুন্নি মুসলিম আরব সংখ্যালঘু শাসন করছে অনারব সংখ্যাগরিষ্ঠকে—এর মধ্যে রয়েছে পৌত্তলিক, খ্রিস্টান ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী।’

নথির শেষাংশে আরও বলা হয়, ‘লিবিয়া ও সুদান বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো টিকিয়ে রাখতে পারবে না। ভবিষ্যতে তাদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।’

 এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়, ইসরায়েল অনেক আগেই আরব ও আফ্রিকার দেশগুলোকে বিভক্ত করার একটি সুপরিকল্পিত কৌশল হাতে নেয়, যার প্রভাব এখনো চলছে।

 ২০০৮ সালে ইসরায়েলের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আভি ডিখটার দেশটির শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সুদান প্রসঙ্গে বলেন, মিশরের যুদ্ধের সময় সুদান ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। সেখানে মিশরের বিমান ও স্থল বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণ ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। এমনকি ১৯৬৭-১৯৭০ এর দীর্ঘ যুদ্ধের  সময় সুদান সৈন্যও পাঠিয়েছিল সুয়েজ খালে।

ডিখটার বলেন, এ কারণেই ইসরায়েলের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল সুদানকে দুর্বল করে ফেলা, তার নেতৃত্ব ভঙ্গুর করে দেয়া এবং তাকে একটি শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠা থেকে বাধা দেওয়া। তাঁর ভাষায়, এটি ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

বিশ্লেষকদের মতে, এ বক্তব্যে ইসরায়েলের আঞ্চলিক কূটনীতির একটি পুরোনো দিক ফুটে উঠে— যে কোনোভাবেই হোক প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক ও সামরিক সংহতি ভেঙে দেওয়া।

ইসরায়েলের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডেভিড বেন অউজিল (ছদ্মনাম ‘জেনারেল জন’)–এর ‘দক্ষিণ সুদানে মোসাদের মিশন’ (A Mossad Agent in Southern Sudan: 1969–1971 – An Operation Log) এবং মোসাদের অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মোশে ভারজির লেখা ‘ইসরায়েল ও দক্ষিণ সুদান মুক্তি আন্দোলন’ (Israel and the Movement for the Liberation of South Sudan) বইয়ে উঠে এসেছে দক্ষিণ সুদানে ইসরায়েলের গোপন তৎপরতার ভয়াবহ চিত্র।

বই দুটি বলছে, দক্ষিণ সুদানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে ইসরায়েল শুধু রাজনৈতিক নয়, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবেও ব্যাপক সহায়তা করেছে।

বিদ্রোহীদের কাছে একাধিক চালানে অস্ত্র পাঠানো,সামরিক প্রশিক্ষক ও বিশেষজ্ঞ পাঠানো,হাজার হাজার বিদ্রোহী যোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া,সেতু ও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোতে হামলা চালানো,শহর দখল করতে সহযোগিতা করা, উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ব্যাহত করতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়াসহ এমনই আরো নানা কাজে ছিল ইসরায়েলের হাত।

মোশে ভারজি তাঁর বইয়ে দাবি করেছেন, দক্ষিণ সুদানে ইসরায়েলের অভিযান সফল হয়েছিল একাধিক কৌশলগত কারণে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা সঠিক সময়, সঠিক দল এবং সঠিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছি। তাই অভিযান সফল হয়েছে।’ বিভিন্ন নথিপত্র বিশ্লেষণ করে যে চিত্র উঠে আসে, তাতে স্পষ্ট—শুরু থেকেই সুদানকে শত্রু হিসেবে দেখে এসেছে ইসরায়েল। সেই অনুযায়ী সুদানকে দুর্বল করে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে তারা ধারাবাহিকভাবে অগ্রসর হয়েছে।

প্রথমত, সুদানের সরকারের প্রতি আরব বিশ্বের সমর্থন যেন না থাকে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে ইসরায়েল।

দ্বিতীয়ত, জোংলেই খাল প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মিসর ও সুদান বছরে প্রায় পাঁচশ কোটি ঘনমিটার অতিরিক্ত পানি পেত। কিন্তু ইসরায়েল দক্ষিণ সুদানের বিদ্রোহীদের বলে—এই প্রকল্প তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে।

তৃতীয়ত, ইসরায়েল সফলভাবে দক্ষিণ সুদানের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী বোধকে উসকে দেয়, যার ফলে দেশটি একপর্যায়ে উত্তর থেকে আলাদা হয়ে যায়।

সব মিলিয়ে লক্ষ্য ছিল একটাই—সুদান যেন চিরকাল নিজ দেশের ভেতরকার সংকট ও দ্বন্দ্ব নিয়েই ব্যস্ত থাকে। যাতে তারা কখনোই একটি ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে না পারে।

এই নথিপত্র থেকে স্পষ্ট হয়, আরব বিশ্বকে দুর্বল করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইসরায়েল আফ্রিকার অঞ্চলগুলোকে ব্যবহার করেছে।

ইসরায়েলের সাবেক নিরাপত্তামন্ত্রী আভি ডিখটার বলেছেন, ‘সুদান যেন নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ না পায়, তা নিশ্চিত করতেই আমরা দারফুর সংকট তৈরি করেছি এবং সেটিকে আরও জটিল করে তুলেছি। আমাদের এই কৌশল আগে দক্ষিণে প্রয়োগ করা হয়েছিল, এখন পশ্চিমাঞ্চলে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই কৌশলই সুদানের পরিস্থিতিকে সংকট ও বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সুদানে চলমান সংঘাতগুলো এক সময় হয়তো শেষ হবে। তবে সেই সমাপ্তি হবে বিভাজনের মধ্য দিয়ে—সুদান ভাগ হয়ে যাবে একাধিক রাষ্ট্রে বা স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলে।’

সুদানকে ঘিরে ইসরায়েলের পরিকল্পনা সংক্ষেপে কয়েকটি পয়েন্টে উপস্থাপন করা যায়: 

  • মিসরকে দুর্বল করতে তার দক্ষিণের প্রতিবেশী সুদানকে টার্গেট করা। যাতে মিসর কোনো প্রতিবেশীর সহায়তা থেকে কোনোভাবেই উপকৃত না হতে পারে।
  • সুদানের ভেতরে সংঘাতের আগুন জ্বালিয়ে রাখা এবং দেশটির বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ উসকে দেওয়া।
  • সুদান যাতে তার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে একটি কেন্দ্রীয়, শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত না হতে পারে, তা নিশ্চিত করা।

সুদানকে দুর্বল করে রাখার কৌশল হিসেবে ইসরায়েল শুরু থেকেই দেশটিকে ভাঙার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছে। সাবেক ইসরায়েলি নিরাপত্তামন্ত্রী আভি ডিখটার এক বক্তব্যে বলেন, ‘একটি দুর্বল ও খণ্ডিত সুদান আমাদের জন্য অনেক বেশি উপকারী, একটি শক্তিশালী সুদানের চেয়ে।’

শুধু যুদ্ধ বা সংঘাতই নয়, আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও বিভিন্ন সংস্থার প্রভাব ব্যবহার করেও সুদানের ওপর চাপ বাড়িয়েছে ইসরায়েল। দেশটির ওপর অবরোধ আরও কঠোর করতে এবং শ্বাসরোধের পরিস্থিতি তৈরি করতে নানা মাধ্যমে সক্রিয় থেকেছে তারা—এমনটাই উঠে এসেছে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে।

দারফুর সংকটের চরম মুহূর্তে ইহুদি সংগঠনগুলো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ১৮০টির বেশি সংগঠনকে নিয়ে একটি জোট গঠন করে। তাদের লক্ষ্য ছিল—দারফুরে ‘গণহত্যা’ হচ্ছে, এই প্রোপাগান্ডা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। এই কার্যক্রম শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের হলোকাস্ট জাদুঘর থেকে, ‘সেভ ডারফুর’ নামের সংগঠন ও ইহুদি আন্তর্জাতিক সেবাসংস্থার তত্ত্বাবধানে। এসব প্রচেষ্টার পরিণতিতেই সুদানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পৌঁছায়।

বর্তমান যুদ্ধের সূচনা হয় র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF) হঠাৎ সুদানের সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে। এরপর তারা যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন করে বিভিন্ন অবকাঠামো, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য করে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে শুরু করে—লক্ষ্য একটাই, সুদানকে কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে দেওয়া। এই পুরো প্রক্রিয়ায় পর্দার আড়াল থেকে সবচেয়ে সক্রিয় ও প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে ছিল ইসরায়েল।

সুদানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই দেশটিতে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী আব্দাল্লা হামদুকের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘আব্রাহাম চুক্তি’তে সই করার পরপরই খার্তুমকে ঘিরে এই তৎপরতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। মূলত সুদানের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ এবং দেশটিকে ‘ইরানি সেলগুলোর ঝুঁকি’ থেকে দূরে রাখাই ছিল ইসরায়েলের প্রধান লক্ষ্য। ২০২০ সালে খার্তুম সফর শেষে এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা এমন মন্তব্য করেছিলেন।

যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার প্রকৃত উদ্দেশ্য আড়াল করতে ইসরায়েল মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয় সুদান সেনাবাহিনী ও র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (RSF) মধ্যে। সে সময় দেশটির তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেন এক বিবৃতিতে জানান, যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে ইসরায়েল একাধিক চ্যানেলের মাধ্যমে কাজ করছে।

তবে পরবর্তীকালে আর কোথাও এই মধ্যস্থতার প্রসঙ্গ তেমনভাবে ওঠেনি। এটি ইঙ্গিত করে যে, যুদ্ধ থামানোর নয়, বরং উভয় পক্ষকে ক্রমাগত দুর্বল করে দেওয়ার কৌশল নিয়েই অগ্রসর হয়েছে ইসরায়েল। এই পদক্ষেপ কার্যত বাস্তবায়ন করে জায়নিস্ট চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড লুটওয়াকের তত্ত্ব—‘যুদ্ধকে একটা সুযোগ দিন’। অর্থাৎ, সব যুদ্ধ দ্রুত থামিয়ে দেওয়ার চেয়ে অনেক সময় যুদ্ধকে চলতে দেওয়াই অধিক কার্যকর হতে পারে।

ইসরায়েলের সঙ্গে মুহাম্মদ হামদান দাগলো, যিনি হামিদতি নামে পরিচিত, তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের তথ্য এখন একে একে প্রকাশ পাচ্ছে। সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের নিয়মিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে তিনি অনেক আগেই ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ চ্যানেল চালু করেন।

ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম ওয়াল্লার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের জুনে মোসাদ প্রধানের একটি বিমান খার্তুমে অবতরণ করে। ওই বিমানে থাকা মোসাদের কর্মকর্তারা হামিদতি ও র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (RSF) কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন।

যুদ্ধ শুরুর পর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে শিরোনাম ছিল, ‘সুদানের যুদ্ধে কীভাবে জিতবে ইসরায়েল?’ সেখানে বলা হয়, হামিদতি লিবিয়ায় ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসরায়েলকে সহায়তা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি সুদানের সেনাবাহিনীর ভেতরকার ইসলামপন্থী প্রভাব ‘দুর্বল করে দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই ভূমিকার কারণে আরএসএফকে ইসরায়েল সমর্থন দিচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। 

সাম্প্রতিক সময়ে যখন যুদ্ধের পাল্লা সুদানি সেনাবাহিনীর দিকে ভারী হয়েছে এবং মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনী হয়তো খুব দ্রুতই যুদ্ধের মীমাংসা করতে পারবে—ঠিক তখনই ইসরায়েলের ভেতর থেকে অভিযোগ আসতে শুরু করে। দখলদার ইসরায়েলের কিছু রাজনৈতিক মহল দাবি করে, সুদান ইরানের সাথে মিলে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। তারা সরাসরি ইসরায়েলের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানায়। সুদানি সেনাবাহিনীকে ‘আফ্রিকান হামাস’—এমন আখ্যাও দেওয়া হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে সুদানের নেতৃত্বের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা ও সাজানো। যেন যেকোনো বৈরী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা এবং দেশের সম্ভাবনাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। 

এ প্রক্রিয়ায় সুদানের প্রয়োজন তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কার্যকর সহায়তা। বিশেষ করে সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকারের বৈধতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন জরুরি, যার রাজনৈতিক নেতৃত্বে রয়েছেন ড. কামাল ইদরিস। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ধরে রাখার জন্য এমন উদ্যোগ দরকার, যা ষড়যন্ত্রকারীদের অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে পারে।

সূত্র: আল জাজিরা