ইরান-সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ, যে সংগঠন একসময় ইরাক থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ব্যাপক প্রভাব রাখত, এখন সেই প্রভাব একদম তলানিতে।
‘প্রতিরোধ ফ্রন্ট’ নামের ইরানপন্থী জোটের অংশ এই গোষ্ঠীটি লেবাননে রাজনৈতিক দল হিসেবেও সক্রিয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ধাক্কায় হিজবুল্লাহর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। সংগঠনটির একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা নিহত হয়েছেন, সামরিক সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে, একইসঙ্গে আর্থিক ও রসদ সরবরাহেও তৈরি হয়েছে সীমাবদ্ধতা।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে হিজবুল্লাহর প্রভাব হ্রাস পাওয়ার পেছনে পাঁচটি সাম্প্রতিক ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :
যুদ্ধের খেসারত
প্রায় দুই দশক আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা অনিয়মিত এক গোষ্ঠী থেকে হিজবুল্লাহ ধীরে ধীরে পরিণত হয় একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তিতে।
তবে গাজায় ইসরায়েলের বর্বর হামলার প্রতিবাদে হিজবুল্লাহ যখন ‘সংহতিলমূলক হামলা’ চালানো শুরু করে, তখনই বড় ধাক্কা খায় গোষ্ঠীটি। ইসরায়েলের তীব্র হামলায় পরিস্থিতি দ্রুতই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ। যার অবসান ঘটে নভেম্বরে একটি নাজুক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে।
তবে যুদ্ধবিরতির পরও থেমে থাকেনি ইসরায়েল। দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে একের পর এক বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চালানো হচ্ছে—এমনটাই দাবি করছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।
লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলমান সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৪ হাজারের বেশি মানুষ শহিদ হয়েছেন এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ১৪ লাখ মানুষ।
লেবাননে টানা বিমান হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর একাধিক শীর্ষ নেতা ও কমান্ডারকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। নিহতদের মধ্যে ছিলেন সংগঠনটির তিন দশকের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে লেবাননে চালানো এক আলোচিত গোয়েন্দা অভিযানে হাজার হাজার বিস্ফোরকসংযুক্ত ওয়াকি-টকিতে বিস্ফোরণ ঘটায় ইসরায়েল। হিজবুল্লাহ সদস্যদের টার্গেট করার দাবি করা হলেও ওই হামলায় দুই শিশুসহ ৩২ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব, ইতিবাচক সাড়া লেবাননের
দীর্ঘ ছয় বছরের অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত লেবাননের বর্তমান সরকার এবারই প্রথম হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে প্রকৃত আগ্রহ দেখাচ্ছে।
চলতি মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র লেবানন সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে—হিজবুল্লাহকে পুরোপুরি নিরস্ত্র করা হলে ইসরায়েল দক্ষিণ লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে।
লেবাননের প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউনের সাড়া এতটাই ইতিবাচক ছিল যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দূত থমাস ব্যারাক ‘অবিশ্বাস্যভাবে সন্তুষ্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন।
সৌদি আরব সমর্থিত এই মার্কিন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চার মাসের মধ্যে হিজবুল্লাহকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করতে হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ও বিদেশি বিনিয়োগের পথ খুলে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে হিজবুল্লাহ তাদের সামরিক শক্তি হারাবে এবং কেবল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকবে। তখন তারা ১২৮ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টে শিয়াদের জন্য নির্ধারিত ২৭টি আসনে প্রভাব রাখার সুযোগ পাবে।
ইরানের সমর্থন কমে যাওয়ায় চাপের মুখে হিজবুল্লাহ
লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিদের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে এসেছে ইরান। তবে ২০২৫ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের সংঘর্ষের পর মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব স্পষ্টভাবে কমে গেছে, যার বড় প্রভাব পড়েছে হিজবুল্লাহর ওপর।
ইরানের সঙ্গে হিজবুল্লাহর সম্পর্ক এখনো থাকলেও বিশ্লেষকদের মতে, তেহরান এখন দেশের ভেতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই বেশি মনোযোগী। এতে ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে হিজবুল্লাহ অনেকটাই একা হয়ে পড়েছে।
২০২৪ সালের যুদ্ধের সময় ইরান হিজবুল্লাহকে সরাসরি সহায়তা দেয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, এই নিষ্ক্রিয়তাই এখন হিজবুল্লাহকে অস্ত্রত্যাগ নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে।
ইরানের ভূমিকায় অনেক হিজবুল্লাহ-সমর্থক হতাশ। তারা চাইছেন, সংগঠনটি নিজেকে ইরানের প্রতিনিধি না বানিয়ে লেবাননের স্বার্থে একটি জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে গড়ে তুলুক।
সিরিয়ায় সরকার পতনে চাপে হিজবুল্লাহ
তেহরানের আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে হিজবুল্লাহর যে প্রভাব ছিল, সেটিতে বড় ধাক্কা লাগে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। ওই মাসে সিরিয়ার আসাদ সরকারকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসে বিরোধী জোট। প্রতিবেশী সিরিয়া হচ্ছে লেবাননের জন্য ইরাক ও ইরানের সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান পথ।
নতুন প্রেসিডেন্ট আহমাদ আশ শারার নেতৃত্বে সিরিয়া আগের চেয়ে ভিন্ন অবস্থানে যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়ার বর্তমান প্রশাসন ইরানের প্রভাব-বলয়ে থাকবে—এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সীমান্তে কয়েক দফা সংঘর্ষের পর সিরিয়া ও লেবাননের প্রেসিডেন্ট আহমাদ আশ শারা ও জোসেফ আউন সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যৌথভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই পদক্ষেপের ফলে ইরান থেকে হিজবুল্লাহর কাছে সহায়তা পৌঁছানো কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন থেকে ইঙ্গিত মিলছে—নতুন সিরিয়ান সরকার যেভাবে হিজবুল্লাহর বিরোধিতা করছে, তাতে লেবাননে সিরিয়ার প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র হয়তো মেনে নিতে পারে।
হিজবুল্লাহর অর্থের উৎস বন্ধ করতে লেবাননের চেষ্টা
লেবাননের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে, হিজবুল্লাহ যাতে লেবাননের আর্থিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে আবার সংগঠিত হতে না পারে।
এই চুক্তির মাধ্যমে অবৈধ আর্থিক লেনদেন রোধ এবং জালিয়াতি ঠেকানো হবে।
লেবানন এই পদক্ষেপ নিয়ে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা FATF-এর ‘গ্রে লিস্ট’ থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছে। গত বছর এই তালিকায় পড়ার পর বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে, যা ২০১৯ সালের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার পথ বাধাগ্রস্ত করেছে।
সম্প্রতি লেবাননের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশীয় ব্যাংক ও ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানসমূহকে হিজবুল্লাহ-সংযুক্ত একটি আর্থিক সংস্থার সঙ্গে লেনদেন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ ইতিমধ্যে হিজবুল্লাহ সম্পর্কিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, ইরান-সমর্থিত এই সংগঠনসমূহ এসব ব্যাংককে আড়াল করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থায় প্রবেশের চেষ্টা করছে।
রয়টার্সকে এক লেবাননি শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরুতের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছে। এটি হিজবুল্লাহর অর্থনৈতিক শাখার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র লেবাননের সরকারকে সম্পূর্ণভাবে হিজবুল্লাহ নিরস্ত্রীকরণের বিনিময়ে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এই সব কারণে হিজবুল্লাহ এখন আর আগের মতো শক্তিশালী অবস্থানে নেই। আন্তর্জাতিক চাপ, আঞ্চলিক রাজনীতির পরিবর্তন এবং আর্থিক নিষেধাজ্ঞার ফলে সংগঠনটির সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি অনেকটাই কমে গেছে। ভবিষ্যতে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্রীকরণ এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ আরও জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সংগঠনের আদর্শবাদী মনোভাব ও শিয়াদের মধ্যে গভীর প্রভাব থাকার কারণে এই কাজটি সহজ হবে না। তাই মধ্যপ্রাচ্যের এই জটিল পরিস্থিতি আগামীতেও সংকট ও উত্তেজনার কারণ হিসেবে থেকে যাবে।
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড