মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

আবায়া : নজরদারি এড়াতে হামাসের অদ্ভুত কৌশল

জানমাল বাঁচাতে নয়, বরং নজরদারি ড্রোন ও থার্মাল ক্যামেরার চোখ ফাঁকি দিতে এই প্রাচীন ঢিলেঢালা কাপড় পরে ময়দানে নামছেন কাসসামের যোদ্ধারা।
আবায়া : নজরদারি এড়াতেহামাসের অদ্ভুত কৌশল
আবায়া : নজরদারি এড়াতেহামাসের অদ্ভুত কৌশল। ছবি : আল জাজিরা

গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক হামলা চালাচ্ছে হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জুদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড। প্রতিটি অভিযানে বদলে যাচ্ছে কৌশল, বদলাচ্ছে প্রযুক্তি মোকাবেলার ধরনও। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নজরদারি ও লক্ষ্য নির্ধারণ প্রযুক্তি এড়াতে যোদ্ধারা বেছে নিচ্ছেন ভিন্নধর্মী পথ—তার মধ্যে একটি হলো ‘আবায়া’ পরা।

জানমাল বাঁচাতে নয়, বরং নজরদারি ড্রোন ও থার্মাল ক্যামেরার চোখ ফাঁকি দিতে এই প্রাচীন ঢিলেঢালা কাপড় পরে ময়দানে নামছেন কাসসামের যোদ্ধারা।

২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার। তার শহিদ হওয়ার আগে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, মাথা ও শরীরের উপরের অংশ ঢাকা ছিল একটি মোটা কাপড়ে। ধারণা করা হয়, সেটিও নজরদারি এড়ানোর একটি উপায় ছিল।

শরীর ঢাকার আবায়া অনেকের চোখে সাধারণ একখন্ড কাপড় হলেও, গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাছে এটি এখন যুদ্ধকৌশলের অংশ। আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলেছেন বেশ কয়েকজন সামরিক বিশ্লেষক। তাদের মতে, এটি কোনও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ ছিল না —বরং এটি ছিল ইসরায়েলি নজরদারি এড়ানোর কাসসাম যোদ্ধাদের একটি পরিকল্পিত উদ্যোগ।

তারা জানান, এই কাপড় দিয়ে মুখ ও শরীরের উপরের অংশ ঢেকে রাখা হয় মূলত উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি—বিশেষ করে ফেসিয়াল রিকগনিশন, থার্মাল ক্যামেরা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর বিশ্লেষণকে বিভ্রান্ত করতে।

এমন কৌশল ঘিরে সামরিক বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোচনার চলছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি মূলত প্রযুক্তিগত প্রতিরক্ষা—যেখানে নজরদারি এড়ানোই মূল লক্ষ্য। আবার অনেকের মতে, এর ভেতরে প্রতিরোধের এক মনস্তাত্ত্বিক বার্তাও লুকিয়ে আছে।

যুদ্ধের ময়দানে প্রযুক্তির পাল্লা যেমন ভারী হচ্ছে, তেমনি পাল্টে যাচ্ছে প্রতিরোধের ভাষা ও কৌশল। আবায়া এখন শুধু পোশাক নয়, হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের নীরব প্রতীক।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রতিরোধ দমন, গাজাজুড়ে নজরদারির জাল

ইসরায়েলি বাহিনীর নজরদারি যে এখন শুধু নিজেদের প্রযুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তা স্পষ্ট হচ্ছে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো থেকে। গাজার আকাশে ও চারপাশে প্রতিনিয়ত চক্কর দিচ্ছে ড্রোন, আর সেগুলোর পাঠানো তথ্য সংগ্রহ করে কাজে শুধু ইসরায়েলই লাগাচ্ছে না, আন্তর্জাতিক একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও। এসব সংস্থা উন্নত নজরদারি প্রযুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলকে দিচ্ছে নিখুঁত গোয়েন্দা তথ্য।

আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সামরিক বিশ্লেষক, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নিদাল আবু জাইদ বলেন, গাজায় সাম্প্রতিক সময়ে যেসব শীর্ষস্থানীয় নেতা হত্যার শিকার হয়েছেন, তার পেছনে কাজ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি।

তিনি বলেন, ‘প্রতিরোধ যোদ্ধারা এখন খুব ভালো করেই জানে—তাদের চলাফেরা, অবস্থান ও যোগাযোগ সব কিছুই নজরদারির আওতায়। শুধু ইসরায়েল নয়, আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থার চোখও তাদের ওপর। এই গোয়েন্দা নজরদারির বড় অংশটাই পরিচালিত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ড্রোন প্রযুক্তির সাহায্যে।’

ইসরায়েল যে সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ল্যাভেন্ডার’। এই সফটওয়্যার মানুষের শরীরের গঠন—যেমন উচ্চতা, প্রস্থ ও আকার—বিশ্লেষণ করে লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করে। এর সঙ্গে রয়েছে আরও কিছু প্রযুক্তি, যা শরীরের তাপমাত্রা ও বায়োমেট্রিক সিগনেচার ধরতে সক্ষম।

আবু জাইদ বলেন, এসব সফটওয়্যার প্রতিরোধযোদ্ধাদের শারীরিক গঠন বিশ্লেষণ করে তাদের অবস্থান চিহ্নিত করে। তাই এই নজরদারি এড়াতে প্রতিরোধযোদ্ধারা এমন ছদ্মবেশ বা আড়াল ব্যবহার করেন, যা শরীরের প্রকৃত গঠন বদলে দেয়। এতে করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে সঠিকভাবে লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, ‘এই সফটওয়্যারগুলো একবার কোনো ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করলে তা সংরক্ষণ করে রাখে। পরবর্তী সময়ে সেই ব্যক্তি অন্য কোনো এলাকায় ধরা পড়লে দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তাই নিজের পরিচয় গোপন রাখতে শরীরের আকৃতি বদলে দেওয়া এখন প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ কৌশল।’

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ফাঁকি দেওয়ার ছদ্মবেশ

প্রতিরোধযোদ্ধারা যে বিশেষ ছদ্মবেশ ব্যবহার করছেন, তা শুধু শরীর ঢাকার জন্য নয়—এর রয়েছে কৌশলগত গুরুত্ব। আল জাজিরাকে দেওয়া এক বিশ্লেষণে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান জুনি বলেন, মাথা ও কাঁধ ঢেকে রাখার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ সফটওয়্যার প্রধানত এই অংশগুলোর ভিত্তিতেই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে।

জুনি জানান, এই ছদ্মবেশ তৈরি হয় এমনভাবে, যাতে তা ধ্বংসস্তূপ ও ধুলোময় পরিবেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। এজন্য ব্যবহার করা হয় ম্লান রঙের, আলো প্রতিফলন না করে এমন কাপড়—যাতে অপটিক্যাল ক্যামেরা কিংবা তাপমাত্রা শনাক্তকারী সেন্সরে ধরা না পড়ে।

এই পোশাক সাধারণ নয়, বরং নমনীয় ও বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী। এটি শরীরে পরার পাশাপাশি ব্যবহার করা যায় আশ্রয়স্থল বা ধ্বংসস্তূপের নিচে লুকাতে গিয়ে। কিছু কাপড় আবার বিশেষভাবে তাপনিরোধী, যা শরীরের তাপমাত্রা আড়াল করে রাখে—ফলে ইসরায়েলি বাহিনীর থার্মাল সেন্সরেও প্রতিরোধযোদ্ধাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

প্রতিরোধের প্রতীক

বিশেষ ছদ্মবেশকে কেবল শারীরিক নিরাপত্তার দিক থেকে নয়, একটি প্রতীকী ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সামরিক বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফায়েজ আদ দুওয়াইরি।

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, প্রতিরোধ সংগ্রামের এক বিশেষ প্রতীকে পরিণত হয়েছে এই ছদ্মবেশ। বিশেষ করে তখন, যখন শহীদ ইয়াহিয়া সিনওয়ার জীবনের শেষ প্রহরে এটি পরে সম্মুখসারিতে থেকে প্রতিরোধে অংশ নিয়েছিলেন—পিছু হটেননি একটুও।

দুওয়াইরির মতে, যোদ্ধারা এই প্রাথমিক কৌশল বেছে নিয়েছেন দুটি কারণে। এক, প্রতীকী অর্থে এটি এখন আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি। দুই, বাস্তব বিবেচনায় এটি মুখ, চোখের বায়োমেট্রিক ছাপ এবং শরীরের গঠন গোপন রাখতে সাহায্য করে—যা এখন আরও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে, কারণ ইসরায়েলির বাহিনী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে।

সর্বশেষ