মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

৪০ বছর পর যেভাবে স্বাধীনতার অস্ত্র পুড়িয়ে ফেলল পিকেকে

সিনেমার মতো মুহূর্তটি শেষ হতেই ভেঙে গেল ঘন হয়ে জমে থাকা উত্তেজনার আবরণ। আশপাশের পরিবেশ হঠাৎই হালকা হয়ে উঠল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইউরোপ, তুরস্ক ও সিরিয়ার রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকেরা।
অস্ত্র পুড়িয়ে পিকেকের আত্মসমর্পণ : চার দশকের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি
অস্ত্র পুড়িয়ে পিকেকের আত্মসমর্পণ : চার দশকের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি। ছবি : আল জাজিরা

আমরা তুরস্ক থেকে আসা একদল সাংবাদিক, সকালে খুব ভোরে রওনা দিয়েছিলাম ইরাকের উত্তরাঞ্চলের কুর্দিস্তান অঞ্চলের শহর আরবিল থেকে। উদ্দেশ্য নিজ চোখে দেখা, কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) কীভাবে তাদের অস্ত্র পুড়িয়ে ফেলছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে চাইছিলাম আমরা।

আরবিল ছাড়িয়ে যখন সুলাইমানিয়ার সীমানায় পৌঁছালাম, তখনই চোখে পড়ল দূরের পাহাড়ঘেরা প্রাকৃতিক দৃশ্য—কন্দিল পর্বতমালা। নামটা অনেকের কাছে অপরিচিত লাগলেও, আমাদের তুর্কিদের কাছে কন্দিল একটি চেনা আতঙ্কের নাম। প্রায় চার দশক ধরে তুরস্কে পিকেকে যেকোনো হামলা চালালে বলা হতো, এটা এসেছে কন্দিল থেকে। তুরস্কের যুদ্ধবিমান নিয়মিত বোমাবর্ষণ করত এই এলাকাতেই।

তবে নিজের চোখে কন্দিল দেখার পর বুঝলাম, আমার এতদিনকার ধারণা ছিল ভুল। এতদিন মনে করতাম কন্দিল একটি একক পাহাড়, কিন্তু সামনে গিয়ে দেখলাম—এটা আসলে বিশাল, দুর্গম আর সুউচ্চ এক পর্বতমালা, যার বিস্তৃতি সুলাইমানিয়া থেকে ইরানের গভীরে পর্যন্ত।

এলাকার একজন প্রবীণ জানালেন, এই পাহাড়ের গভীরে রয়েছে শত শত গুহা, সুড়ঙ্গ আর লুকানো পথ—যেগুলো এতই গভীর ও দুর্গম যে সেখানে যুদ্ধবিমানের বোমাও পৌঁছাতে পারে না। এই পর্বতমালার গর্ভেই ছিল পিকেকে-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি, তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবস্থান, অস্ত্রাগার এবং যোদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্র।

তুরস্ক সীমান্ত ঘেঁষা উত্তরাঞ্চলে ধারাবাহিক সামরিক অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু এলাকা, বিশেষ করে পিকেকে-র অন্যতম ঘাঁটি জাপ অঞ্চলকে নিরাপদ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্বের কন্দিল অঞ্চল ছিল অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এবং আজ, আমরা ধীরে ধীরে গাড়িতে চড়ে সেই কন্দিলের পথেই এগিয়ে চলেছি—যেখানে ইতিহাসের এক মোড় বাঁক নিতে চলেছে।

প্রধান সড়ক থেকে যখন আমরা পূর্বদিকে, কন্দিল পাহাড়ের পাদদেশের দিকে মোড় নিলাম, মুহূর্তেই বদলে গেল চারপাশের পরিবেশ। রাস্তার দুই পাশে ও উঁচু জায়গাগুলোতে মুখোশ পরা, বিশেষ পোশাক ও হাতে প্রস্তুত অস্ত্র থাকা লোকজনের উপস্থিতি টের পাওয়া গেল। তারা ছিল আসাইশ সদস্য, সুলাইমানিয়ায় কুর্দিস্তান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (তালাবানি পার্টি)-এর নিরাপত্তা বাহিনী।

পুরো কন্দিলগামী রাস্তাজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ছিল কঠোরতা ও সতর্কতা: সাঁজোয়া যান, ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সামরিক গাড়ি, আর শত শত মুখোশধারী সেনা এলাকাটি ঘিরে রেখেছিল।

মধ্যপ্রাচ্য

পরিস্থিতিতে ছিল টানটান উত্তেজনা। কারণ, এলাকাটি প্রস্তুত হচ্ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হতে—একটি সশস্ত্র সংগঠন তাদের অস্ত্র পুড়িয়ে বিশ্ববাসীর সামনে ঘোষণা করবে, তারা আর সশস্ত্র লড়াই চালাবে না।

এই সংগঠনটি হলো পিকেকে—কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি—যা বিগত ৪০ বছর ধরে এক আঞ্চলিক সংকটের উৎস ছিল এবং যার কারণে প্রাণ গেছে হাজারো মানুষের।

আর আমরা তখন কাঁচা, ধুলোমলিন এক পথ ধরে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলেছি সেই স্থানের দিকে, যেখানে পিকেকে তাদের দীর্ঘ ৪০ বছরের সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করতে যাচ্ছে।

এক গুহায় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলাম

আমাদের গাড়িগুলো থামল কন্দিল পাহাড়ের পাদদেশে, এক আধা-পর্যটন এলাকায়—যার নাম ‘জাসানা গুহা’। এই গুহা দুকান শহরের সীমানার ভেতরে, কানিখান গ্রাম সংলগ্ন। ইতিহাস বলছে, ১৯২৩ সালে এখানেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ মাহমুদ হাফিদ। সেই গুহাই আজ রূপ নিয়েছে পর্যটকদের আগ্রহের জায়গায়।

সেখানে তৈরি করা হয়েছিল একটি খোলা মঞ্চ, প্রায় ৩০০ জন বসার ব্যবস্থা। সামনের সারিতে ছিল সারিবদ্ধ চেয়ার, পেছনে চারজনের জন্য একটি টেবিল, আর তার পেছনে একটি বড় প্রজেক্টর স্ক্রিন। মঞ্চের পাশে রাখা হয়েছিল একটি বিশাল ধাতব পাত্র, ভর্তি কাঠ আর পেট্রোল দিয়ে ভেজানো—সেখানেই পুড়িয়ে ফেলা হবে অস্ত্র।

অতিথিরা যখন বসে পড়লেন, চারপাশে টানটান উত্তেজনা। কেউ যেন উসকানি না দেয়, কোনো বিশৃঙ্খলা না ঘটে—এই আশঙ্কা থেকেই ছিল অতিরিক্ত সতর্কতা। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল কুর্দি স্বশাসিত অঞ্চলের ‘আসায়েশ’ বাহিনী, আর গোটা আয়োজনের পেছনের নিয়ন্ত্রণে ছিল তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা। উপস্থিত ছিলেন বাগদাদ ও এরবিল থেকে আসা সরকারি প্রতিনিধি। তুরস্ক চাচ্ছিল, এই সিদ্ধান্ত যেন বাগদাদ, এরবিল এবং আঙ্কারার যৌথ অবস্থানের প্রতিফলন হয়।

গুহার পাথরের সিঁড়ি বেয়ে একে একে বেরিয়ে এলেন পার্টির যোদ্ধারা। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল নিস্তব্ধতা। সঙ্গে সঙ্গো উল্লাস আর করতালিতে ফেটে পড়ল সবাই। মঞ্চে উঠলেন ১৫ জন নারী ও ১৫ জন পুরুষ—সবার পরনে একরকম পোশাক, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। নেতৃত্বে ছিলেন পার্টির শীর্ষ নেত্রী বসে হোজাত। সবুজ সামরিক পোশাকে তিনি ছিলেন দৃঢ় ও স্পষ্ট। পরিচিত ছিলেন তাঁর কঠোর অবস্থানের জন্য—অস্ত্র ছাড়ার পক্ষে ছিলেন না কখনো। কিন্তু দলের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ ওজালান তাঁকেই বিবৃতি পাঠের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

হোজাতের পাশে বসেন আরও তিনজন, আর পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন বাকি যোদ্ধারা। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ওজালানের ছবি। এরপর হোজাত তুর্কি ভাষায় বিবৃতি পাঠ শুরু করেন— নেতা আবদুল্লাহ ওজালানের আহ্বানে এবং আমাদের স্বাধীন ইচ্ছায়, আমরা আপনাদের সামনে আমাদের অস্ত্র ধ্বংস করছি।

তারপর একই বক্তব্য পাঠ করা হয় কুর্দি ভাষায়।

আবার বেজে ওঠে করতালি, উচ্ছ্বাসে ভরে যায় চারপাশ। কারও কারও চোখে জল। ইতিহাসের এক অনন্য মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকলাম আমরা।

এক অধ্যায়ের সমাপ্তি, শুরু নতুন পথের

পার্টির সব যোদ্ধা একসারিতে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বড় ধাতব হাউজের দিকে। সবার আগে হোজাত তার অস্ত্র ফেলে দিল হাউজে, তারপর একপাশে সরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখল—তার সহযোদ্ধারা একে একে নিজেদের অস্ত্র জমা দিচ্ছে। কারও হাতে কালাশনিকভ, কারও কাছে রকেট লঞ্চার, কেউ রাখল ভারী মেশিনগান, আবার কেউ স্নাইপার রাইফেল।

যখন সব অস্ত্র জমা পড়ল, হোজাত এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক যোদ্ধার হাতে দেওয়া হলো জ্বলন্ত দুটি কাঠি। তারা সেই আগুন দিয়ে হাউজে রাখা কাঠ আর পেট্রোলে আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রথমে আগুন ভালোভাবে জ্বলে নি, ফলে আরও পেট্রোল ঢালা হয়। একসময় আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, তখন দৃশ্যটা হয়ে ওঠে তীব্রভাবে প্রতীকী। আগুনে গলে যাচ্ছে অস্ত্রগুলো, শিখার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে উঠছে রাইফেলের নল, যেন তা বলছে—একটি যুদ্ধের পর্দা টানা হলো, শুরু হচ্ছে নতুন এক অধ্যায়।

এরপর এক যোদ্ধা এগিয়ে গিয়ে কাছের টেবিলে একটি কাগজ জমা দেয়। আমি জানতে চাইলাম, ওই টেবিলে কারা ছিলেন। জানানো হলো—একটি টেবিলে ছিলেন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা, আরেকটিতে বসে ছিলেন বাগদাদ সরকারের কর্মকর্তা, কুর্দিস্তানের জাতীয় ইউনিয়ন ও কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যরা। যে কাগজটি জমা দেওয়া হয়েছিল, সেখানে পোড়ানো সব অস্ত্রের নাম ও নম্বর তালিকাভুক্ত ছিল। এই তালিকার একটি অনুলিপি তুলে দেওয়া হয় তুরস্কের নিরাপত্তা সংস্থার হাতেও।

সবশেষে, ৩০ জন যোদ্ধা কোনো কথা না বলে একে একে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায়। তারা আর ফিরে তাকায় না।

সব যেন নাটকীয়

সিনেমার মতো মুহূর্তটি শেষ হতেই ভেঙে গেল ঘন হয়ে জমে থাকা উত্তেজনার আবরণ। আশপাশের পরিবেশ হঠাৎই হালকা হয়ে উঠল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইউরোপ, তুরস্ক ও সিরিয়ার রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকেরা, সঙ্গে ছিলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও। সবার মুখেই ছিল এক গভীর আবেগের ছাপ যেখানে আশা, বিস্ময় ও অনিশ্চয়তা একে অপরের সঙ্গে মিশে ছিল।

ঘটনার ছবি ও ভিডিওর প্রথম ফুটেজ যখন তুরস্কে পৌঁছায়, সঙ্গে সঙ্গে দেশটির প্রধান প্রধান সংবাদ চ্যানেলগুলো স্বাভাবিক সম্প্রচার থামিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরি সম্প্রচারে চলে যায়। শুধু তুরস্কেই নয়, এই দৃশ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও—বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে এই ঘটনা।

সশস্ত্র সংগঠনের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথমবার, যখন প্রকাশ্য ও প্রতীকী উপায়ে এভাবে অস্ত্র পুড়িয়ে ফেলা হলো।
আমার পাশে বসা সংঘাত ও শান্তি বিষয়ক কয়েকজন নাগরিক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বললেন—তারা কখনও এমন দৃশ্য কল্পনাও করেননি।

সবকিছু দেখে স্পষ্ট ছিল—এই যোদ্ধারা আর অস্ত্র হাতে ফিরবেন না, আর ফিরে যাবেন না কন্দিল পাহাড়ের গুহা কিংবা ঘাঁটিগুলোতে।
ঘোষণা অনুযায়ী, তারা এখন থেকে সুলায়মানিয়াহ শহরে বেসামরিক জীবন শুরু করবেন।

প্রকাশিত বিবৃতিতে জানানো হয় এই দলটি নতুনভাবে যাত্রা শুরু করছে ‘Community Group for Peace and Democracy’ নামে। সশস্ত্র লড়াইয়ের পথ ছেড়ে তারা এখন সমাজ ও রাজনীতির শান্তিপূর্ণ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

তুরস্কে পিকেকে সদস্যদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সংসদীয় কমিটি

পিকেকে বা কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) অস্ত্র পোড়ানোর ঘোষণাকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। জাতিসংঘ, তুরস্ক, ইরাক, ইরান, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

তুরস্কে এখন এ প্রক্রিয়া নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তুতি চলছে। এই কমিটি পিকেকে যোদ্ধারা যারা অস্ত্র ফেলে শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরতে চায়—তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তারা কি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে, নাকি তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে—এই প্রশ্নের জবাব দেবে এই কমিটি।

সংসদের স্পিকার নুমান কুরতুলমুশ কমিটি গঠন ও এর কার্যক্রম সরাসরি তদারকি করবেন। এই পর্যায়ে এসে পুরো প্রক্রিয়াটি এখন স্পষ্ট রাজনৈতিক রূপ নিচ্ছে। আইনগত কাঠামোর ভেতরে, সংসদীয় আলোচনার মাধ্যমেই এর পরবর্তী ধাপ ঠিক হবে।

সর্বশেষ