‘সিরিয়া কারও জন্য হুমকি নয়—না আঞ্চলিকভাবে, না বৈশ্বিকভাবে, এমনকি ইসরায়েলের জন্যও না।’
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রথম ভাষণে এমন মন্তব্য করেন সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসআদ আশ শাইবানি। ২৫ এপ্রিল দেওয়া ওই বক্তব্যে তিনি দখলদার ইসরায়েলকে সিরিয়ার দখলকৃত অঞ্চল থেকে সরে যেতে বাধ্য করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
তবে সিরিয়ার এমন কূটনৈতিক বার্তার জবাবে উল্টো আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে ইসরায়েল। দেশটির চরম ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেত্সালেল স্মোত্রিচ সাফ জানিয়ে দেন, গাজা যুদ্ধের ইতি টানতে হলে সিরিয়ার অবকাঠামো ধ্বংস করতে হবে। এর আগে এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন কংগ্রেসম্যান মার্লিন স্টুটজম্যান মন্তব্য করেন, ইসরায়েল সিরিয়াকে একাধিক ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত করার পরিকল্পনা করছে, যা নিয়ে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমাদ আশ শারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
দখল ও বিভাজনের কৌশল
বাশার আল আসাদের পতনের পর সিরিয়ার সবচেয়ে বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে ইসরায়েল। কথিত ‘প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা’ নীতির অংশ হিসেবে দক্ষিণ সিরিয়ায় বাফার জোন গঠনের পাশাপাশি গোলান মালভূমিতে দখলদারত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
নতুন প্রশাসনের শাসনব্যবস্থা দুর্বল করতে ইসরায়েল নিয়মিতভাবে সিরিয়ার সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব হামলায় টার্গেট করা হচ্ছে গবেষণা কেন্দ্র, বিমানঘাঁটি এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। একই সঙ্গে দেশটির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ—দারা, কুনেইত্রা ও সুইদা—বেসামরিকীকরণের দাবি তুলেছে তেলআবিব।
বাস্তবতা হলো, ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ সিরিয়ায় নিয়মিতভাবে অনুপ্রবেশ করে আসছে। ১৯৭৪ সালের যুদ্ধ শেষে সিরিয়া-ইসরায়েলের মধ্যে যে শান্তিচুক্তি অনুযায়ী একটি ‘বিরোধমুক্ত অঞ্চল’ গঠিত হয়েছিল, তার বড় অংশ এখন কার্যত ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসহাক কাটস ঘোষণা দেন, ইসরায়েলি বাহিনী জাবাল আশ শাইখ পর্বতের চূড়া এবং নতুন দখল করা অঞ্চলগুলো থেকে সরবে না। এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন, দামেস্কের দক্ষিণে সিরিয়ার নতুন সেনাবাহিনী যেন প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করবে ইসরায়েল।
ভাঙনের বীজ
ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জোরদার করতে আঞ্চলিক শক্তিশালী মিত্রের সহযোগিতা চেয়েছিল সিরিয়া। সেই লক্ষ্যেই তুরস্কের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দামেস্ক। প্রস্তাব ছিল, মধ্য সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বসানো।
কিন্তু এই উদ্যোগ থামিয়ে দিতে ২ এপ্রিল সিরিয়ার মধ্যাঞ্চলে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। লক্ষ্য ছিল সামরিক বিমানবন্দরগুলো। হামায় একটি বিমানবন্দর পরিদর্শনে থাকা তিনজন তুর্কি প্রকৌশলী এ হামলায় নিহত হন। এই হামলার মধ্য দিয়ে সিরিয়া-তুরস্কের সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা সহযোগিতার পথ রুদ্ধ করে দেয় দখলদার ইসরায়েল।
এরপর আরও এক ধাপ এগিয়ে, বিভেদের পুরোনো কৌশল কাজে লাগিয়ে সিরিয়ার জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক বৈচিত্র্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ভাঙনের বীজ বপনের চেষ্টা চালায়।
৩০ এপ্রিল, দক্ষিণ দামেস্কের জারমানা শহরে সিরীয় গোয়েন্দা বাহিনী যখন দ্রুজ সম্প্রদায়ের কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত, ঠিক তখনই তাদের ওপর হামলা চালায় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। হামলার পর তেলআবিব দাবি করে, তারা সংখ্যালঘু দ্রুজদের রক্ষা করছে।
এই উত্তেজনা থামাতে সিরীয় নিরাপত্তাবাহিনী দক্ষিণ দামেস্কে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে শুরু করে। কিন্তু ২ মে ফের একবার হামলা চালায় ইসরায়েল, এবার রাজধানী দামেস্কের প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের কাছাকাছি এক এলাকায়। এ হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল বার্তা দেয়—দক্ষিণ দামেস্কে সিরীয় বাহিনীর উপস্থিতি তারা কিছুতেই মেনে নেবে না।
বৃহত্তর সমঝোতার পথে
সিরিয়ার দক্ষিণ সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এখন কেবল দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কিংবা সীমিত চুক্তির মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। বিষয়টি ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণ লেবানন পর্যন্ত—যেখানে দৃশ্যমান হচ্ছে সিরিয়া-লেবাননের মধ্যে একটি বৃহত্তর সমঝোতার ইঙ্গিত।
সম্প্রতি আবারও সামনে এসেছে সিরিয়া-লেবাননের স্থলসীমান্ত চিহ্নিতকরণ নিয়ে আলোচনা। আলোচনায় বারবার উঠে আসছে শেবা খামারের প্রশ্ন—যেটি বর্তমানে ইসরায়েলের দখলে রয়েছে। এই ভূখণ্ড লেবাননের নয়, বরং সিরিয়ার অংশ—এমন দাবিতে সরব হয়েছেন লেবানের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা যেমন—ওয়ালিদ জুমব্লাত।
এই প্রেক্ষাপটে যদি ইসরায়েল শেবা খামারকে সিরিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকার করে, তবে হিজবুল্লাহর হাত থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও আইনি অজুহাত কেড়ে নেওয়া সম্ভব হবে। কারণ, এ ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করেই সংগঠনটি ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ চালানোর বৈধতা দাবি করে আসছে।
তাৎক্ষণিক শান্তি ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি
ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এখন সিরিয়ার জন্য একটি বাস্তবিক বাধ্যবাধকতা। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপে সংকটাপন্ন দেশটি আপাতত বিরোধ নয়, বরং স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিতে চাইছে। তবে এই কৌশলগত নমনীয় অবস্থান দীর্ঘমেয়াদে সিরিয়ার জন্য আরও গভীর সংকট তৈরি করতে পারে।
সিরিয়ার কূটনৈতিক ভাষ্য কিংবা সরকারি বার্তায় এখন আর ইসরায়েলকে ‘দখলদার’ শক্তি হিসেবে সরাসরি চিহ্নিত করা হচ্ছে না। বরং সরকারি গণমাধ্যম, লেখক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় বহু সিরীয় নাগরিক এখন ইরানবিরোধিতার আড়ালে ইসরায়েলের সঙ্গে বিরোধকে গুরুত্বহীন করে তুলছেন।
এই মনোভাবের প্রভাব পড়ছে জনগণের মনোজগতেও। ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতি প্রতিরোধমূলক আবেগ ও সচেতনতা দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলের জন্য সিরিয়ায় গুপ্তচর ও সহযোগী নিয়োগ অনেক সহজ হয়ে যেতে পারে।
শুধু তাই নয়, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্ভাব্য সমঝোতা সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বড় একটি অংশ এমন সম্পর্ককে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখবে। এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদী আইএস গোষ্ঠী নিজেদের আদর্শিক অবস্থান থেকে আরও রূঢ় ও সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
এই জটিল প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলও আপসের পথে হাঁটছে না। ইরানের সঙ্গে সাম্প্রতিক যুদ্ধের পর তেলআবিব এখন আঞ্চলিকভাবে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। ফলে সিরিয়ার নতুন প্রশাসন, বিশেষত প্রেসিডেন্ট আহমাদ শারার নেতৃত্বে যে শান্তিপ্রচেষ্টা চলছে, তা হয়তো ইসরায়েলি ঔদ্ধত্যের সামনে কোনো ফলই আনতে পারবে না—বরং পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কাই বেশি।
সূত্র: আমাদ