ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ জানিয়েছে, তারা সিরিয়ায় কর্মরত আলোচিত গুপ্তচর এলি কোহেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আড়াই হাজারের বেশি নথি ও কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সংগ্রহ করেছে। গত ১৮ মে ২০২৫ এক বিবৃতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় জানায়, আর্কাইভটিতে প্রায় ২,৫০০টি নথি, ছবি ও ব্যক্তিগত সামগ্রী রয়েছে। উদ্ধার হওয়া সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে দামেস্কে কোহেনের ব্যবহৃত অ্যাপার্টমেন্টের চাবি, জাল পাসপোর্ট, পরিবারের কাছে পাঠানো চিঠিপত্র এবং শীর্ষস্থানীয় সিরীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে তোলা তার বেশ কিছু ছবি।
কোহেন ১৯৬০-এর দশকে সিরিয়ায় মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন। ১৯৬৫ সালে দামেস্কে তাকে গ্রেপ্তার করে সিরীয় কর্তৃপক্ষ। পরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কোহেনের মৃত্যুপরবর্তী স্মৃতি ও তার মরদেহ খুঁজে পেতে ইসরায়েল বহু বছর ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ইসরায়েলে তার জীবন ও কর্মকাণ্ড ঘিরে এখনও ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।
কে এই এলি কোহেন?
এলি কোহেন জন্মেছিলেন ১৯২৪ সালে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। তার পরিবার ছিল সিরিয়ার হালব (আলেপ্পো) থেকে আসা এক ইহুদি বংশোদ্ভূত। পরবর্তীতে তারা ইসরায়েলে পাড়ি জমান। ২০ বছর বয়সে তিনি যোগ দেন জায়নবাদী আন্দোলনে। এরপর ‘আব্রাহাম দার’-এর নেতৃত্বাধীন এক ইসরায়েলি গুপ্তচর নেটওয়ার্কে সক্রিয় হন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে তিনি গোপনে মিসরের ইহুদি পরিবারগুলোকে ইসরায়েলে পাচারে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে মিসরে ‘লাভন কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত এক ঘটনায় তার নাম উঠে আসে। ওই সময় একটি ইসরায়েলি গোয়েন্দা চক্র মিসরে মার্কিন ও ব্রিটিশ স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে।
গুপ্তচরের পথে যাত্রা
১৯৫৭ সালে এলি কোহেন মিসর থেকে ইসরায়েলে চলে যান। সেখানে কিছুদিন বিভিন্ন পত্রিকায় অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্বল্প সময় কাজ করার পর তাকে গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদে নিয়োগ দেওয়া হয়। সিরিয়াতে এলি কােহেনকে স্থায়ীভাবে স্থাপন করার লক্ষ্যে মোসাদ একটি সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনা নেয়। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৬১ সালে কোহেনকে পাঠানো হয় আর্জেন্টিনায়। সেখানে তিনি ছদ্মনাম গ্রহণ করেন—‘কামাল আমিন সাবিত’। নিজেকে তিনি একজন মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেন, যার পরিবার বৈরুতে বসবাস করার পর আলেকজান্দ্রিয়ায় স্থায়ী হয়েছিল। আর্জেন্টিনায় কোহেন ধীরে ধীরে সিরীয় ও লেবানিজ প্রবাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেন। তিনি নিয়মিত অংশ নেন আরব প্রবাসীদের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে একজন সিরীয় ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন, যিনি নিজ দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করেন।
দামেস্কে কোহেনের আগমন
১৯৬২ সালের ১০ জানুয়ারি এলি কোহেন ইতালির জেনোয়া থেকে দামেস্কে পৌঁছান। তার সঙ্গে ছিলেন মাজেদ শেখ আল-আরদ নামের এক ব্যক্তি। ইসরায়েলি বিভিন্ন প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, শেখ আল-আরদ ছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর (CIA) একজন কর্মকর্তা। দামেস্কে কোহেন অভিজাত আবু রুমানা এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন। ওই এলাকায় সে সময় সিরীয় সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয়, রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা ও বেশ কয়েকটি দূতাবাস অবস্থিত ছিল। সেখানে বসবাস করতেন ধনাঢ্য ব্যক্তি ও উচ্চপদস্থ সিরীয় কর্মকর্তারা। দামেস্কে পৌঁছানোর প্রায় দুই মাস পর কোহেন মোসাদের সঙ্গে প্রথমবার যোগাযোগ করেন। একটি বার্তার মাধ্যমে তিনি জানান, সেখানে নিজের থাকার জন্য একটি বাসস্থান পেয়েছেন।
সামরিক ঘাঁটি থেকে রেডিও অনুষ্ঠান—দামেস্কে প্রভাব বিস্তার
ইসরায়েলি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দামেস্কে অবস্থানকালে এলি কোহেন স্থানীয় উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি তাদের বাসায় অতিথি হয়ে যেতেন; এমনকি কিছু সাংবাদিকের সঙ্গেও তার সখ্য গড়ে ওঠে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কোহেন নিয়মিত গোলান ফ্রন্ট পরিদর্শনে যেতেন এবং সেখানে সিরিয়ার সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার খুঁটিনাটি সম্পর্কে অবগত হতেন। এ ছাড়া তিনি সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় রেডিওর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবেও উপস্থিত হতেন। তবে কোহেনকে ঘিরে সন্দেহের কথাও উঠে এসেছে কয়েকটি সূত্রে। বলা হয়, তিনি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মিশুক ও ‘বিপ্লবী মনোভাবের’ ছিলেন। তার অসংখ্য সামরিক কর্মকর্তা ও বাথ পার্টির সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অন্যদের দৃষ্টিগোচর হয়। পাশাপাশি, নিজেকে ব্যবসায়ী দাবি করলেও তিনি অত্যন্ত মিতব্যয়ী ছিলেন, যা তার পরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না
প্রতি সপ্তাহে দুই বার্তা, তিন বছরে গোয়েন্দা তৎপরতা
ইসরায়েলি বিভিন্ন সূত্রের দাবি, দামেস্কে অবস্থানকালে এলি কোহেন নিয়মিত ইসরায়েলে গোপন বার্তা পাঠাতেন। প্রায় তিন বছর ধরে তার এই তৎপরতায় প্রতি সপ্তাহে গড়ে দুটি করে বার্তা পাঠানো হতো। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৬৪ সালের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ মাসে কোহেন মোট ১০০টি বার্তা পাঠান। এসব বার্তায় ছিল সিরিয়ার মন্ত্রিসভার বৈঠক, সামরিক ও বাথ পার্টির শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের তথ্য, এমনকি কুনেইত্রায় সেনাবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কেও বিস্তারিত বিবরণ।
ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী, কোহেনকে সিরিয়ায় পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল একজন নাৎসি কর্মকর্তা লুইস ব্রুনার এবং তাঁর সহকারী অ্যাডলফ আইখমানের গতিবিধি অনুসরণ করা। তবে ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে, ৮ মার্চের সামরিক অভ্যুত্থানের পর সিরিয়ায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে। এই পটপরিবর্তনের পর কোহেনকে তেলআবিবে ডেকে পাঠানো হয় এবং তার দায়িত্ব পুনর্নির্ধারণ করা হয়। তখন তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়—সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ক্ষমতাকেন্দ্রে বিভাজন এবং বাথ পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলো নজরদারির আওতায় আনতে।
গ্রেপ্তার, স্বীকারোক্তি ও বিচার
১৯৬৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় সিরীয় গোয়েন্দা সংস্থা এলি কোহেনকে গ্রেপ্তার করে। তাকে কীভাবে শনাক্ত করা হয়েছিল, সে বিষয়ে তথ্যের ভিন্নতা রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, বার্তা পাঠানোর সময় ধরা পড়েন তিনি। আবার কারও মতে, তার গতিবিধি নিয়ে আগেই সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। গ্রেপ্তারের পর প্রথম চার দিন কোহেন মোসাদের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন। পরে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের আসল পরিচয় স্বীকার করেন। তবে ইসরায়েলি আদালতের প্রকাশিত নথিতে দেখা যায়, তিনি দাবি করেন—সিরিয়ার কোনো উচ্চপর্যায়ের সামরিক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। তার বিচারকার্যে দায়িত্বে ছিলেন সামরিক আদালতের প্রধান বিচারক সালাহুদ্দিন আদ-দালালি। ২০০১ সালে কোহেনকে নিয়ে লেখা একটি বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন, কোহেন মূলত তথ্য সংগ্রহ করতেন নিম্নপদস্থ সেনা কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারী ও কিছু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে।
দামেস্কে ফাঁসি, মরদেহের খোঁজে ইসরায়েল
১৯৬৫ সালের ১৫ মে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের মারজে স্কয়ারে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয় ইসরায়েলি গুপ্তচর এলি কোহেনকে। খুব দ্রুতই তার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হয়েছিল। ফাঁসি ঠেকাতে শেষ মুহূর্তে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিল ইসরায়েল। তবে কোনো লাভ হয়নি। কোহেনের মরদেহ ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত স্কয়ারে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পরে মরদেহ কোথায় দাফন করা হয়েছে, তা জানায়নি সিরীয় কর্তৃপক্ষ। ইসরায়েল পরে কয়েদি বিনিময় ও গোপনে মরদেহ উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু কোনোভাবেই তা সম্ভব হয়নি। কোহেনের দাফনের স্থান এখনও রহস্যই থেকে গেছে। তাঁর মরদেহ ফিরে পেতে ইসরায়েলের চেষ্টা এখনও চলছে।
ঘড়ি ফিরেছে, ফিরেনি মরদেহ
২০১৮ সালে এক গোপন অভিযানে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ দাবি করে, তারা এলি কোহেনের ব্যবহৃত হাতঘড়ি উদ্ধার করেছে। ঘড়িটি মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তার হাতে ছিল বলে জানায় মোসাদ। পরবর্তী সময়ে মোসাদের সদর দপ্তরে এটি প্রদর্শন করা হয়। সেই হাত ঘড়িটি পরে কোহেনের স্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই ঘটনার চার বছর পর ২০২২ সালে প্রকাশ করা হয় কোহেনের পাঠানো শেষ গোপন বার্তা। সেই বার্তায় ছিল বিদায়ের সুর।মোসাদের তৎকালীন প্রধান বলেন, আমরা থেমে থাকব না। তাঁর মরদেহ দেশে ফেরানোর চেষ্টা চলবে, যত দিন লাগে।
সূত্র: অ্যারাবিক পোস্ট