মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

তুরস্কে আহমাদ আশ শারার আকস্মিক সফর কী বার্তা দিচ্ছে?

নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর প্রথম সরব কূটনীতিক তৎপরতা; আঙ্কারায় শীর্ষ বৈঠকে উঠে এল কুর্দি ইস্যু ও সামরিক সহযোগিতা।
শারা-এরদোগান
ছবিতে আহমাদ আশ শারা (বামে) ও রজব তাইয়্যেব এরদোগান (ডানে)। ছবি : সংগৃহীত

তৃতীয়বারের মতো তুরস্ক সফর করলেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমাদ আশ শারা। চলতি বছরের শুরুতে ক্ষমতায় আসার পর এটি তাঁর তৃতীয় সফর। পূর্বঘোষণা ছাড়া শনিবার তিনি ইস্তানবুলে পৌঁছান এবং ডোলমাবাহচে প্রাসাদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন।

বৈঠকটি হয় কড়া গোপনীয়তার মধ্যে। এতে অংশ নেন দুই দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা ও সামরিক কর্মকর্তারা। তুরস্কের পক্ষে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াশার গুলার, গোয়েন্দা প্রধান ইব্রাহিম কালিন এবং প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থার প্রধান খলুক গোরগুন। সিরিয়ার পক্ষে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসআদ আশ শাইবানি ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মারহাফ আবু কাসরা।

এই সফরের তাৎপর্য বাড়িয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত, যেখানে তারা সিরিয়ার ওপর থেকে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। পশ্চিমা নীতির এই পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

সফরের মাত্র দুই দিন আগে তুরস্কের গোয়েন্দা প্রধান ইব্রাহিম কালিন গিয়েছিলেন দামেস্ক। সেখানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠী ওয়াইপিজি। তাদের নিরস্ত্রীকরণ এবং সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায়, বিষয়টি ফের আলোচনায় উঠে এসেছে।

এই প্রেক্ষাপটে, এরদোয়ান সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়ার সঙ্গে একযোগে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পিকেকে’র বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর যে ঘোষণা দিয়েছেন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের সফর সেই উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

তুর্কি প্রেসিডেন্টের দপ্তর জানায়, দুই নেতা বৈঠকে সিরিয়ার রূপান্তরকালীন পরিস্থিতি ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরদোয়ান বলেন, সিরিয়ার সামনে এখন একটি শান্তিপূর্ণ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে এবং তুরস্ক তার পাশে থাকবে। তিনি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারকে ‘অঞ্চলীয় স্থিতিশীলতার পথে বড় পদক্ষেপ’ বলে মন্তব্য করেন।

তিনি আরও বলেন, সিরিয়ার ভূখণ্ডে ইসরায়েলের হামলা অগ্রহণযোগ্য। তুরস্ক এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সব মঞ্চে সোচ্চার থাকবে।

দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও পরিবহনসহ কয়েকটি খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর কথাও আলোচনা হয়। তুরস্কের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সিরিয়ার পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় তারা কারিগরি ও রাজনৈতিক সহায়তা দেবে।

আহমাদ আশ শারা তুরস্কের সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে আঙ্কারার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জানায়, সফরে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাঁদের তুর্কি সমমর্যাদাসম্পন্নদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক নানা ইস্যুতে বৈঠক করেন। এছাড়া প্রেসিডেন্ট শারা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত টম বারাকের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। সেখানে সিরিয়ার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।

গোপন সফর, না কি জরুরি আলাপ?

তুরস্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেতা’র বিশ্লেষক কুতলুহান কোরজু মনে করেন, এই সফর গোপন নয়, বরং তাৎক্ষণিক ও জরুরি কিছু ইস্যু নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনেই এটি হয়েছে।

তিনি বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সিরিয়া ইস্যুতে ওয়াশিংটনের নতুন দূত নিয়োগ এবং কুর্দি গোষ্ঠী নিয়ে তুরস্কের নিরাপত্তা এজেন্ডা জোরদার হওয়ায় এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

সিরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, ওয়াইপিজি বাহিনী ও সম্ভাব্য সামরিক ঘাঁটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এমনকি সিরিয়া ইস্যুতে ইসরায়েল ও তুরস্কের মধ্যে কারিগরি আলোচনার সম্ভাবনাও আলোচনায় এসেছে।

কোরজুর মতে, প্রেসিডেন্ট আশ শারার মার্কিন দূতের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক প্রমাণ করে, দামেস্ক এখন ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। সিরিয়ার কর্মকর্তারা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করায় এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যেতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহমুদ আল্লুশ মনে করেন, আহমাদ আশ শারার এই সফর সিরিয়ার জন্য এক মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সমঝোতার প্রেক্ষাপটে এটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

তিনি বলেন, আঙ্কারা কুর্দি ইস্যুতে সিরিয়ার নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা বাস্তবায়নে আগ্রহী। এটি তুরস্ক ও পিকেকে-র মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস) মোকাবিলায় যৌথ সহযোগিতার দিকেও নজর দিচ্ছে আঙ্কারা। আইএস বন্দিশালা ও শিবির সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণে দেওয়ার প্রস্তাবও আলোচনায় এসেছে।

আল্লুশ বলেন, সফরের তাৎক্ষণিক ফল হয়তো দেখা যাবে না। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি সিরিয়া-তুরস্ক সম্পর্কের নতুন গতি তৈরি করবে এবং নিরাপত্তা ও সামরিক সমঝোতা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।

সর্বশেষ