পিকেকে (কুর্দিস্তানের ওয়ার্কার্স পার্টি) তাদের সংগঠন বিলুপ্ত করা এবং সশস্ত্র কর্মকাণ্ড থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পর, ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলসহ আশপাশের এলাকায় নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এখন এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব এবং কুর্দিস্তান ও তুরস্কের সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নিতে পারে, তা নিয়ে ব্যাপক পর্যবেক্ষণ চলছে।
গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে কুর্দিস্তান অঞ্চলে পিকেকে যোদ্ধাদের উপস্থিতি স্থানীয় সরকারের জন্য এক দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি করেছে। দলটি ওই এলাকা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে সেখানে সামরিক অবকাঠামো ও করিডোর গড়ে তোলে, যেখান থেকে তারা তুরস্কে সশস্ত্র অভিযান চালিয়েছে। এর জেরে তুরস্ক বারবার ইরাকের কুর্দিস্তানে বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ চালায়। এসব হামলায় অনেক নিরীহ বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং হাজারো কুর্দি পরিবার গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।
পিকেকে-র এই নতুন অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছেন কুর্দিস্তান অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট নেজিরভান বারজানি। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা এই অঞ্চলে নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রকৃত সংলাপের দ্বার খুলে যাবে এবং তুরস্কসহ গোটা অঞ্চলে সহাবস্থান ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে।’
সংবেদনশীল অবস্থানে কুর্দিস্তান
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের ভূমিকাকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক’ আখ্যা দিয়ে তাঁর সমর্থন এবং শান্তি প্রক্রিয়ার সফলতায় অবদানের প্রশংসা করেছেন বারজানি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কুর্দিস্তান বরাবরের মতোই শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংঘাত সমাধানের যেকোনো প্রয়াসকে সমর্থন করে।
আল জাজিরাকে দেওয়া এক বিবৃতিতে, পিকেকে-র এক দায়িত্বশীল সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘আমরা এবার অত্যন্ত সফলভাবে আমাদের কংগ্রেস সম্পন্ন করেছি এবং কিছু ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। তবে পূর্বের মতো এবারও আমরা কোনো গণমাধ্যমকে আমন্ত্রণ জানাইনি। কারণ, আমাদের সদস্যদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাই আমাদের অগ্রাধিকার।’
এই কংগ্রেসে নেওয়া সিদ্ধান্ত এবং দলীয় নেতা আবদুল্লাহ ওজালানের (সদস্যদের কাছে ‘আবো’ নামে পরিচিত) অস্ত্র পরিত্যাগের আহ্বানের প্রতি দলের কিছু অংশের আপত্তি রয়েছে কি না — এমন প্রশ্নের জবাবে ওই সূত্র বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। আমরা সবাই আবোর নির্দেশনা মেনেই চলি। সম্মেলনের পরও শান্তির পথে আমাদের সংগ্রাম চলবে এবং প্রক্রিয়াটিতে আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করব।’
ইরাক সীমান্তঘেঁষা কুর্দিস্তান অঞ্চলে চলমান সংঘাতের পরিণতিতে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ওই অঞ্চলের ৬০০-র বেশি গ্রাম পরিত্যক্ত হয়েছে বা উচ্ছেদের মুখে পড়েছে। শুধু দোহুক প্রদেশেই এই সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়েছে।
এই জটিল বাস্তবতায় কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকার পড়েছে এক সংবেদনশীল অবস্থানে। সরকার একদিকে পিকেকে-কে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় না, তাদের কার্যক্রমকেও সমর্থন করে না। অপরদিকে তারা সরাসরি সংঘাতে জড়ানো থেকেও বিরত থেকেছে—যাতে অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা সৃষ্টি না হয় কিংবা দলটির প্রতি সহানুভূতিশীল কুর্দি জনগণের সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্ব তৈরি না হয়।
এই দ্বৈত অবস্থান কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের জন্য কিছু এলাকায় পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে কঠিন করে তুলেছে। পাশাপাশি, এর ফলে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কেও তৈরি হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনা। কারণ, তুরস্ক পিকেকে-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে এবং বহু বছর ধরেই দলটিকে ইরাকের ভূখণ্ড থেকে উৎখাত করার জন্য কুর্দিস্তান সরকারের কাছ থেকে কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়ে আসছে।
কুর্দিস্তানে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা
পিকেকে যদি নিজেদের বিলুপ্ত করে, তাহলে ইরাকের কুর্দিস্তানে নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। আল–জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরাকের কুর্দিস্তানের পেশমার্গা মন্ত্রণালয়ের সাবেক মহাসচিব ও সামরিক বিশ্লেষক জাবার ইয়াওয়ার বলেন, পিকেকে ও তুরস্কের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হলে অঞ্চলটি এক নতুন নিরাপত্তা বাস্তবতায় প্রবেশ করবে। তবে এই পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যদি তুরস্ক আইনি ও রাজনৈতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়।
তিনি বলেন, এমন কোনো শান্তি উদ্যোগ সফল হলে কুর্দিস্তানে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতির আর কোনো বৈধতা থাকবে না। এর ফলে ইরাকি সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও পেশমার্গা সেনারা আবারও সীমান্তবর্তী এলাকায় মোতায়েন হওয়ার সুযোগ পাবে। এতে কুর্দিস্তান অঞ্চলের তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে থাকা সীমান্ত এলাকায় স্থিতিশীলতা ফিরবে।
জাবার ইয়াওয়ার আরও জানান, বর্তমানে কুর্দিস্তান ও তুরস্কের মধ্যে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক। কুর্দিস্তানে একটি তুর্কি কনস্যুলেট রয়েছে, তুর্কি কোম্পানিগুলো এখানে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং সীমান্ত চেকপয়েন্ট দিয়ে নিয়মিত পণ্য আমদানি হচ্ছে।
তার মতে, যদি পিকেকে ও তুরস্কের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা হয়, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় চলমান সামরিক অভিযানের অবসান ঘটবে।
তিনি মনে করেন, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা কুর্দিস্তানের অবকাঠামো রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে তেলের পাইপলাইন — যা কুর্দিস্তানকে তুরস্কের সঙ্গে যুক্ত করেছে — তা অতীতে পিকেকে সংশ্লিষ্ট হামলায় বহুবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর জেরে দীর্ঘ সময় ধরে তেল রপ্তানি বন্ধ ছিল এবং তা বহুবার মেরামত করতে হয়েছে।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক হোশানক পাওয়ানি বলেন, গত তিন দশকে নিরাপত্তাহীনতার কারণে কুর্দিস্তান ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। কৃষি, ধর্মীয় পর্যটন ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো ঘিরে রাজস্ব আয়ের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগানো যায়নি। এর ফলে কুর্দি জনগণের মাথাপিছু আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
হোশানকের মতে, পিকেকে-র এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে কুর্দিস্তানে নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি চালু করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে সেই সব গ্রামে, যেখানে গত ৩০ বছরে কোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মানুষ আবারও নিজভূমিতে ফিরে আসবে, ফিরে পাবে আত্মবিশ্বাস ও নিরাপত্তাবোধ। ফলে নতুন করে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথ খুলে যাবে।
আঙ্কারা ও সুলাইমানিয়ার টানাপোড়েন
ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলের শহর সুলাইমানিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ক গত কয়েক বছর ধরে উত্তেজনাপূর্ণ। যদিও স্বশাসিত কুর্দিস্তানের রাজধানী এরবিলের সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে দৃঢ় ও সহযোগিতাপূর্ণ, তবে সুলাইমানিয়ার বেলায় তুরস্কের মনোভাব অনেকটাই সংশয়ী ও সতর্ক। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, নিরাপত্তাগত ও অর্থনৈতিক নানা জটিল বাস্তবতা।
তুরস্কের অভিযোগ, সুলাইমানিয়ার প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল ‘কুর্দিস্তান প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন’ (PUK)—যার নেতৃত্বে রয়েছেন পাভেল তালাবানি—তারা কুর্দিস্তান শ্রমিক পার্টি (পিকেকে)-র প্রতি সহানুভূতিশীল এবং অনেক সময়েই পিকেকে-র কার্যক্রমকে উপেক্ষা করে বা প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে। এই অভিযোগকে কেন্দ্র করেই আঙ্কারা গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে সুলাইমানিয়া বিমানবন্দরের সঙ্গে তাদের আকাশসীমা বন্ধ রেখেছে।
তুরস্কের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সুলাইমানিয়ায় নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে এবং সেখানে ‘বিরোধী গোয়েন্দা তৎপরতা’ চালানো হচ্ছে। আঙ্কারার দাবি, সুলাইমানিয়ায় তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম নানা বাধা ও সীমাবদ্ধতার মুখে পড়ে, যা এরবিলে দেখা যায় না।
এ প্রসঙ্গে কুর্দিস্তান প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়নের নেতা সালার মাহমুদ আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের দল সবসময় তুরস্কে শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেছে। প্রয়াত নেতা জালাল তালাবানির দর্শন অনুসরণ করে আমরা বিশ্বাস করি, সংলাপের মাধ্যমেই কুর্দি সংকটের সমাধান সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক সমাধানে আস্থাশীল। তুরস্কে কুর্দিদের অধিকারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে—এই অবস্থানেই আমরা অটল।’
সালার মাহমুদ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, খুব শিগগিরই সুলাইমানিয়া বিমানবন্দর আবারও তুর্কি ফ্লাইটের জন্য খুলে দেওয়া হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘শান্তি সকল পক্ষের জন্যই লাভজনক—যুদ্ধে কেউ প্রকৃত বিজয়ী হয় না।’ সেই সঙ্গে তিনি তুরস্কের জাতীয় সংসদের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থেকে শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেয়।
পিকেকে-র অস্ত্র সমর্পণের সময়কাল ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা
পিকেকে পুরোপুরি অস্ত্র নামিয়ে রাখবে এবং নিজেদের প্রত্যাহার করবে—এই প্রক্রিয়া শেষ হতে কতটা সময় লাগতে পারে? তুর্কি বিষয়ক বিশ্লেষক হাসান মোস্তফা মনে করেন, এতে অন্তত পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় লাগতে পারে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তুরস্কসহ আশপাশের অঞ্চলে রাজনৈতিক ও কৌশলগত অনেক পরিবর্তন ঘটতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তবে মোস্তফা পরিষ্কার করে বলেন, এই উদ্যোগ কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তির ভিত্তিতে হয়নি। পিকেকে ও তুরস্কের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি, এবং কোনো তৃতীয় পক্ষও মধ্যস্থতায় নেই। ফলে এটি একতরফা ও শর্তহীন একটি সিদ্ধান্ত, যা সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
তবু থেকে যাচ্ছে বড় প্রশ্নগুলো
এই প্রক্রিয়া ঘিরে এখনো রয়েছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও জটিলতা।
- পিকেকে-র হাজার হাজার যোদ্ধার ভবিষ্যৎ কী হবে?
- তাদের কোথায় এবং কীভাবে পুনর্বাসন করা হবে?
- সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব, বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় সারির নেতারা কোথায় যাবেন?
- যোদ্ধা ও ক্যাডারদের নিয়ে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অনেকটাই নির্ভর করছে তুরস্ক সরকার এই প্রক্রিয়াটি কীভাবে সামাল দেবে, তার ওপর। বিশেষ করে পিকেকে-র বন্দি সদস্য ও নেতাদের বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী হবে—তা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের জন্য কি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হবে?
তুরস্কের অভ্যন্তরে কুর্দি ইস্যু কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই নীতি ও কৌশলই শেষ পর্যন্ত ঠিক করে দেবে এই অস্ত্র সমর্পণ প্রক্রিয়া কতটা স্থায়ী ও কার্যকর হবে।
সূত্র: আল জাজিরা