মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

লিবিয়া সংকটের সাম্প্রতিক মোড়, যা চলছে দেশজুড়ে

লিবিয়ায় আবারও সহিংসতার ঝাঁঝালো বাতাস বইতে শুরু করেছে। জাতীয় ঐক্য সরকারের প্রধানমন্ত্রী আব্দুল হামিদ দিবেইবা ‘দ্বেইবাহ স্ট্যাবিলাইজেশন সাপোর্ট অ্যাপারেটাসে’র সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক নিরাপত্তা সংস্থা বিলুপ্ত ঘোষণা করার পরপরই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
লিবিয়ার সৈন্য
লিবিয়া সংকটের সাম্প্রতিক মোড়, যা চলছে দেশজুড়ে

রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কেঁপে ওঠার পর আবারও জটিল হয়ে উঠেছে লিবিয়ার রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ। রাজধানী ত্রিপোলিতে নতুন করে প্রস্তুত হচ্ছে হিসাব-নিকাশ, মাঠে-ময়দানে বদলে যাচ্ছে ক্ষমতার ভারসাম্য।

মাঠপর্যায়ে এখন ত্রিপোলিতে বিরাজ করছে এক ধরনের সতর্ক ও থমথমে শান্ত পরিবেশ। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সংঘর্ষ বন্ধ রয়েছে এক সমঝোতার ভিত্তিতে। এর আগে ভয়াবহ সশস্ত্র লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘৪৪৪ কমব্যাট ব্রিগেড’ এবং প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিলের অধীন ‘ডিটারেন্স ফোর্স’। সংঘাত থামাতে গোপনে কিছু সমঝোতায় পৌঁছেছে দুই পক্ষ, যার ফলে আপাতত শান্ত রয়েছে রাজধানী।

লিবিয়ায় নতুন করে উত্তেজনা ও বিতর্ক

লিবিয়ায় আবারও সহিংসতার ঝাঁঝালো বাতাস বইতে শুরু করেছে। জাতীয় ঐক্য সরকারের প্রধানমন্ত্রী আব্দুল হামিদ দিবেইবা ‘দ্বেইবাহ স্ট্যাবিলাইজেশন সাপোর্ট অ্যাপারেটাসে’র সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক নিরাপত্তা সংস্থা বিলুপ্ত ঘোষণা করার পরপরই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে একটি সামরিক অভিযানে সরকার–নিয়ন্ত্রিত বাহিনী ওই বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেয়, এর কিছুদিন আগেই রহস্যজনক পরিস্থিতিতে বাহিনীর প্রধান নিহত হন। এই ঘটনাই পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে, সৃষ্টি হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং ফের সামনে আসে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে পুরোনো আইনি বিতর্ক।

এ ঘটনার রেশ না কাটতেই নতুন রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। প্রতিনিধি পরিষদ রাষ্ট্রীয় উচ্চ পরিষদের সঙ্গে সমন্বয়ে একটি যৌথ কমিটি গঠন করেছে, যার কাজ হবে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীদের তালিকা যাচাই–বাছাই করা। বিশ্লেষকদের মতে, এটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত আব্দুল হামিদ দিবেইবার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার আরেকটি প্রয়াস। তবে দিবেইবা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত কোনো সরকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত তিনি পদ ছাড়বেন না। এরই মধ্যে প্রতিনিধি পরিষদ পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ওসামা হামাদকে বিকল্প প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক মহলেও লিবিয়ার অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা পরিস্থিতির ভয়াবহতা এবং তা থেকে উদ্ভূত অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক বিপর্যয় নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের লিবিয়া মিশন সব পক্ষকে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা গুম, নির্যাতন এবং আটক অবস্থায় মৃত্যুসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়

লিবিয়ায় চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্য ক্ষমতা দখলে লিপ্ত সব পক্ষই দায়ী— এমনটাই মনে করেন দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ ফারাজ দারদুর।

তুরস্কের ইস্তানবুল থেকে আল-আরাবি টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, লিবিয়ায় যারা অর্থ আর ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত, তাদের সরাতে একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া এখন সময়ের দাবি। এর প্রাথমিক ইঙ্গিত ইতিমধ্যে লিবিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দেখা গেছে, যেখানে সবার সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে ব্যাংকের শীর্ষ পদগুলো ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

দারদুরের মতে, লিবিয়ার সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই এখন এই লড়াইয়ে থাকা পক্ষগুলোর চাহিদা পূরণে অপারগ। তিনি বলেন, সম্প্রতি ত্রিপোলিতে যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে, তার পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিযোগাযোগ হোল্ডিং কোম্পানির ভূমিকা। প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরেই নতুনভাবে সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছে।

তার বিশ্লেষণ, ত্রিপোলির সাম্প্রতিক সংঘর্ষে এটা স্পষ্ট— রাজনৈতিক সঙ্কট এখনও পুরোপুরি রয়ে গেছে। আজ যদি আব্দুল হামিদ দিবেইবার সরকার পতনও ঘটে, তাতে সংকটের সমাধান হবে না; বরং নিপীড়ন, সহিংসতা ও খুনোখুনির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, লিবিয়ার পার্লামেন্ট নিজেই এই সংকটের অংশ, কারণ এটি হাফতার পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে বর্তমান কাঠামোয় সমাধান সম্ভব নয়।

দারদুরের মতে, লিবিয়ার সমস্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নয়, বরং আইন পরিষদ নির্বাচন। কারণ, একটি নতুন নির্বাচিত সংসদই সংবিধান প্রণয়ন করবে এবং ভবিষ্যতের সাধারণ নির্বাচনের পথ সুগম করবে।

ক্ষমতার মোহ

রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাসের আবু দীব মনে করেন, লিবিয়ায় চলমান সংঘাতগুলোর মূলে রয়েছে ক্ষমতায় টিকে থাকার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে৷ এতে পরিস্থিতি আরও জটিল করে হয়েছে।

ত্রিপলি থেকে আল-আরাবি টেলিভিশনকে তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাত ধরেই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জন্ম হয়েছে।
তার ভাষায়, আসলে কেউই নির্বাচন চায় না। এই কারণেই জাতীয় ঐক্য সরকার সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। নির্বাচনে যাওয়ার আগে অবশ্যই কিছু মৌলিক নিশ্চয়তা থাকা দরকার।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন আয়োজনের জন্য আগে একটি আইন তৈরি করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই আইন তৈরি করবে কে?
এ কারণেই তার মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হস্তক্ষেপ করে সব পক্ষকে সমাধানে পৌঁছাতে বাধ্য করা।

আবু দীব মনে করেন, ত্রিপলি এখন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আছে। কোনো সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা নেই। কিছু পক্ষ জাতীয় ঐক্য সরকারকে চায় না এবং তারা সুযোগ পেলে রাজধানীতে অস্থিরতা তৈরি করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করবে।

তার ভাষায়, ত্রিপলি ও পশ্চিমাঞ্চল—দুই জায়গাতেই পরিস্থিতি অস্বস্তিকর। তাই এখনই সময় সব পক্ষকে সংলাপের টেবিলে বসার। সেটা হতে পারে নতুন সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে, কিংবা বর্তমান সরকারকে ধরে রাখার লক্ষ্যে।

জনগণের চাপ না হলে পরিবর্তন সম্ভব নয়

অন্যদিকে, গবেষক প্রধান ফাওজি ওমর আল-হাদ্দাদ মনে করেন, লিবিয়ার সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গেছে, কারণ অভ্যন্তরীণভাবে যারা ক্ষমতা ধরে রেখেছে, তারা আসলে কোনো সমাধান চায় না।

টোব্রুক থেকে আল-আরাবি টেলিভিশনকে তিনি বলেন, এই স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এমন এক ধরনের সমর্থন পেয়েছে, যার উদ্দেশ্য কেবল ইউরোপ বা আমেরিকার প্রতি হুমকি এড়ানো।

তার ভাষায়, লিবিয়ার সংকটকে শুধু বাড়ানোই হচ্ছে, সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই। এই ব্যর্থতা কেবল লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, আঞ্চলিক দেশগুলোও দায় এড়াতে পারে না। কারণ লিবিয়া এখন তাদের জন্য হুমকি নয়।

হাদ্দাদ আরও বলেন, গত দশ বছর ধরে একই রাজনৈতিক চক্র ক্ষমতায় আছে। সঙ্গে রয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো, যারা নিজেদের অবস্থান আরও পোক্ত করছে। অথচ তারা দেশের একতা ও সমঝোতার পথে হাঁটতে মোটেও প্রস্তুত নয়।

তার মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সব পক্ষকে এক টেবিলে বসানো প্রায় অসম্ভব। জাতিসংঘের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনো বাস্তব অগ্রগতি নেই। তাই এখন প্রয়োজন একটি জোরালো জনমত কিংবা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চাপ, যা তাদের সমাধানের পথে আনতে বাধ্য করবে।

সূত্র: আল আরাবিয়া

সর্বশেষ